AIR POLLUTION

শ্বাস-প্রশ্বাসের অধিকার চায় আগামী প্রজন্ম

উত্তর সম্পাদকীয়​

 তপন মিশ্র 
১৩ বছরের মেয়ে অশ্মী প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া আবেগপূর্ণ একটি চিঠি অনেকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। চিঠির মূল আবেদন হলো আমাদের ‘শ্বাস-প্রশ্বাসের অধিকার’  ফিরিয়ে দিতে হবে। বেঙ্গালুরুর মেয়ে অশ্মী সাপরে।  ‘ওয়ারিয়র মমস’ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট অশ্মীর চিঠির একটি অনুলিপি এবং তার আবেদনের একটি ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছে হ্যাসট্যাগ  '#BachonKaHakSaafHawa'। এই ভিডিওতে এবং চিঠিতে মেয়েটি স্বচ্ছ বাতাসের দাবি তুলেছে। ভিডিওতে, কিশোরীটি বলেছে যে সে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে লিখেছে "একথা শুধু একটি ১৩ বছর বয়সি কিশোরীর কথা নয়, বরং সমস্ত ভারতীয়দের চিন্তার বিষয়। আমাদের সবার স্বপ্ন হলো এমন একটি দেশে বেঁচে থাকা যেখানে আমরা কোনও উদ্বেগ ছাড়াই শ্বাস নিতে পারবো"।
এবছর আগের বছরগুলির থেকে অনেক বেশি পরিমাণে দুষিত হয়েছে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস। কেবল বেঙ্গালুরু নয় কলকাতা, দিল্লি সহ দেশের বেশ কিছু ছোট শহর এমনকি গঞ্জেও বায়ু দূষণের মাত্রা সহ্যের অতীত হয়ে গেছে। আমাদের দেশে বায়ু দূষণের পরিমাপ করার যন্ত্র কেবল কিছু বড় শহরে রয়েছে। তাও অনেক ক্ষেত্রে বিকল। বিভিন্ন রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলি, যাদের এই ব্যবস্থা করার কথা, তাদের কর্মচারীর সংখ্যা অত্যন্ত স্বল্প।  দুঃখের বিষয় কেবল দিল্লি, কলকাতার মতো শহর বাদ দিলে অন্য জনপদের কথা তেমনভাবে আলোচিত হয় না।         
‘ওয়ারিয়র মমস’ লিখছে ''দিল্লির বাইরে বায়ু দূষণের বিষয়ে আলোচনাকে বিস্তৃত করা অপরিহার্য। একথা অস্বীকার করা যায়না যে ভারতের বিভিন্ন শহর ও শহরের মানুষ একই ধরনের চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ছে''। 
আমাদের এখন দেখার বিষয় যে কেন এই ছোট্ট মেয়েটি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখা দরকার মনে করলো? সে কি বুঝেছে যে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ একটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়? সেকি বুঝতে পেরেছে যে সরকারি অবহেলায় আমরা দিনে দিনে দুষিত বায়ুমণ্ডলের গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছি?    
অশ্মী প্রধানমন্ত্রীকে দুটি মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছে। প্রথমটি হলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের আইন আরও গুরুত্বের সঙ্গে লাগু করা দরকার এবং দ্বিতীয়টি হলো বায়ু দূষণের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কমাতে ভারতের নাগরিকদের সচেতনতার করা দরকার। এই কয়েকটি নীতি মানতে পারলে আমাদের দেশ স্বাস্থ্যকর এবং বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। অশ্মীর এই চিঠির পর লক্ষ লক্ষ কিশোর কিশোরী এই একই দাবিতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিতে থাকে। এর কারণ অশ্মীর মতো লক্ষ লক্ষ কিশোর কিশোরী এই সময়ে ধুলোর অ্যা লার্জির কারণে  শ্বাস কষ্টে ভুগছে। 
দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন শিথিল করেছে মোদী সরকার 
যে কারণে আরও কঠোর দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের কথা অশ্মীরা বলছে তারা সম্ভবত জানে যে  ২০২০ সালে দেশের পরিবেশ রক্ষা আইন (১৯৮৬)-র ক্ষতিকর পরিবর্তন  ঘটায়। ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পর দেশজুড়ে দাবি ওঠে এক পরিবেশ রক্ষা আইনের। ১৯৮৬ সালে যে আইন তৈরি হয় তাতে কোনও কারখানা, খনি এমনকি শহর এলাকায় নির্মাণ কাজ, বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির জন্য বায়ু, জল, মৃত্তিকা, অরণ্য ইত্যাদির যৎসামান্য ক্ষতি করে কিভাবে করা যায় তার নির্দিষ্ট কিছু আইনি ব্যবস্থা করা হয়। ঠিক হয় যে এই সমস্ত ক্ষেত্রে এনভাইরনমেন্ট ইমপ্যাক্ট আসেসমেন্ট (EIA) করতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে এনভাইরনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান (EMP)। এই আইনে অনেক ফাঁক ফোকর থাকার কারণে ২০০৬ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে দূষণ নিয়ন্ত্রণকে আরও কড়া-কড়ি করতে নতুন ইআইএ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।  ২০২০ সালে, আমরা যখন কোভিডের ভয়ে গৃহবন্দি, কেন্দ্রীয় সরকার তখন এই বিজ্ঞপ্তির আমূল পরিবর্তন করে। হাজার প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেই সর্বনাশী আইন পরিবর্তন থেকে বিরত থাকেনি সরকার। এই বিজ্ঞপ্তিতে আমাদের অরণ্য, নদী, জলাশয় ইত্যাদি থেকে যথেচ্ছ সম্পদ সংগ্রহ করার এমন কিছু ব্যবস্থা রাখা হয় যে দূষণের অনেকগুলি পথ উন্মুক্ত হয়য়ে যায়। যে কোনও নির্মানের ক্ষেত্রে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে সেই ক্ষতিগুলি পূরণ করার দায়বদ্ধতা থেকে কর্পোরেটদের বেশ কিছু ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২০২৩-এ অরণ্য সংরক্ষণ আইন ১৯৮০-র যে পরিবর্তন করা হয় তাতে আমাদের দেশের জৈববৈচিত্র এবং মূল্যবান বাস্তুতন্ত্রগুলি অবক্ষয়ের দিকে চলে যাবে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এই সমস্ত নীতিগত পরিবর্তন বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথে যুক্ত হয়ে দূষণের পরিমাণ দ্রুত হারে বৃদ্ধি করবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।  
বায়ুদূষণের হালচাল        
দুঃখজনকভাবে, যখন অনেক দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO)-র বায়ুদূষণের বিভিন্ন সূচকগুলি মেনে চলার চেষ্টা করছে তখন  ভারত সরকার  2009 সালে সর্বশেষ সংশোধিত ন্যাশনাল অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড (NAAQS)-এর কোনও সংশোধন করেনি। ফলে দেশের বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি হলে সরকার তাকে স্বাভাবিক বলে মনে করছে।

২০২১ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ুদূষণের বিভিন্ন সূচক সংশোধন করে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। বায়ু দূষণের গুরুতর স্বাস্থ্যগত প্রভাবকে মাথায় রেখে  বিভিন্ন গবেষণার মধ্যদিয়ে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে এই সূচকগুলি তৈরি করা হয় এবং দেশগুলিকে পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে কোনও উন্নয়নমূলক কাজে যে দূষিত গ্যাস বা ধূলিকণা নির্গমন হবে সেগুলিকে নির্দিস্ট প্রযুক্তির মধ্যদিয়ে কমিয়ে ফেলা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মানলে কর্পরেটদের উন্নত এবং পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং এর ফলে মুনাফা কম হবে এই আশঙ্কায় ২০০৯-এর সূচক এখনও অপরিবর্তিত।       
গত ২০২৩-এর ৯ মার্চ দা টেলিগ্রাফ-এর খবর বলছে যে গত ডিসেম্বরে কলকাতাতর  গড় পিএম ২.৫-এর সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ১৫১ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ নির্ধারিত জাতীয় মানের তুলনায় অনেকটা বেশি। গত বছর কলকাতার শীতের মোট ১৫১ দিনের মধ্যে ২৬ দিনের AQI ছিল অত্যন্ত খারাপ, ৩৮ দিন ছিল খারাপ অর্থাৎ মোট ৬৪ দিনে কলকাতার বায়ুমণ্ডল ছিল মানুষের, অন্যান্য প্রাণীর এবং এমনকি উদ্ভিদ জগতের জন্য অত্যন্ত দূষিত। গত ২৬ ডিসেম্বর টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখছে যে ২৫ ডিসেম্বরে ভিক্টোরিয়া এবং ফোর্ট উইলিয়াম অর্থাৎ ময়দান এলাকায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQ) ছিল ২০১-৩০০ অর্থাৎ অত্যন্ত খারাপ। ডিসেম্বরের শুরুতে কিছু বৃষ্টিপাতের ফলে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু পরে আবার বাড়তে থাকে। 
এখানে ২০০৯ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। তখন কলকাতায় ৪-স্ট্রোক ইঞ্জিন সহ কাটা তেলের অটো রিকশা প্রচুর চলত। ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। একটি মামলার ভিত্তিতে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে এই অটো বন্ধ করে এলপিজি চালিত ২-স্ট্রোক অটোর ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে। সরকার কলকাতার কয়েক হাজার অটোর ৪-স্ট্রোক ইঞ্জিন থেকে ২-স্ট্রোক ইঞ্জিনে পরিবর্তন করার খরচ এবং এলপিজি সরবরাহের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৃণমূল পথে নামে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঘর ঘেরাও করার হুমকি দেয়। অর্থাৎ এদের পরিবেশ রক্ষার দায় আগেও ছিল না- এখনও নেই।            চেতনাহীনকে সচেতনতার দায়িত্ব!   
এবারে আসি অশ্মীর শেষ আবেদনে যেখানে সে বলেছে যে মানুষকে বায়ুদূষণ সম্পর্কিত সচেতনতার প্রয়াস সরকারকে নিতে হবে।  যাদের মধ্যে বায়ুদূষণ সম্পর্কিত চেতনার অভাব রয়েছে তাদের কাছে সচেতনতার প্রচারের দায়িত্ব পালনের আশা করা বৃথা।   
গত ২৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (NGT) ভারত সরকারের পরিবেশ, অরণ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রককে (MoEFCC) ২৫,০০০ টাকা জরিমানা করে। বায়ুদূষণ রোধ সম্পর্কিত একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি এই মন্ত্রক। আদালতের বক্তব্য ছিল বায়ুদূষণের কারণে মানসিক অবসাদ এবং মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ঘটনার বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে। ফলে পরিবেশ মন্ত্রক দূষণ রোধে  রোধে কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। মন্ত্রক এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। এই মামলা এখনও শেষ কয়নি তবে আদালত এই জরিমানার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয় যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সরকার মোটেই ভাবিত নয়।   
অশ্মীদের সারল্যের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকবে। কারণ তারা মনে করে সরকার হওয়া উচিত মানব দরদি, পরিবেশ দরদি এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষক। বর্তমানের সরকার কর্পোরেট তোষণে ব্যস্ত। এদের কাছে শিশুদের ভবিষ্যৎ এবং মানুষের স্বাস্থ্য কোনোটাই বিচার্য নয়। অশ্মীদের এই চিঠি আসলের সরকারের উপর আস্থা হারানোর এক নিদর্শন।

Comments :0

Login to leave a comment