তাপস দাস
রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে এই নিয়ে পাঁচটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশ নিলাম। এগারো সালের পরিবর্তনের পরে তিনটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যে এবারের অভিজ্ঞতা বিরলতম। এতটাই ভয়ঙ্কর এবারের অভিজ্ঞতা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখাই কঠিন হয়ে উঠেছে।
ভোট গণনার দিন সকাল আটটার মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের গণনায়, উত্তর দিনাজপুর, করণদিঘি হাই স্কুলে গণনা কেন্দ্রে আমাদের কাউন্টিং এজেন্টরা প্রবেশ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা জানতে পারি অন্য কোনও জনপ্রতিনিধিকে প্রবেশ করতে না দিলেও তৃণমূল বিধায়ক গৌতম পাল প্রচুর সংখ্যায় বহিরাগত নিয়ে গণনা কেন্দ্রে বসে আছে। এবং বিডিও-কে নিয়ে যৌথভাবে গণনা পরিচালনা করছে। পুরো ব্যবস্থাকে কবজা করে বিধায়ক নিজের ইচ্ছে মতো বিরোধী দলের বিজয়ী প্রার্থীদের পুনর্গণনার নাম করে জোর করে পরাজিত করছে। বাম কংগ্রেসের অন্তত পঁচিশটির মতো আসনে পুনর্গণনা করে পরাজিত করা হয়েছে গণনা প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার এক দেড় ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা পরে পরাজিত তৃণমূল দলের প্রার্থীদের ডেকে আনা হয়। স্ট্রং রুমে ব্যালট বক্সে বিরোধীদের ব্যালটে অতিরিক্ত ছাপ দিয়ে ভোট বাতিল করে গণনা টেবিলে আনা হয়। এবং জোর করে তৃণমূল দলের প্রার্থীদের জেতানো হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তিন-চার বার পুনর্গণনার করে হারানো হয়েছে। আমাদের জোট ও অন্যান্য বিরোধী দলের কাউন্টিং এজেন্টরা ভিতরে অসহায় হয়ে পড়েন। আমরা ভিতরে নির্দেশ পাঠাই টেবিল থেকে বাক্স চলে যাওয়ার পরে এজেন্টরা যেন কোনও মতেই পুনর্গণনার অংশ না নেন। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে আমরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে গণনা কেন্দ্রে দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। উদ্দেশ্য বিধায়ক গৌতম পাল ও তার সাথে গুন্ডা, বহিরাগতদের গণনা কেন্দ্র থেকে বের করতে হবে। কিন্তু গণনা কেন্দ্রের দিকে যেতেই রাজ্য পুলিশ কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করে। ভিতরে তখন বিধায়ক, কংগ্রেসের জেলা পরিষদ প্রার্থীকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যেমন করেই হোক গণনা কেন্দ্রের ভিতরেই মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের দলের জেলা পরিষদ আসনের তিন প্রার্থী ও তাদের ইলেকশন এজেন্টরা কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকদের কাছে যান এবং সবটা বুঝিয়ে বলার পরে কেন্দ্রীয় বাহিনী ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দেন। গণনা কেন্দ্রের ভিতরে জেলা পরিষদের প্রার্থী এবং অন্য এজেন্টরা জোরালো প্রতিবাদ করেন। দুই বিজয়ী মহিলা প্রার্থী জয়েন্ট বিডিও-কে টেনে বের করে নিয়ে আসেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী বিধায়ক ও তার স্ত্রীর মোবাইল কেড়ে নিয়ে একটি ঘরে বন্ধ করে দেয়। এতক্ষণ পর্যন্ত প্রথম রাউন্ডে বিরোধী দলের বিজয়ী প্রার্থীদের বন্ধ থাকার পরে, প্রায় ছয় সাত ঘণ্টা পরে শংসাপত্র দেওয়া হয়। এক দুই ঘণ্টা পরে বিধায়ক, বিডিও দ্বিতীয় রাউন্ডের বিরোধী দলের বিজয়ী প্রার্থীদের আবার পুনর্গণনা করে পরাজিত করার চেষ্টা করে। পার্টি অফিস থেকে আমরা ফোনে বিডিও-কে জানাই অন্যায়ভাবে পুনর্গণনার করে প্রার্থীদের হারানো হলে বিডিও সহ বাকি আধিকারিকদের কোর্টে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং গণনা কেন্দ্রের বাইরে এলেই তাদের জনরোষের মুখে পড়তে হবে। অনিয়ন্ত্রিত জনতা যদি সহিংস হয়ে ওঠে, তার দায় একমাত্র বিডিও’র। বিডিও চাপে পড়ে যান। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডের বিজয়ী প্রার্থীদের শংসা পত্র দেওয়া হয়। রাত্রি একটা নাগাদ পঞ্চায়েত সমিতি গণনায় করণদিঘি পঞ্চায়েত সমিতির বর্তমান বোর্ডের সভাপতি আমাদের প্রার্থী ফিরোজা খাতুনের কাছে ষোলো ভোটে পরাজিত হয়। বিডিও, বিধায়ক, পুলিশ কেউ এই পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। আমাদের প্রার্থীর ইলেকশন এজেন্ট বরজাহান আলম (এরিয়া কমিটির সদস্য এবং প্রার্থীর স্বামী) সহ দশজন এজেন্ট বিডিও, পুলিশ প্রশাসনের সাথে লড়তে থাকেন। তৃণমূলের এজেন্ট ও গুন্ডাদের পরিষ্কার বলা হয় যে, এখানে গুন্ডামি করলেও, তাদেরও কিন্তু বাড়ি যেতে হবে। গ্রামে থাকতে হবে। বিডিও বারবার পুনর্গণনার কথা বলতে থাকেন। আমরা কোনও মতেই রাজি হইনি। বক্স স্ট্রং রুমে যাওয়ার দুই তিন ঘণ্টা পরে রিকাউন্ট কিছুতেই মানা সম্ভব নয়। হয় শংসাপত্র দিতে হবে, না হয় বিডিও -কে লিখিত দিতে,হবে আমাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছে।
বিডিও-কে আমাদের এরিয়া সম্পাদক প্রায় একশো বারের মতো ফোনে অনুরোধ, আবেদন করেছেন। কৌশল নিয়েছেন। বিধায়ক চাইছিলেন আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি। তাহলেই প্রশাসন লাঠিচার্জ করে আমাদের সরিয়ে দিয়ে শংসাপত্র পরাজিত প্রার্থীকে দিয়ে দেবে। বাইরে প্রায় হাজার খানেক পার্টি সমর্থক জেলা নেতৃত্ব ও এরিয়া কমিটির সম্পাদকের প্রতি অসংযত ব্যবহার করেছে। প্রায় একমাস টানা লড়াইয়ের পরে অন্যায়ভাবে এই পরাজয় মেনে নিতে পারছিলেন না। তাদের একটাই প্রশ্ন কেন আমরা রাস্তা অবরোধ করছি না? কেন বিধায়কের মত আমাদের নেতৃত্ব ভিতরে বসে নেই? কিছুতেই তাঁদের বোঝানো সম্ভব হচ্ছিল না। পঞ্চায়েত সমিতির অন্য চারজন বিরোধী প্রার্থীদের শংসাপত্র দিলেও, ফিরোজা খাতুনকে কিছুতেই তখন পর্যন্ত শংসাপত্র দেওয়া হয়নি। তৃণমূল তিন চারটি ছোট গাড়িতে কিছু দুষ্কৃতী নিয়ে আসে, আমাদের সংখ্যা তখন প্রায় শ'তিনেক হবে। আমরা আবার ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করি। কেন্দ্রীয় বাহিনী ফিরিয়ে দেয়। গণনা কেন্দ্রের ভিতরে বাইরে স্নায়ুর লড়াই। ভিতরে তৃণমূল আর্থিক প্রলোভন দিতে আরম্ভ করে। রাত্রি আটটার সময় আমরা বিডিও-কে ফোনে জানাই এবার বিডিও’র কোয়ার্টার অফিস, জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হবে। কোনোরকম অপ্রীতিকর অবস্থা হলে তার জন্য দায়ী একমাত্র বিডিও। এসডিও ইসলামপুরকে ফোনে আমাদের এরিয়া কমিটি সম্পাদক একই কথা জানিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত বিডিও রাত্রি আটটা দশ মিনিট নগাদ ফিরোজা খাতুনকে শংসাপত্র দেন।
এরিয়া কমিটি সম্পাদক আশিস ঘোষ ও জেলা নেতৃত্ব সুরজিৎ কর্মকার ও বরজাহান আলমের বত্রিশ ঘণ্টার অদম্য লড়াই ছাড়া সমস্ত বিজয়ী বিরোধী প্রার্থী বিশেষ করে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে জয়ী ফিরোজা খাতুন শংসাপত্র নিয়ে ফিরতে পারতেন না। এই বত্রিশ ঘণ্টায় ধৈর্য, স্নায়ু, শারীরিক, মানসিক যুদ্ধ জিততে হয়েছে। এই বত্রিশ ঘণ্টায় এমন কিছু থ্রিলারের মধ্যে আমাদের যেতে হয়েছে যা এই পরিসরে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল বিজয়ী শংসাপত্র না নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরবো না। আমরা সফল হয়েছি।
Comments :0