Kerala Ayurveda

কেরালার বৈদ্যশালা এবার শান্তিনিকেতনে

ফিচার পাতা

বিশ্বজিৎ রায় 


আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রাচীন প্রাণকেন্দ্র কেরালা। ১৯৩৩ সালে কেরালার এর্নাকুলামে সিএন নাম্বুদ্রি স্থাপন করে ধন্বন্তরী বৈদ্যশালা। কেরালায় প্রচুর ভেষজ গাছপালা আছে। এই রাজ্যের পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে ঘিরে প্রচুর ভেষজ উদ্ভিদের গাছ আছে। কেরালার এই সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। কেরালার ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসালয় ধন্বন্তরী বৈদ্যশালার সাথে যৌথ উদ্যোগে বীরভূম জেলার বোলপুর শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি হাটের পেছনে তৈরি হয়েছে পথ্যসাথী আয়ুর্বেদ। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের এই হাসপাতাল ইতিমধ্যেই মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে।
কেরালার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রচলন সুদীর্ঘকাল ধরে চলছে। পশ্চিমবঙ্গে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রচলন খুব একটা নেই। এই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের বিষয়টি রাজ্যের মানুষের কাছে এখনও খুব একটা পৌঁছায়নি। এই চিকিৎসার বিষয়ে একটা বড় অংশের মানুষের সম্যক ধারণা খুবই কম। চিকিৎসা বিজ্ঞানে গাছগাছালির একটা বড় ভূমিকা আছে। ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার আমরা ইতিহাসের পাতায় মুনি ঋষিদের কাছে জানতে পারি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের বিষয়টি আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অ্যা লোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে মানুষের একটা ধারণা আছে। কিন্তু এই দুই চিকিৎসার পাশাপাশি আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় অনেক কঠিন রোগ নিরাময় করা যে সম্ভব হয়,সেটা মানুষের চর্চায় নেই।
আয়ুর্বেদ অনুযায়ী সুস্বাস্থ্য নির্ধারণের জন্য শরীরের প্রধান তিনটি দশার ভালোভাবে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। ভাতা,পিত্ত এবং কফ এই তিনটি দশার সঠিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এই তিনটি দশার একটি অনিয়ন্ত্রণ হলে শরীরের উপর এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ে। এর ফলে শরীরে অবাঞ্ছিত অর্থাৎ টক্সিন জমা হতে পড়ে। যেটা পরবর্তীতে শরীরে বিভিন্ন অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। পঞ্চকর্ম থেরাপি দ্বারা এই তিনটি দশার নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বোলপুর শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি হাটের পিছনে পথ্যসাথি আয়ুর্বেদ কেরালার সুপ্রাচীন স্বনামধন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকেন্দ্র ধন্বন্তরী বৈদ্যশালার সাথে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে। পথ্যসাথী আয়ুর্বেদ এ প্রতিদিন বহির্বিভাগে মানুষের ডাক্তার দেখানোর সুযোগ আছে। কেরালার বিশিষ্ট আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা কেন্দ্রের ধন্বন্তরী বৈদ্যশালার ছয়জন ডাক্তার এখানে থেকে মানুষের চিকিৎসা করছেন। প্রয়োজনমতো কোনও কঠিন রোগের বিষয়ে কেরালার ধন্বন্তরী বৈদ্যশালার বিশিষ্ট ডাক্তারদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা করছেন। 
পথ্যসাথী আয়ুর্বেদ এ কি ধরনের চিকিৎসা হয়? এখানে সম্পূর্ণ আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে রোগ নিরাময় করা হয়। এখানে ত্রিশ বেডের একটি হাসপাতাল আছে। যেখানে থেকে মানুষ কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতে পারে। পথ্যসাথী আয়ুর্বেদ এ সম্পূর্ণ আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে রোগ নিরাময় করা হয়। ১৫০০-র বেশি ভেষজগুণসম্পন্ন জৈবিক উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়কারী ওষুধ তৈরি করা হয়।  প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা দুই এর সংমিশ্রণে তৈরি ওষুধগুলো বিভিন্নরুপে পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে বিনা অপারেশনে হাটুর ব্যাথা,ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, নিদ্রাহীনতা, থাইরয়েডের সমস্যা, হাঁটুব্যথা, কোমরের যন্ত্রণা,ষ্পাইনের সমস্যা, সারভাইক্যাল স্পন্ডিলাইটিস, লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস, রিউমেটিক আর্থারাইটিস, পেটের যাবতীয় সমস্যা,নার্ভের সমস্যা, অ্যালার্জি, সাইনাস, পারকিনসন সহ বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা এখানে হয়। এছাড়াও মহিলাদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এখানে হয়। এই চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রতিদিন বহির্বিভাগে বসে।  বহির্বিভাগে প্রতিদিন মানুষ চিকিৎসা করাতে আসে। বিনা অপারেশনে এই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা হয়। এখানে আয়ুর্বেদিক ওষুধের বাইরেও পঞ্চকর্ম থেরাপি, যোগব্যায়ামের মাধ্যমেও চিকিৎসা করা হয়। এখানে ওয়েলনেস থেরাপি হয়। এই থেরাপি মানুষের ছোট খাটো ব্যথা, শরীরের ক্লান্তি ও শরীরকে তরতাজা রাখতে সাহায্য করে। একধরনের ভেষজ তেল দিয়ে শরীর ম্যাসাজ করা হয়। এরপর ষ্টিম বাথ করিয়ে ঘামের মধ্য দিয়ে শরীরের বজ্য পদার্থ বের করিয়ে দেওয়া হয়। শরীর সুস্থ রাখতে এই থেরাপি খুব উপযোগী বলে কতৃপক্ষ বলেন। এখানে প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট ও যোগব্যায়ামের শিক্ষক আছে।
পঞ্চকর্ম থেরাপি আয়ুর্বেদে নতুন নয়। প্রাচীন ভারতে চরক সংহিতায় পঞ্চকর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকারক টক্সিন পদার্থ পঞ্চকর্মের দ্বারা শরীর থেকে বের করে সাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা হয়। পঞ্চকর্ম বা পাঁচটি ক্রিয়া হলো বমন, বিরেচন, ভস্তি, নস্যম, রক্তমোক্ষণ। এছাড়াও বাহ্যিক অ্যালিয়েশন পদ্ধতিতে অভয়াঙ্গ, কিজি,ধারা এই পদ্ধতিতে ভেষজগুণসম্পন্ন গাছগাছালি দ্বারা ওষুধ তেল তৈরি করে শরীরে মালিশ বা ছোট ছোট পুটুলির করে শরীরের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অংশে প্রয়োগ করা হয়। শরীরের বিভিন্ন জায়গার ব্যথা দূর হয়। স্বেদন পদ্ধতিতে ভেষজ গুণসম্পন্ন বাষ্প শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। শরীরে ঘামের মাধ্যমে টক্সিন বের হয়ে আসে।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই পথ্যসাথী আয়ুর্বেদ তৈরি হয়। গত দেড় বছরে প্রায় দুই হাজার রোগী এখানে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ বলেন। এখানে বিদেশের ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, আমেরিকা থেকেও বিদেশিরা এসে চিকিৎসা করায়। বর্তমানে একজন ফ্রান্সের নাগরিক হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন। এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা আবদুস সামাদ বলেন এই রাজ্যের মানুষের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের জন্য এই হাসপাতাল করেছি। আমি নিজে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলাম। কেরালায় গিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মাধ্যমে আমি সুস্থ আছি। তখন কেরালার ধন্বন্তরী বৈদ্যশালার সাথে কথা বলে তাদের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল করার প্রস্তাব দেই। ওরা রাজি হয়ে যায়। এই  চিকিৎসার মধ্য দিয়ে মানুষ যাতে সুস্থ থাকতে পারে সেই চিন্তা করেই এই আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল করেছি।
এই হাসপাতালে ফ্রান্স থেকে আসা প্যাসকালাইন মেরিয়েট্টি বলেন আমি ডিটোক্সিফিকেসনের চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছিলাম। আটদিন এখানে থেকে চিকিৎসা করে এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছি। বোলপুর এর বাসিন্দা অলোক প্রামানিকের ছেলে পারকিনসন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। এখানে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করে এখন নিজে থেকেই হাঁটাচলা করছে।
এই রাজ্য নয়, দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ পথ্যসাথী আয়ুর্বেদ এ চিকিৎসার জন্য আসছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment