শান্তনু চক্রবর্তী
মূল তেলেগু ভাষায় কথাটা ছিল ‘থাগ্গোর লি’— মরে গেলেও পিছিয়ে আসব না। হিন্দি ডাবিং-এ সেটাই হয়ে গেল, ‘পুষ্পা ঝুকেগা নহি’!
এই এক সংলাপেই কেঁপে গেল অন্ধ্রের উপকূল থেকে হিমাচলের পাহাড়, রাজস্থানের মরুভূমি থেকে বাংলার জঙ্গলমহল। ২০২১-এ করোনা অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় গোটা দেশেরই যখন নুয়ে পড়া দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবসাদে আচ্ছন্ন দশা— সদা-ঘটমান, উত্তেজক বলিউড সহ টলিউড-কলিউড-মলিউড, পুরো বিনোদন শিল্প যখন মুখ থুবড়ে কিংবা ঝিমিয়ে পড়েছে— তখনই এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে, সুকুমার বন্দরেড্ডির তেলেগু ছবি ‘পুষ্পা দ্য রাইজ’-এর অবিশ্বাস্য উত্থান। কিসের জোরে, কোন মন্ত্রে, একটি পুরোদস্তুর দক্ষিণী মনোরঞ্জক, বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমা সারা ভারতের দর্শকদের হৃদয়-মনের দখল নিয়ে নিল? নামকরা সব বক্স অফিস পণ্ডিত, সিনেমার সমাজতাত্ত্বিক বা সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা নানা রকম তত্ত্ব আমদানি করলেন। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র পুষ্পা বা পুষ্পারাজ সর্বভারতীয় জনপ্রিয় সংস্কৃতির একটি ‘ঘটনা’ বা আইকন হয়ে উঠল। তার হাঁটাচলা, হাতের নানারকম ভঙ্গি, এমনকি মুদ্রাদোষ বা ম্যানারিজম অবধি রীতিমত চর্চা বা অলোচনার বিষয় হয়ে যায়। তাকে পর্দায় দেখেই পুষ্পার কী কী শারীরিক-মানসিক অসুখ-বিসুখ আছে, তার একটা লম্বা ক্লিনিক্যাল লিস্ট বানিয়ে ফেললেন নামী মেডিক্যাুল কলেজের এক পড়ুয়া চিকিৎসক। সেটা আবার সমাজ-মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ ‘ভিউজ’, হাজার হাজার ‘লাইকস’! তাই নিয়ে আবার নতুন নতুন ‘মিম্’। সবটা মিলিয়ে পূর্বঘাট পার্বত্য অঞ্চলের চিত্তুর জেলার জঙ্গলে রক্ত-চন্দন কাঠের চোরাচালানদার শ্রীমান পুষ্পা, সর্বভারতীয় জনপ্রিয় সংস্কৃতি থেকে বিদ্যায়তনিক পরিসর অবধি তার ‘রাজ’ কায়েম করে ফেলে। জনতা-মিডিয়া-গবেষক-অধ্যাপক সবার যৌথ আশ্রয় প্রশ্রয়ে তিন-সাড়ে তিন বছরে বাড়তে-বাড়তে, ফুলতে-ফুলতে, স্রেফ ‘উত্থান’ থেকে নিজের ‘শাসন’ কায়েম করার জায়গায় পৌঁছে গেল।
‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ পুষ্পা: দ্য রুল! ‘পুষ্পা-১’ থেকে ‘পুষ্পা-২’। পুরানো রেকর্ড চুরমার করে বক্স অফিসের নয়া রেকর্ড!
পুষ্পা-২ যখন এভাবে প্রতিদিন বিনোদন বাণিজ্যের এক-একটা নতুন সিঁড়ি ডিঙোচ্ছে, ‘পুষ্পা’ এত পর্দা দখল করে রেখেছে যে, নতুন বাংলা ছবিগুলি ঠিকঠাক হল বা শো পাচ্ছে না, তখন এই তথাকথিত ‘পুষ্পা-ফেনোমনন’কে একবার ফিরে দেখাই যায়। পুষ্পা-১ নিয়ে ব্যাপক হইহুল্লোড়কালে এদেশে অর্থনীতি-রাজনীতি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে মননশীল চর্চা-লেখালিখির একটি মান্য, অভিজাত, ঐতিহ্যবান পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও জন-সংযোগ বিশেষজ্ঞ দীপ্তি কৃষ্ণা গোটা ‘পুষ্পা’ ছবিটা নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন। যার শিরোনাম ছিল ‘পুষ্পা দ্য রাইজ: সার্কুলেশন অব মার্জিনাল হাইপারম্যাস্কুলিনিটি’। বাংলা অর্থ করলে মোটামুটি এইরকম দাঁড়ায়— প্রান্তিক অতি-পৌরুষের প্রবাহমানতা। এখন প্রবন্ধকার এখানে পুষ্পার সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তার হিসাব-নিকেশে তেমন না গিয়ে, মূলত তেলেগু বাণিজ্যিক মূল ধারার সিনেমার প্রেক্ষিতেই ছবির সাফল্যের কারণগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। দক্ষিণের এইসব ব্লকব্লাস্টার ছবির ডিএনএ-তে কোথাও ১৯৭০-৮০’র দশকের বলিউডি মূলধারার ছবির নায়ক-নির্মাণ এবং সেই নায়কের সঙ্গে সিনেমাঘরের প্রান্তিক-শ্রমজীবী, মজুরির পয়সা বাঁচিয়ে ফ্রন্টস্টলের টিকিট কাটা দর্শকদের প্রাণের যোগ তৈরির প্রক্রিয়ার ছাপ আছে কিনা, সেটি আলোচনায় আসেনি। অথচ পর্দায় পুষ্পার দাপটে দীপ্তি যে প্রান্তিক অতি-পৌরুষের বিস্ফোরণ দেখেছেন, সত্তর দশকে অমিতাভ বচ্চনের বদরাগী বা অতি-রাগী যুবকের ইমেজ তার চেয়ে আলাদা কিসে? সেই ‘রাগী যুবক’ বা সেইসব রাগী যুবকেরাও তো ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে বা পরিস্থিতির চাপে পড়ে প্রবল কোণঠাসা, একরকম প্রান্তিক পুরুষই। ঘরে স্বামী-সোহাগসুখ বঞ্চিতা প্রতারিতা মায়েরা আছেন। পুষ্পার মতই তাদেরও কেউ কেউ ‘নাজায়েস, ‘লাওয়ারিশ’ তকমা ঘোচালে যৌবনভর আকুল হয়ে নিজের পদবি বা পিতৃ পরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছে। পুষ্পারাজের মতোই তারা মেহনত-মজদুরি দিয়েই জীবন শুরু করেছে। কখনো ডক-শ্রমিক, কখনও রেল-স্টেশনের কুলি, এমন কী কখনো বা ছিঁচকে চোর বা পাতি স্মাগলার বা ওয়াগন-ব্রেকার।
কিন্তু আর্থ-সামাজিক অবস্থানে এদের বাইরে থেকে যতই কমজোরি, অসহায়, হতমান দেখাক দুনিয়ার বড়লোক বা সমাজ-রাজনীতির ক্ষমতাশালীরা এদের যতই পোকা-মাকড়, লিলিপুট ভাবুক, এদের অন্তরে অন্দরে গনগনে তেজ একেবারে দপদপ করছে। পেটে ভাত না জুটলেও এদের অহং আর আত্মসম্মান বোধ টনটনে। প্রসঙ্গ এটাই প্রান্তিক-পৌরুষের দেমাকি প্রতাপ। পুষ্পা-১ও ২-ই এর নায়ক, তেলুগু সুপারস্টার অল্লু অর্জুন ছবিতে যেমন বার বার মনে করিয়ে দেন ‘পুষ্পা ঝুকেগা নহি শালা’, তেমনই ‘দিওয়ার’-এও বিজয়-রূপী অমিতাভ বচ্চন তাঁর গভীর-গম্ভীর ব্যারিটোন-এ গমগমিয়ে ঘোষণা করেন ‘ম্যায় ফেকা হুয়া পইসা নহি উঠাতা’!
আসলে এগুলি শুধুই সংলাপ নয়। এগুলো হচ্ছে জনপ্রিয় সিনেমার সেইসব চিহ্ন বা অভিজ্ঞান, যার টানে রুজি-রুটির ঘানিতে দিনভর পেষাই হওয়া প্রান্তিক জনতা সিনেমাঘরে আসবেন। পর্দায় নায়কের মধ্যেই খুঁজে পাবেন তাঁদের সাথী, বন্ধু, নেতা অথবা ঈশ্বরকে। যিনি তাঁদের সব অপমানের শোধ তুলবেন, তাঁদের হয়েই সব লড়াই ফতেহ্ করবেন। তিনিই প্রমাণ করে ছাড়বেন, ইচ্ছে করলে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-পরাজিত মানুষও পালটা ঘুরে দাঁড়িয়ে দুনিয়ার সব সুখ নিজের পকেটে পুরতে পারে। পুষ্পাকে সিন্ডিকেটের এক মাতব্বর অপমান করে নিজের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল বলে, কমিশনের পুরো টাকাটা দিয়ে আস্ত নতুন একটা গাড়ি কিনে বাড়ি ফেরে। ‘দিওয়ার’-এর বিজয়ও তার মা একদা যে বহুতলে নির্মাণ-শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছিলেন, রোজ ঠিকাদারের মুখ-ঝামটা শুনেছিলেন, সেই বাড়িটাই কিনে মাকে উপহার দেয়। এটাই প্রান্তিক-পৌরুষের অহং, জেদের প্রকাশ। প্রান্তিক দর্শক-জনতাও এই পৌরুষের সঙ্গেই নিজেদের আইডেন্টিফাই করেন। তাঁরা আড়াই-তিন ঘণ্টার জন্য নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করেন যে, এই উদ্ধত-আগ্রাসী দুর্বার পুরুষই জীবনের চলার পথের সমস্ত বাধা ভেঙেচুরে-মাড়িয়ে চলে যেতে পারে। আর বাধা টপকে, অসম্ভবকে সম্ভব করার দম না থাকলে, সে পুরুষ মানুষই নয়। ক্ষমতার লড়াইয়ে পুষ্পার কাছে বারবার হেরে যাওয়া চন্দনকাঠ চোরাচালান সিন্ডিকেটের পুরানো মাতব্বর শ্রীনুর বউ দ্রাক্ষাও তাই বরকে সেই পৌরুষ তুলেই খোঁটা দেয়।
এখন যাকে টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি’ বা বিষাক্ত, বিধ্বংসী পৌরুষ বলে, দক্ষিণের কিছু কিছু সিনেমায় আমরা যার নমুনা দেখেছি, এই প্রান্তিক পৌরুষকে ঠিক সেই লিস্টিতে ফেলা যাবে না।
বেশি উদাহরণের চক্করে না গিয়ে যদি পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গারের দু’-একটি সিনেমার কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তেলুগু ছবি ‘অর্জুন রেড্ডি’ ও শাহিদ কাপুর অভিনীত তার হিন্দি ইমেজ ‘কবীর সিং’ দুটোতেই আমরা ওই বিধ্বংসী পৌরুষের বিস্ফোরণ দেখেছি। নায়ক পুরুষের ইচ্ছে-চাহিদা-পছন্দ স্বার্থই এখানে পরম সত্য। প্রেমের চলচ্চিত্র যে একই রকম উগ্র প্রবল। নারীর শরীর-মন-ভালোবাসা সবটাই সে জবরদখল করে পেতে চায়। মেয়েটির চাওয়া-পাওয়া-ভাবনার কোনও মূল্য তার কাছে নেই। বাধা পেলে সে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। অপমান আসলে মেয়েটিকে ছিন্নভিন্ন করে। সন্দীপ পরিচালিত সামাজিক বলিউড ছবি ‘অ্যানিম্যাল’-এ রণবীর কাপুর অভিনীত চরিত্রটিতে সেই বিষাক্ত পৌরুষের নীল ছোবলই দেখতে পাই। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রাক্তন প্রেমিকার ওপর শারীরিক আক্রমণ-নির্যাতন কিংবা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া নৃশংস খুন-ধর্ষণের ঘটনাবলীর পেছনে এই ধরনের ‘টক্সিক’ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কতদূর কাজ করে, সেটা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিকদের অবশ্যই গবেষণা চলছে। তবে আগেই যেটা বলেছি, সত্তরের দশকের ‘রাগী যুবক বা ২০২৪-এর পুষ্পা পৌরুষের ধরনটা ঠিক এই রকম নয়। অমিতাভ বচ্চনের ‘বিজয়’ বা অল্লু অর্জুনের পুষ্পা’ নির্মম প্রভুত্বকামীতায় মেয়েদের দাবিয়ে বা দমিয়ে রাখতে চায় না। মেয়েদের প্রতি বিজয়ের ব্যবহারে একটা উদাসীন উপেক্ষা থাকলেও নিষ্ঠুরতা ছিল না। পুষ্পাও শ্রীবল্লির সঙ্গে তার দাম্পত্যে, এমনকি শারীরিক অন্তরঙ্গ মুহুর্তেও বউয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ, অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। তারা এখানে কোথাও অর্জুন রেড্ডি, কবীর সিং বা অ্যানিম্যাল-এর রণবিজয় সিং নয়। তাদের পৌরুষের দেমাক, দাপট বা ইগো অন্য জায়গায়। তারা যখন যে কাজটা করবে, তখন সেখানে তাকে টক্কর দেওয়ার মতো অন্য কোনও পুরুষ থাকবে না। অমিতাভ বচ্চন যখন মাফিয়া ডন তখন তাঁর নাগাল পাওয়া গোটা দুনিয়ার পুলিশবাহিনীর কাছে শুধু মুশকিলই নয়—‘না মুমকিন’। অসম্ভব। একই কথা অল্লু অর্জুনের পুষ্পা সম্পর্কেও খাটে। পুলিশকে বুদ্ধু বানিয়ে রক্তচন্দন কাঠ-পাচারে তার জুড়িদার সিন্ডিকেটে আর কেউ নেই।
যে পেশাতেই থাকুক, ‘জিরো’ থেকে এই হীরো নাম্বার ওয়ান হয়ে ওঠাটাই প্রান্তিক পৌরুষের অন্যতম লক্ষণ। সেদিক থেকে বিজয় কিংবা পুষ্পাকে বরং ‘আলফা মেল’ বলা যায় — নিজেদের জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে সবাইকে গুঁতিয়ে-সরিয়ে সেরার সেরা, পয়লা নম্বর! এরা দিনের শেষে খুব একলা। এদের যা কিছু সাফল্য বা অর্জন, সেটা শেষ অবধি নিজের, বড়জোর পরিবারের জন্যই। তবু পিছিয়ে থেকেও ক্ষমতাবানের সঙ্গে লড়ে, জিতে যাওয়ার সেই আখ্যান নিম্নবিত্তের মানুষকে সিনেমা ঘর ভরাতে ডেকেছে। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে যখন সিঙ্গল স্ক্রিনের বদলে ক্রমশই মাল্টিপ্লেক্স-এ শহর ভরে গেল— বলিউডের নায়করাও শ্রমজীবী মানুষের বস্তি ছেড়ে ক্রমশ মুক্ত অর্থনীতি আর পুঁজির সুবিধাভোগী, কর্পোরেট আর এনআরআই জীবনযাপনের স্বপ্ন ফেরি করতে লাগল— পুরানো ফ্রন্টস্টলের দর্শকেরা সেই বিনোদন যজ্ঞে প্রায় বাইরে চলে গেলেন। এখন পুষ্পা-সিরিজের মতো সিনেমাগুলো নতুন প্যাকেজিং-এ পুরানো ফর্মুলাকে ফিরিয়ে এনে, ওই বাদপড়া দর্শকদের উত্তরপুরুষেরও হয়তো হলে ফিরিয়ে আনছে। কিন্তু বিনোদনের সেই জায়গাটাতেই কোথাও একটা মহা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে! রাগী যুবক যখন অপরাধের পাতালপুরীর আধার পথে তলিয়ে যাচ্ছে, সে জেনেই যাচ্ছে, এটা আসলে ঠিক পথ নয়। তার বেছে নেওয়া রাস্তাটাকে সে নৈতিকভাবে কোথাও বৈধতা দেওয়ার দায় নিচ্ছে না। চিত্রনাট্য বরং তার অপরাধের ‘মোডস অপারেন্ডি’-র চেয়েও তার নৈতিক মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এবং ক্লাইম্যাক্সে পাপের বেতনটাও সে ঠিকঠাকই পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ‘পুষ্পা’ সিরিজের মতো ছবি সেই অপরাধের প্রক্রিয়াকেই একটা বিনোদন উদ্যাপন করে তুলছে। অপরাধটাকে নিখুঁত পেশাদারিত্ব ঘটিয়ে ফেলাতেই সবটা বাহাদুরি। ফলে ছবির অধিকাংশ অ্যা কশন-থ্রিল ওই কাঠ পাচারের গ্রাফিক ডিটেইলের সূত্র ধরেই আসে। সেখানে প্রত্যেকবার পুষ্পার নিজস্ব স্টাইলে জিতে যাওয়া হলভর্তি দর্শকের অ্যাডরিনালিনকরণ আরও বাড়িয়ে তোলে। তাদের উত্তেজিত এবং উদ্দীপ্ত করে। আর এখানেই ওত পেতে দাঁড়িয়ে আছে বিপদ।
দিওয়ার-এ বিজয়ের অপরাধে তার মা-ভাইয়ের সঙ্গ ছিল না, বরং বিরোধিতা ছিল। এখানে পুষ্পাকে ঘিরে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা সবটাই এই অপরাধ চক্রের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। সবটা মিলিয়েই যেন একটাই ‘ইকোসিস্টেম’। অপরাধ-প্রবণতার বাস্তবতা। চোরাচালান সিন্ডিকেটের অঢেল টাকায় পুষ্পা একটা পুলিশ-থানা শুধু নয়, কেন্দ্রের মন্ত্রী, রাজ্যের মন্ত্রী, বিধানসভার সমস্ত বিধায়ককে কিনে নেয়। অন্তর্বাস বদলানোর মতো করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে অবধি পালটে দেয়। কারণ তার বউয়ের আবদার-মাফিক ওই মুখ্যমন্ত্রী পুষ্পার সঙ্গে এক ফোটো ফ্রেমে থাকতে চাননি, তাই ছবি হিসাবে ‘পুষ্পা ১ ও ২’ শুধু রাজনীতির চরম ও চূড়ান্ত অপরাধীকরণকেই শুধু বৈধতা দেয় না। একই সঙ্গে অপরাধ ও দুর্নীতির রাজনীতিকরণকে প্রায় উৎসবের মতই উদ্যাপন করে। এই মুহূর্তে সারা দেশের নির্বাচনী-রাজনীতিতে দুর্নীতির প্রশ্ন কেন কোনও প্রভাব ফেলতে পারছে না, পুষ্পা-র রেকর্ড ভাঙা বাণিজ্যিক-সাফল্যই যেন তার সমস্ত উত্তর দিয়ে দেয়! ছবির নায়ক বনের সম্পদ তথা পরিবেশ রক্ষা করার বদলে এখানে বিরল চন্দন গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করে দিচ্ছে। নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করছে। আর শুধু তাই নয়, এই পরিবেশ-ধ্বংসকেই গরিব-প্রান্তিক মানুষের রুজি-রুটি, উন্নয়ন ও আকাঙ্ক্ষা-পূরণের একমাত্র পথ বলে সেটাকে একরকম নৈতিক বৈধতাও দিচ্ছে।
পুষ্পা-র নায়ক অল্লু অর্জুনেরই অভিনেতা-রাজনীতিবিদ কাকা তথা অন্ধ্র প্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণ সম্প্রতি একটি সেমিনারে এই কথাটা বলেও ফেলেছেন। পবন অন্ধ্র প্রদেশের বন ও পরিবেশ দপ্তরেরও দায়িত্বে আছেন। ফলে সেমিনারে এইসব ভালো ভালো নীতির কথা বলাটা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু পবনের জনসেনাপার্টি যাদের সঙ্গে জোট বেঁধে অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষমতায় আছে, সেই বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের সরকারই তাদের অতি পেয়ারের স্যা্ঙাত-পুঁজির হাতে চোখ বুজে দেশের পরিবেশ ও অরণ্যসম্পদ অবাধ ধ্বংস করার-ছাড়পত্র তুলে দিচ্ছে। পুষ্পা-র ক্লাইম্যাক্সের অ্যাকশন দৃশ্য অল্লু অর্জুনও তো সাদা শরীরে হিন্দু-পুরাণের নানা দৈব-মাহাত্ম্যের চিহ্ন বহন করেন। দক্ষিণ ভারত দখলে মরিয়া সঙ্ঘ-পরিবারের রাজনীতিও ভবিষ্যতে তাঁকে বক্স-অফিসের বাইরের আঙিনাতেও ব্যবহার করার যে ছক কষছে না, সেটা কে বলতে পারে?
Comments :0