রং, ভাষ্য ও অবস্থান বদলের প্রশ্নে খোদ গিরগিটিকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিরোধীদের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল জাত গণনা। জনগণনার সঙ্গে জাত গণনাকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশের সমগ্র জনবিন্যাসের মধ্যে বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, পশ্চাৎপদ অংশের মানুষের অংশ বা অনুপাতের নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান তৈরি করা এবং তার উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস এবং ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে সরকারে উন্নয়ননীতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করাই ছিল বিরোধীদের লক্ষ্য। সামগ্রিকভাবে দেশের অগ্রগতি হলেও, অর্থনীতির বিকাশ হলেও, বৃদ্ধির হার বাড়লেও, এমনকি মাথা পিছু আয় বাড়লেও বাস্তবে সম্পদের অসম বণ্টন অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। সরকারের নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার ফসল হিসাবে দেশে যে সম্পদ তৈরি হচ্ছে তার সবটাই কার্যত চলে যাচ্ছে উপরতলার সংখ্যালঘু ধনীদের ঘরে। নিচুতলার সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনও পরিবর্তন প্রায় হচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে সম্পদ সৃষ্টি হয় তা পুনর্বণ্টনে সরকারের গৃহীত নীতি বিত্তবানদের স্বার্থকে পুষ্ট করে। তাই দেশে হু হু করে বেড়ে চলেছে কোটিপতি শতকোটিপতির সংখ্যা। সম্পদের মালিকানায় ভারতের ধনকুবেররা এখন ধনবান পশ্চিমী দেশের ধনীদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। বস্তুত সাম্প্রতিক সময়ে আয় ও সম্পদ বৈষম্যের নিরিখে ভারত একেবারে সামনের সারিতে অবস্থান করছে।
এহেন সরকারি নীতি এবং উন্নয়ন ও বণ্টন পরিকল্পনার ফলে তফসিলি জাতি-উপজাতি সহ ও বিসি’র জন্য সংরক্ষণ চালু থাকলেও তাদের অবস্থার বিশেষ কোনও উন্নতি হচ্ছে না। তাছাড়া দেশে এমন পিছিয়ে পড়া, অর্থনৈতিকভাবে দুঃস্থ মানুষদের সংখ্যা ঠিক কত, তারা সমাজের কোনও অংশের মধ্যে বা গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান করেন সেটা স্পষ্ট নয়। কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিসংখ্যানও সরকারের কাছে নেই। দশ বছর অন্তর জনগণনা হয় বটে এবং তাতে আংশিক কিছু তথ্য থাকে বটে, সেই জনগণনার কাজও মোদী সরকার বন্ধ রেখেছে পাঁচ বছর ধরে। কবে সেই জনগণনণার কাজ হবে, অথবা আদৌ হবে কিনা তারও কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই।
মোদী সরকার মূলত দুটি কারণে জনগণনার কাজ বন্ধ রেখেছে এবং এক দশক ধরে জাত গণনার কাজের ঘোরতর বিরোধিতা করে এসেছে। জনগণনার ফলে দেশের কোনও অংশ কতোটা পিছিয়ে পড়েছে ধরা পড়ে। উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই তথ্য জরুরি। বিজেপি যেহেতু আদর্শগতভাবে কর্পোরেট-হিন্দুত্ব বোঝাপড়ায় বিশ্বাসী তাই হিন্দুত্বের রাজনীতির আড়ালে কর্পোরেট সেবা তথা বিত্তবানদের স্বার্থ সিদ্ধিই তাদের লক্ষ্য। জনগণনার ফলে ধর্মগত, জাতি-উপজাতিগত, পেশাগত, আর্থিক অবস্থাগত নানা তথ্য সামনে চলে আসে। তাতে সরকারের কর্পোরেট বান্ধব নীতির বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হতে পারে। তাই সত্য তথ্য বা বাস্তব পরিসংখ্যান অজ্ঞাত রাখাতে তারা বদ্ধপরিকর। জনগণনা না করার পেছনে এটাই প্রধান কারণ। আর জাত গণনা বিজেপি’র কাছে আরও বিপজ্জনক। আরএসএস’র ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজই বিজেপি’র লক্ষ্য। তাই মনুবাদ তাদের অতিপ্রিয় সামাজিক কাঠামো। ভারতে বর্ণ হিন্দুরা সংখ্যায় কম। দলিত, আদিবাসীরাই সংখ্যায় বেশি। জাতি-উপজাতি-ওবিসি’র মধ্যে এরা ছড়িয়ে আছে। এরাই আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ। জাত গণনা হলে এদের বিস্তারিত তথ্য পরিসংখ্যান সামনে এসে যাবে। তখন বর্ণহিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক নীতির বিরুদ্ধে জোরালো দাবি উঠবে। আন্দোলনের ঝড় বইবে। বিজেপি তাকে ভয় পাবে। তাই দাঁতে দাঁত দিয়ে এতকাল জাত গণনার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। বিজেপি’র শয়তানি পশ্চাৎপদ মানুষ বুঝতে শুরু করেছেন। ক্ষোভ রোষে পরিণত হবার আগেই যাতে চাপা দেওয়া যায় তাই জাত গণনার সিদ্ধান্ত। তবে দলটা যখন বিজেপি তখন না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
Editorial
গিরগিটি

×
Comments :0