ভাস্কর দাশগুপ্ত
বয়স ৮৫। তবু ’৭১ আজও তাজা পাঁচকড়ি ব্যানার্জির।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মী। বেশিরভাগ সময়টাই কাটে খবরের কাগজ পড়ে আর টিভিতে খবর শুনে। বাংলাদেশের হালের খবর খুঁটিয়ে পড়ছেন। যে জায়গাগুলি খবরের কাগজে আসছে, তার কিছু জায়গায় গেছেন। পড়লেই ভেসে সেই জায়গাটিকে কেন্দ্র করে তাঁর স্মৃতির গহনে সযত্নে থাকা কিছু ছবি। বাংলাদেশ নিয়ে প্রবল আগ্রহ, অনেকটা ভালোবাসা ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের এই জেলার বৃদ্ধের।
কেন?
তাঁর কথায়,‘‘তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়ে। বুঝবে না ১৯৭১ মানে কী? আমাদের জওয়ানরা প্রাণ দিয়েছে। ওদেশের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা মৃত্যুকে পরোয়া করেনি। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল স্বাধীনতার জন্য। আমরা তাঁদের অনেককে দেখেছি। আমরাও তো সীমান্ত পেরিয়ে অজানা, অচেনা জায়গায় সেই ছেলেগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছি পাক সেনার বিরুদ্ধে। পাক সেনা আর তাদের কিছু বন্ধু ছিল বাংলাদেশে। তারা মিলে কী অত্যাচার করেছিল ওদের উপর। ভাবা যায় না! শেষে হেরে গেলো। সামনেই তো সেই ১৬ডিসেম্বর। মুজিবরের ভাষণ শুনেছো? ওরা সেই মুজিবের মূর্তি ভাঙতে পারলো? কী করে পারলো?’’
বাড়িতে কাউকে না বলে ১৯৬৩ সালে পুরুলিয়া শহরে এসে সেনাবাহিনীর পরীক্ষা দিয়েছিলেন। বাড়ি পুরুলিয়া দু-নম্বর ব্লকের চয়নপুর গ্রামে। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স সেন্টার রুরকি বাহিনীতে ২২ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন। চাকরির জীবনে যুদ্ধে গেছেন বেশ কয়েকবার। এক বছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর কখনো জম্মু ও কাশ্মীর, কখনো লাদাখ, কখনো আবার দেশের প্রয়োজনে গেছেন লাহোর। বেশ কয়েকবার সৈন্য সেবা মেডেল পেয়েছেন।
’৭১-এ কী হয়েছিল?
‘‘ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলাম। হঠাৎ সেনাবাহিনীর জরুরি তলব, নির্দেশ যুদ্ধে যেতে হবে। তড়িঘড়ি চলে গেলাম। বলা হলো, যেতে হবে বাংলাদেশ। স্বাধীন হওয়ার জন্য সে দেশের লাখো মানুষ লড়ছেন। তাঁদের পাশে থেকে লড়তে হবে। সে কোনও দেশ দখলের লড়াই নয়। কারও জমি কাড়তে যাচ্ছি না। একটি জাতি স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে যাচ্ছি রাইফেল নিয়ে। এমন যুদ্ধ একজন সৈনিকের জীবনে বারবার আসে না।’’
চট্টগ্রাম পেরিয়ে মেঘনা নদী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলেন ল্যান্সনায়েক পাঁচকড়ি ব্যানার্জি। চোখের সামনে এখনো সেসব স্মৃতি ভেসে ওঠে। চোখের দৃষ্টি বয়সের কারণে ঝাপসা হয়ে এলেও মনের স্মৃতি এখনো ঝাপসা হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধের বেশিরভাগ কথা, প্রতিটি দিনের লড়াইয়ের কথা মনে আছে। মনে আছে দু’পক্ষের যুদ্ধবন্দিদের কথা। মনে আছে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের কথা। আর স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল গ্রামগুলির কিছু কিছু ছবি আজও জেগে আছে ফুলের মতো। অমলিন সেই স্মৃতি নিয়ে এখন পাঁচকড়ি ব্যানার্জির গলায় যন্ত্রণা। বাংলাদেশের যাঁরা বলছেন কলকাতা দখল করবেন, ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গা দখল করবেন তাঁদের সম্পর্কে কোনও কথাই সেভাবে বলতে চান না তিনি। শুধু বলেন,‘‘বাজার গরম করার জন্যই ওরা এমন বলছে। ভারতের শক্তি সম্পর্কে ওদের নিশ্চয়ই ধারণা আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন দেশের পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠলো কী করে?’’
তবে তাঁর মনে হওয়া,‘‘ ওরা বুঝতে পারছে না কী ভুল করছে। একদিন এই ভুলের মাশুল দিতে হবে। হাসিনা ভালো না খারাপ, সেটা আমার বলা ঠিক নয়। আমি অত জানিও না। কিন্তু যেটা জানি, যা দেখেছি, তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশের জন্য, স্বাধীন দেশের জন্য ওদের বাড়িরই অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে। ওরা সেটা ভুলে গেল? মুজিবের অবদান ওদের মনে রইলো না?’’
পাঁচকড়ি ব্যানার্জির কথায়,‘‘কেউ কারও দেশ দখল করার কথা উঠছে কেন? তাতে কী লাভ হবে? বাংলাদেশে বর্তমান যা অবস্থা তাতে কী সেখানকার মানুষেরা শান্তিতে আছেন? একটা শান্ত দেশ অশান্ত হয় শুধুমাত্র ধর্মের নামে যাঁরা রাজনীতি করে, তাঁদের জন্য। একাত্তরের যুদ্ধে একটা দেশকে স্বাধীন করার আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। আজ জীবনের এতগুলো বছর পরে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে ভাবেন তাহলে কী সেই লড়াই বৃথা গেল?’’
নিজেই আবার বলে ওঠেন,‘‘আমরা দেখেছি দেশটাকে। মানুষ খুব ভালো। ওরা নিশ্চই আবার ফিরে পাবে ওদের শান্ত দেশ।’’
Comments :0