জয়ন্ত সাহা
ত্রিপুরায় যাচ্ছি শুনে ট্রেনেই সহযাত্রীদের প্রতিক্রিয়া ছিল,‘এ সময়ে ত্রিপুরায় ঘুরতে যাচ্ছেন। ওখানে এখন বাংলাদেশ নিয়ে হাওয়া গরম।’
তা কিছুটা বুঝলাম কৈলাশহর হয়ে আগরতলায় পৌঁছে। কিন্তু এই হাওয়া অন্যরকম। কুমারদুয়ার স্টেশন থেকে আগরতলা যাওয়ার যে ট্রেনের টিকিট ছিল সেই ট্রেন ১১ ঘণ্টা লেটে চলছিল। অগত্যা স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলে ডেমু-তে উঠে পড়লাম। চারপাশের টুকটাক কথা কানে ভেসে আসছিল তার বেশিরভাগটাই বাংলাদেশকে নিয়ে। সেখানে হিন্দুদের কেটে টুকরো করে ফেলা হচ্ছে... ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সহযাত্রী বললেন,‘একটু সাবধানে থাকবেন।’ তখনও বুঝিনি বিষয়টি। আগরতলা স্টেশন থেকে অটো নিয়ে সূর্য চৌমুহিনী থেকে ডান হাতের রাস্তা ধরে একটু এগিয়েই ছিল আমাদের হোটেল। অটো থেকে নামতেই হোটেলের মুখে দেখা দুই বাইক আরোহীর সঙ্গে। দু’জনেই যুবক। লাগেজ নিয়ে আমাদের হোটেলের দিকে এগতে দেখেই আমাদের চারজনের দলকে তারা প্রশ্ন করে বসলেন,‘কোথা থেকে? বাংলাদেশের মুসলমান নাকি?’ আমাদের মধ্যে একজন জবাব দিলেন, ‘না পশ্চিমবাংলা থেকে।’ এবার যুবকদের একজন বললেন,‘কলকাতার হলে অসুবিধা নেই।’
হতচকিত আমরা ৪ জন। ‘অসুবিধা’ তবে কিসে? স্বাধীন দেশে এরকম প্রশ্ন ধেয়ে আসতে পারে ধারণাই ছিল না। যাই হোক আমার সঙ্গী ওদের পালটা জিজ্ঞেস করলেন,‘আইডেন্টি কার্ড দেখবেন? কিন্তু আপনারা কারা? আপনাদের আইডেন্টি কার্ড দেখি।’ এরপর দু’জন বাইক নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় কড়া চোখে দেখে গেলেন। বোঝা গেল এরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশী মুসলমানদের আটকানোর ঠেকা নিয়েছে।
আরএসএস’র মদত পুষ্ট ‘হিন্দু সংগ্রাম পরিষদ’-র নামের আড়ালে চলছে এসব। ট্রেনের সহযাত্রীরা যে বিশেষ বাড়িয়ে বলেননি, তার টের পেয়েছিলাম আগরতলা পৌঁছানোর আগেই, গত ২৯ নভেম্বর। সেদিন রাতে কৈলাশহরের বাংলাদেশ সীমান্তে গেছিলাম। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে পাহারায় থাকা বিএসএফ জওয়ান জানালেন,‘এখানকার ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াত পণ্য সরবরাহ বন্ধ এখন।’ ভাবছিলাম ভারত সরকার কবে বন্ধ করল? আমার বাড়িও তো সীমান্তের কাছেই। শুনিনি তো পশ্চিমবঙ্গে। বিএসএফ জওয়ান সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল আমরা অবাক হয়েছি। তাই তিনিই জানালেন,‘পাবলিক এসে বন্ধ করে দিয়েছে।’ হিন্দু সংগ্রাম পরিষদের কাজ এটা। কৈলাশহরে এ নিয়ে প্রতিবাদের গুঞ্জন আছে বটে কিন্তু সোচ্চার প্রতিবাদের সাহস নেই কারুর। পরের দিন অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর আগরতলা শহরে এসে হিন্দুত্বের দৌরাত্ম্য কতটা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
আগরতলার হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে রুমে যাবার আগে মালিককে সবটা বলতেই উনি স্বগতোক্তি করলেন,‘কী যে হচ্ছে! ব্যবসার বারোটা বেজে যাচ্ছে।’ পরের দিন ভোরে উদয়পুর ঘুরতে যাই। একদিন পর ফের আগরতলায় ফিরতেই দেখলাম চারপাশ থমথমে। ফের সেই হোটেলে উঠতেই মালিক বললেন,‘পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে কোনও বাংলাদেশিকে হোটেলের রুম দেওয়া যাবে না। হোটেলের অর্ধেক রুম ফাঁকা পড়ে আছে। অবশ্য পরের দিন আগরতলা থেকে প্রকাশিত একাধিক বাংলা কাগজে দেখলাম লেখা হয়েছে, হোটেল মালিকরা বাংলাদেশিদের হোটেলের রুম দেওয়া বন্ধ করে দিল। বেশ বুঝতে পারলাম পুলিশকে দিয়ে শাসক দল হোটেলের রুম দেওয়া বন্ধ করিয়ে সেটা হোটেল মালিকদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
আগরতলার একাধিক হোটেল মালিকের বক্তব্য,‘এ রাজ্যে তো পর্যটক আসে কম। আসেন বাংলাদেশের মানুষ। ব্যবসা, চিকিৎসা, আত্মীয়দের টানে। বাংলাদেশিদের আসা বন্ধ হওয়ায় খাঁ খাঁ করছে আগরতলার হোটেলগুলি। ভাতের হোটেল, রেস্তোরাঁ সবেরই এক অবস্থা। অবস্থা আরও ঘোরালো করে তুললো আরএসএসের কিছু লোক। আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশর সহকারী হাইকমিশনারের অফিসের হামলা করল। মিছিল থেকে উগ্র সাম্রদায়িকতার স্লোগান শুনলো আগরতলার রাজপথ।
সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সম্পাদক জীতেন চৌধুরী মেলার মাঠের কাছে দলীয় অফিসে বসে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘এটা ত্রিপুরার সংস্কৃতি নয়। আরএসএস আর বিজেপি ‘হিন্দু সংগ্রাম পরিষদের’ নামের আড়ালে উগ্র হিন্দুত্বের তাস খেলছে।’
জীতেন চৌধূরীর কথাটাই অন্যভাবে বললেন আমাদের আগরতলা ঘুরিয়ে দেখানোর অটো চালক ভোলাদা। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার বাড়ি দেখালেন। আমরা দেখতে চাইনি। ‘ভোলাদা’ বললেন,‘চলুন। দেখে আসবেন। বাড়তি টাকা নেবো না।’ সেই বাড়ির সামনে কড়া পুলিশি প্রহরার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘ওনার বাবা আরএসএস করতেন। এক সময়ে জনসঙ্ঘ থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন। এখন আরএসএস ওনাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে। তাই উনি হিন্দু সংগ্রাম পরিষদকে আটকাচ্ছেন না। ওরা ৩/৪ শো লোকের মিছিল নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে দিচ্ছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখছে কিছু বলছে না।’
সিপাহিজোলা যাওয়ার সময় শ’ দেড়েক লোকের একটা মিছিল (হিন্দু সংগ্রাম পরিষদের)কে দেখলাম শতাধিক পুলিশ আগে পিছে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় পোস্টঅফিস চৌমুহনিতে চা খেতে খেতে চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই কটা লোক? চায়ের গ্লাসটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,‘‘সর্বনাশ! এসব বলবেন না। রাতে বাড়িতে হামলা হবে, ভাঙচুর হবে, মারধর হবে। পুলিশ মামলা নেবে না।’’ চায়ের দাম মিটিয়ে মেলার মাঠের দিকে যেতে যেতে ভাবলাম, কোচবিহারের বিভিন্ন ব্লকে তৃণমূলেরও এটাই কায়দা। প্রশ্ন হলো কে কার কাছে শিখেছে! বিজেপি’র কাছে তৃণমুল? নাকি তৃনমুলের কাছে বিজেপি?
ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের হাল বোঝা গেল সিপাহিজোলা অভয়ারণ্যের সামনের চত্বর। অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থানে বসা ৭২০ জন বনমিত্রের নেতা প্রদীপ কর্মকার আর রাজু মুড়া সিং। বিজেপি’রই বিপ্লব দেব মুখমন্ত্রী থাকার সময় বনমিত্রদের নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রদীপ কর্মকারের কথায়, ‘এখানে যারা আছে তারা সবাই বিজেপি’র কোনও না কোনও পদে আছে। তবুও স্থায়ী চাকরির জন্য কেন অবস্থানে বসেছি জানেন? সরকার আমাদের দাবির কথা শুনতেই চাইছে না। দেখা করতে চাইলে সময় দিচ্ছে না। অন্য মন্ত্রীরা আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিজেপি করেও এখন আমরা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থানে বসেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত অবস্থান চলবে।
ত্রিপুরায় গিয়েই জানতে পেরেছি ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলি ত্রিপুরা পর্যটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডার। অথচ ঊনোকুটি থেকে উদয়পুরের নীরমহল, উদয়পুরের রাজবাড়ি কিংবা ছবিমুড়ার মতো আকর্ষণীয় জায়গা স্রেফ প্রচারের অভাবে পড়ে আছে অনাদরে।
Comments :0