দেব কুমার দে, বর্ধমান
শাসক দলের চাপ ছিল। চেষ্টা করেছিল যাতে মনোনয়ন দিতে না পারি আমরা। গণনার আগের দিন প্রশাসনের উপর মহলের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়াও হয় যাতে তৃণমূল সব আসনে যেতে সেই ব্যবস্থা করতে।
কিন্তু এবার আমরা দমে যাইনি। মনোনয়ন থেকে গণনা পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয় গিয়ছে কমরেডরা।
নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। নির্বাচন ঘোষণার পরপরই আমরা প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলি।
২০১৩ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী এসডিও অফিসে আমরা মনোনয়ন জমা করেছিলাম। কিন্তু ২০১৮ সালে মনোনয়ন তোলাই যায়নি তৃণমূলের সন্ত্রাসের কারণে। মনোনয়ন তুলতে গেলে আক্রান্ত হই।
বর্ধমান সদর ২ নম্বর ব্লকের মধ্যে যে পঞ্চায়ত গুলি রয়ছে তা হলো গোবিন্দপুর,বন্ডুল-২,কুড়মুন-২,নবস্থা-১,নবস্থা-২, বৈকুণ্ঠপুর-১, বৈকুণ্ঠপুর-২, বড়শুল-১, বড়শুল -২ গ্রাম পঞ্চায়েত।
এরমধ্যে নবস্থা ১ এবং ২ পঞ্চায়তে আমরা শক্তিশালী। তাই প্রথমদিকেই প্রায় ৫০০ জনের জমায়েত নিয়ে বড়শুলে বিডিও অফিসে মনোনয়ন জমা দিতে যাই। সেই সময় তৃণমূল হামলা করে যাতে আমরা মনোনয়ন জমা দিতে না পারি। কিন্তু সে হামলা কে প্রতিহত করে আমরা এগিয়ে যাই। মনোনয়ন জমা দেওয়া হয়। এবারের পঞ্চায়তে গ্রাম পঞ্চায়তে ১২১ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলে একজন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন পরবর্তী সময়। পঞ্চায়ত সমিতির ২৬ টি আসনের মধ্যে ২৫ টিতে আমরা প্রার্থী দিই। অন্যদিকে জেলা পরিষদে তিনটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই বামপন্থীরা প্রার্থী দেয়।
প্রচার পর্বে কুরমুন ২ বৈকুণ্ঠপুর ১ পঞ্চায়ত এলাকায় শাসক দলের সন্ত্রাসের কারণে সেইভাবে প্রচার করা যায়নি। তবে প্রচার হয়ছে। মানুষের কাছে যাওয়া হয়ছে। তৃণমূলের চুরির কথা মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। বাকি অঞ্চলগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন করা হয়। প্রচারে শুধু যে আমাদের দলের কর্মীরা অংশ নিয়েছিল তা নয়। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে যারা বিজেপি’র দিকে গিয়েছিলেন তারা অনেকে আমাদের প্রচারে যোগ দেয়। যা তৃণমূলের মাথাব্যথা কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বড়শুল ১ এবং ২, নবস্থা ১ এবং ২ এলাকায় বামপন্থীদের নেতৃত্বে দীপ্ত মিছিল হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রচার পর্ব মিটলেও ভোটের দিন তৃণমূল কুরমুণ ২ এবং বৈকন্ঠপুর ১ এ অশান্তি তৈরি করলেও বাকি এলাকায় তারা অশান্তি করতে পারেনি। আটটা বুথে তৃণমূল লুট করে।
গণনার আগের দিন শক্তিগড় থানার বড়বাবু আমাদের জানায় যে গণনার কেন্দ্রে যেহেতু একাত্তরটি টেবিলের ব্যবস্থা থাকবে তাই একাত্তর জনের বেশি লোক নিয়ে গণনা কেন্দ্রে ঢোকা যাবে না। প্রশাসনের সেই কথা শুনে প্রশাসনের সাথে কোনোরকম তর্কে না গিয় আমরা একাত্তর জনই গণনা কেন্দ্রে গণনার দিন যাই। কিন্তু ভিতরে ঢুকে অদ্ভুত চিত্র দেখা যায় যে, তৃণমূল ভুয়ো কার্ড ছাপিয় তাতে বিডিও’র সই নকল করে ২০০ জনের বেশি লোক গণনা কেন্দ্রের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে দিয়ছে। কখন ঢুকিয়েছে তৃণমূল ভোর বেলায় ঢুকিয়েছে। আর আমরা যখন গণনা কেন্দ্রে যাচ্ছি তখন রাস্তায় পুলিশ নাকা চেকিং করছে। তৃণমূল যখন গেছে তখন পুলিশের প্রশাসনের এই তল্লাশির কোনও তৎপরতা চোখে পড়েনি। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী সকাল সাড়ে সাতটায় যখন স্ট্রং রুম খোলা হয় তখন স্ট্রংরুমে ঢুকে দেখি যে সেখানে ভিডিও তৃণমূলের নেতা সনৎ মণ্ডল বিজেপি’র এক প্রতিনিধি এবং আমি। কিন্তু গোটা স্ট্রংরুমে কোনও সিসিটিভি দেখতে পাওয়া যায়নি। বিডিও’র কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় যে স্ট্রং রুমে সিসিটিভি নেই কেন তখন তিনি স্পষ্ট জানান যে নির্বাচন কমিশনের কোনও নির্দেশিকা নেই এই বিষয় তাই কোনও সিসিটিভি লাগানো হয়নি। মজার বিষয় বিডিও কিছু বলার আগে তৃণমূল নেতা সনৎ মণ্ডল উপযাজক হয় আমাদের বলছেন যাতে আমরা ঠিকঠাকভাবে দেখেনি যে সব ব্যালট বক্স ঠিক আছে কি না।
গণনা ঘরে ঢোকার আগে শুনতে পাই যে তৃণমূলের ওই বহিরাগতরা জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। বিডিও-কে বলি বিডিও কোনও পদক্ষেপ নিল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিক কে বলা হলো সে চুপ করে রইল কোনও কথা বলল না। বড়শুল ২ পঞ্চায়তে দশটা টেবিলের মধ্যে যখন আটটা টেবিলে আমরা এগিয়ে যাই। তখনই সিপিআই(এম)’র কাউন্টিং এজেন্টের ওপর আক্রমণ করে তৃণমূল। এখানে বলে রাখা দরকার সকাল ৮ টায় নয় সকাল সাড়ে নটায় আমাদের ঘরের গণনা শুরু হয়েছে। তৃণমূল বিধায়ক নিশিত মালিক গণনা কেন্দ্রে উপস্থিত সেই সময়।
আমাদের ওপর যখন আক্রমণ হয়ছে তখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন আমরা বলে এসেছি যে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তৃণমূলের দল দাস কিন্তু গণনা কেন্দ্রে যে দৃশ্য আমি নিজের চোখে দেখেছি তাতে বলতে হয় যে হ্যাঁ তৃণমূল বিজেপি’র সেটিং দিনের আলোর মতন স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা কর্মী তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীকে সাহায্য করেছে সিপিআই(এম) কর্মীদের ওপর আক্রমণ চালাতে। দরজার বন্ধ করে যখন আমাদের এক কাউন্টিং এজেন্টকে মারধর করা হচ্ছে তখন সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। উলটে সেই দরজা খুলে তৃণমূলের কর্মীদের তিনি বাইরে নিয়ে আসছেন। একটা ঘরে অশান্তি শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাকি ঘরগুলিতে অশান্তি শুরু হয় যায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই ভূমিকা নিয়ে বিজেপি নিচু তলার কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়ছে। বর্ধমান উত্তরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র প্রার্থী রাধাকান্ত রায় সে নিজেও এই বিষয় কর্মীদের খুব সামলাতে পারেননি।
উল্লেখ্য, তৃণমূলের সন্ত্রাসের কারণে গোটা সময় গণনা কেন্দ্রে থাকতে না পারলেও যতক্ষণ আমরা থেকেছি যতক্ষণ আমাদের চোখের সামনে গণনা হয়েছে তার মধ্যে দেখা গেছে সংখ্যালঘু আদিবাসী এলাকা গুলোতে বামপন্থীদের সমর্থন বেড়েছে। বিজেপি তৃণমূলের প্রতি মানুষের সমর্থন কমেছে। বরশুল ২ গ্রাম পঞ্চায়তের ১১৪ নম্বর বুথ আগা গোড়া তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। সেই বুথে তৃণমূলের ভোট কমেছে। ২০১৮ তোদের যে ভোট ছিল তার থেকে প্রায় ৪০টা ভোট ওদের কমে গিয়েছে। অন্যদিকে কালিনগর যা আদিবাসী অঞ্চল বামন পাড়া যা দুলে অঞ্চল সেই জায়গায় জয়ী হয়ছে সিপিআই(এম)।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে কালিনগর বুথে সিপিআই(এম)’র ভোট ছিল ২০০ বিজেপি’র ২৩২ তৃণমূলের ১৬০ এবার সিপিআই(এম) ২৩৬ বিজেপি ১৫৬ টিএম তৃণমূল ১৪০। পশ্চিম কোড়া পাড়ায় আদিবাসী এলাকায় ভোট বেড়েছে সিপিআই(এম)’র।
সবশেষে একটাই বলার মনোনয়ন পর্ব থেকে গণনা পর্ব মানুষ দেখেছে তৃণমূল কিভাবে গায়ের জোরে সবকিছু দখলে রাখবো দখল করবো এই মনোভাব নিয়ে চলেছে তৃণমূল। গায়র জোরে পঞ্চায়েত দখল করলেও মানুষ জানে তারা তৃণমূলকে ভোট দেননি। তৃণমূল গায়ের জোরে পঞ্চায়ত দখল করেছে। তাই মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়ছে। আর মানুষ এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করছেন।
উল্লেখ্য, প্রশাসনের উপর মহলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী আধিকারিকদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে যে কোনও মূল্যে তৃণমূলকে ন’টি পঞ্চায়েতে জেতাতে হবে।
Comments :0