Unemployment Lokniti Survey

চিন্তা সেই বেরোজগারিই

জাতীয়

বামপন্থীরা জোর দিচ্ছেন বেরোজগারি মোকাবিলার প্রচারে।

 দু-চারদিন ধরে সোশাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও বেশ ভাইরাল। ভোটারের কাছে মোদীর ফোন আসতেই তরুণ ভোটার কাজ নিয়ে জানতে চাইলেন। শুনতে না পাওয়ার ঢঙে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে ডিসকানেক্ট হয়ে গেল সেই ভোট প্রার্থী মোদীর ফোন। 
দিনসাতেক পরই প্রথম পর্যায়ের ভোট। ভোট প্রচার ধাপে ধাপে যত গতি বাড়াচ্ছে, ভোটাররা নিজের মত কী হবে, তা স্থির করতে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত। এই অবস্থায় বিরোধীরা যত শাসককে চাইছে অর্থনীতির প্রশ্ন তুলে কোণঠাসা করতে। আর বিজেপি চাইছে সেই অস্বস্তির প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদের দিকে ঝোল টানতে। বিরোধীরা বেরোজগারি তুললে, মোদী বলছেন ৩৭০ ধারা। আইআইটি থেকেও পড়াশোনার শেষে চাকরি নেই কেন এই প্রশ্ন শুনলেই মোদী চলে যাচ্ছেন রামনবমী কীভাবে পালন করতে হবে- সেই প্রসঙ্গে। জিনিসের দাম কেন এত বেশি, প্রশ্ন উঠলে মোদীর মুখে মুসলিম লিগ কিংবা ‘ঘর মে ঘুস কার’ মেরে আসার হুঙ্কার। তবে এই তথ্য-যুক্তির সঙ্গে বিজেপি যত কাউন্টার-ন্যারেটিভ চালিয়ে যাক ২০২৪-এর ভোট প্রচারে অর্থনীতি এখন সামনের সারিতে চলে এসেছে। 
গত দু’দিন ধরে দ্য হিন্দু পত্রিকা সিএসডিএস-লোকনীতির প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষা তুলে ধরেছে। সেই সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, বিজেপি যতই নতুন নতুন মোড়কে রামমন্দির নির্মাণ, জাতীয়তাবাদকে গেলানোর চেষ্টা চালাক, ভোটারদের কাছে তা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না। 
গত এক সপ্তাহে দেশের ১৯ রাজ্যের ১০০টি বিধানসভার ৪০০ ভোটকেন্দ্রের প্রায় ১১ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলে তৈরি এই সমীক্ষা-ফলাফল অনুসারে, ভোটারদের ‘মন কি বাত’-এ প্রাধান্য পাচ্ছে বেরোজগারি আর মূল্যবৃদ্ধি। তিন নম্বরে রয়েছে উন্নয়ন। প্রশ্ন ছিল, ‘এবারের ভোটে আপনার কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু কী?’ এই প্রশ্নে মাত্র ২ শতাংশের কাছে হিন্দুত্ব কোনও ইস্যু। আর ৮ শতাংশের কাছে রামমন্দির নির্মাণ একটা ব্যাপার বটে। কিন্তু ২৭ শতাংশের মত হলো ভোটের ইস্যু বেরোজগারিই। তেমনই ২৩ শতাংশের কাছে মূল্যবৃদ্ধি বড় ব্যাপার। একেবারেই স্পষ্ট, মোদীরা চেষ্টা করেও তাদের দুর্বলতার এই অর্থনৈতিক ইস্যুগুলিকে আড়ালে পাঠিয়ে দিতে পারছে না। 
এই সমীক্ষা দু’টো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। একটা হলো, তাঁরা নিজেরা যে অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে তাঁরা অবগত বা সচেতন। এই প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষা থেকে অন্য যে বিষয়টা স্পষ্টভাবেই উঠে এল, তা স্পষ্টতই শ্রেণির বিভাজন। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল অংশের তুলনায় বেড়ে চলা অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রভাব সবথেকে বেশি পড়ছে গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত অংশের উপর। 
কাজ, কাজ আর কাজ। এটাই সবথেকে বড় চিন্তার। সমীক্ষায় অংশ নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশই (৬২শতাংশ) মনে করেন গত পাঁচ বছর চাকরি পাওয়া কঠিন হয়েছে। শহরে ৬৫শতাংশের মতে, পাঁচ বছরে কাজ পাওবা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। গ্রাম-মফস্বলে সেই হার যথাক্রমে ৬২ও ৫৯ শতাংশ। কাজ পাওয়া নিয়ে উদ্বেগে ভুগছেন ৬৭ শতাংশ মুসলিমই। হিন্দু, অন্যান্য অনগ্রসর অংশ ও তফসিলি জাতির মধ্যে এই চিন্তা ৬৩শতাংশের। তফসিলি উপজাতি বা আদিবাসীদের ৫৯ শতাংশ মনে করেন, শেষ ৫ বছরে চাকরি পাওয়া আরও কঠিন হয়েছে। কাজ পাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ার জন্য কেন্দ্রের সরকারকে দায়ী করেছেন ২১ শতাংশ। আর ১৬ শতাংশ দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে। আবার ৫৭ শতাংশ উভয় সরকারকেই দায়ী করেছে। 
একইভাবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের উদ্বেগ বর্ধিত দ্রব্যমূল্য নিয়ে। প্রশ্ন ছিল, গত পাঁচ বছরে জিনিসের দাম বেড়েছে না কমেছে? ৭১ শতাংশের জবাব বেড়েছে। ১৩ শতাংশের মতে, একই আছে। শহরের মধ্যবিত্ত ও বড়লোকের তুলনায় গরিব ও গ্রামের মানুষ এই বিষয়টিতে অনেক জোরের সঙ্গে মুখ খুলেছেন। 
সিএসডিসি-লোকনীতির এই সমীক্ষা অনুসারে ৮ শতাংশ মানুষের কাছে ভোটে দুর্নীতি একটা ইস্যু। অন্য দল ভাঙিয়ে ঘোটালাবাজগুলোকে দলে টেনে দল ভারী করে মোদী যতই ‘দুর্নীতিমুক্ত ভারত’ গড়ার আস্ফালন করুন আসলে তাঁর নেতৃত্বেই যে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে গেছে, তথ্যসমৃদ্ধ বিরোধীদের এই বক্তব্য এখন প্রভাব ফেলছে ভোটারদের মধ্যে। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, মোদী সরকারের গত পাঁচ বছরে দুর্নীতির পরিমাণ অনেক বেশি বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি বেড়েছি বলে ৫৫ শতাংশ মানুষের মত। এদিকে কৃষক আন্দোলন সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছে। অনেকেই মনে করেন, কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া উচিত। মোদী যতই, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র হুঙ্কার দিন, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি বাড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি মানুষ (২৫শতাংশ) তাঁর কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করছেন। রাজ্য সরকারগুলিকে এর দায় দিয়েছেন ১৬ শতাংশ। আর ৫৬ শতাংশ দায়ী করছেন উভয় সরকারকে। 
দুর্নীতির বাড়ার এই তথ্যের সঙ্গে যে ইডি বা সিবিআই’কে দিয়ে মোদী ‘সাফাই অভিযান’ চালানোর হুঙ্কার দিচ্ছেন, সেই কেন্দ্রীয় সংস্থার ভূমিকাও এই সমীক্ষায় প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে। এই প্রশ্নে উত্তরদাতারা কমবেশি সমানভাবে বিভক্ত। ইডি ও সিবিআই-র মতো এজেন্সিগুলিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে যাঁরা মনে করছেন, তেমনই শতাংশ মানুষ মনে করছেন এখনও সংস্থাগুলি আইনের সীমারেখার মধ্যে কাজ করছে।
বিরোধীদের পাশাপাশি এই সমীক্ষায় ধরা পড়েছে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। এবারের সমীক্ষায় কমিশনের উপর ভরসা মানুষের কমেছে। ২০১৯-এর ভোটের পর যেখানে ৫১ শতাংশ ‘অনেকটাই’ বিশ্বাস করতেন। ২০২৪-এ ভোটের আগে এই হারটাই কমে এসেছে ২৮ শতাংশে। পাঁচ বছরের ‘খানিকটা বিশ্বাস’ করতেন ২৭%, এখন সেই হার ৩০%। মোদীর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ৭শতাংশ ‘খুব বেশি ভরসা ছিল না’ কমিশনের উপর। আর ৫শতাংশ তো ‘একেবারেই বিশ্বাস করতেন না’ কমিশনকে। শেষ পাঁচ বছরে সেই ৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। আর ৫ বেড়ে হয়েছে ৯ শতাংশ।
তেমনই ইভিএম-এ কারচুপি নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। প্রশ্ন ছিল, শাসক দল কি ইভিএম-এ কারচুপি করতে পারে। ১৭শতাংশ মনে করে ‘অনেকটাই’। ২৮ শতাংশ মতে ‘কিছুটা পর্যন্ত’, ১১% -র মতে ‘খুব বেশি নয়’। ‘একেবারেই কিছু করা যায় না’ বলে মত দিয়েছেন ১৬শতাংশ। বাকি ২৮শতাংশ এনিয়ে জবাব দিতে চাননি। 
মোদী চাইলেও এখনও পর্যন্ত দুনীতি হোক বা রাম মন্দির, হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে বাজি মাত করে ফেলার ইঙ্গিত সাম্প্রতিক এই সমীক্ষায় নজর পড়েনি। এমনকি যে জি-২০ শীর্ষবৈঠককে সামনে রেখে ‘বিশ্বগুরু’ সাজতে চাইছেন, কিন্তু সেই জি-২০ দেশের মানুষের মাথা ব্যথাই নেই। ৩৭ শতাংশ জি-২০ র কথা শুনেছেন। ৬৭ শতাংশ জি ২০ নিয়ে কিছু জানেনই না।
 

Comments :0

Login to leave a comment