অনিন্দ্য হাজরা
বেনজির নির্বাচনী জালিয়াতির সাক্ষী থেকেছে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। গণনা কেন্দ্রে কারচুপি না করলে শোচনীয় ফলাফল হত তৃণমূলের, সর্বত্র ছড়িয়ে এমন নমুনা। এত বাধার মধ্যেও ভোট বেড়েছে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ প্রার্থীদের। ভেঙেছে মিডিয়ার বানানো তৃণমূল-বিজেপি দ্বৈরথের ভাষ্য। একাধিক জেলার ফলাফল খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে জনতার মেজাজ।
একাধিক জেলায় দেখা যাচ্ছে বাম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সমর্থন বিধানসভার তুলনায় কিভাবে বেড়েছে।
যেমন মালদা জেলা। এই জেলায় মোট ব্লকের সংখ্যা ১৫টি। নির্বাচনের দিন বুথ দখল থেকে শুরু হওয়া কর্মকান্ড শেষ হয়েছে মাঝরাতে গণনাকেন্দ্রে ছাপ্পা দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তারপরেও জেলার ৫০ শতাংশের কাছে এলাকায়, অর্থাৎ ৭টি ব্লকে বাম কংগ্রেসের উত্থান চোখে পড়ার মতো।
জেলার হরিশচন্দ্রপুর-১, হরিশচন্দ্রপুর-২, চাঁচল-১, রতুয়া-২, কালিয়াচক-১, কালিয়াচক-২ এবং কালিয়াচক-৩ নম্বর ব্লকে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের মিলিত ভোট তৃণমূল ও বিজেপির থেকে বেশি। গণনাকেন্দ্রে কারচুপি না হলে ইংরেজবাজার, ওল্ড মালদা, রতুয়া-১’র মতো ব্লকগুলিতেও এগিয়ে থাকতেন বাম-কংগ্রেস প্রার্থীরা। এমনটাই জেলার ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য।
মালদার পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলাতেও চোখে পড়ার মতো উত্থান হয়েছে বাম-কংগ্রেসের। এই জেলায় মোট ব্লকের সংখ্যা ২৫টি। ২০২৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, এই জেলার ১২টি ব্লকে বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট তৃণমূল এবং বিজেপি’র তুলনায় বেশি। ব্লকগুলি হল- ফারাক্কা, সামশেরগঞ্জ, সুতি-১, লালগোলা, ভগবানগোলা-১, ভগবানগোলা-২, রানীনগর-১, রানীনগর-২, ডোমকল, ভরতপুর-১, নওদা এবং জলঙ্গী।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলায় বাম এবং কংগ্রেস একটিও বিধানসভা আসন জিততে পারেনি। কিন্তু তার মাত্র ২ বছরের মাথায় কার্যত জেলার জনমতকে নিজেদের দিকে ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে।
সাগরদিঘি উপনির্বাচন থেকেই এই প্রবণতা স্পষ্ট। সেই রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চাপা দিতেই ঢালাও সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল।
উত্তর দিনাজপুর জেলাজুড়েও তীব্র সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল। চোপড়া ব্লকে মনোনয়ন জমা দেওয়ার মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান সিপিআই(এম) কর্মী। চোপড়া ব্লকে মনোনয়ন দিতে পারেননি বিরোধীরা। চোপড়ায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হলে কি হতে পারত, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে পার্শ্ববর্তী ইসলামপুর। এই ব্লকে একটি জেলা পরিষদ আসন জিতেছে কংগ্রেস। ব্লকের বাকি ২টি জেলা পরিষদ আসনের ফলাফলে স্পষ্ট গণনা কারচুপির চিহ্ন।
একইভাবে জেলার গোয়ালপোখর-১ ব্লকে ৩টির মধ্যে ২টি জেলা পরিষদ আসন জিতেছে কংগ্রেস।
এই জেলার গোয়ালপোখর-২, করনদিঘি, রায়গঞ্জ এবং ইটাহার ব্লকেও ২০২১ সালের তুলনায় ভোট বাড়াতে পেরেছে বাম-কংগ্রেস।
বাম কংগ্রেসের ভোটবৃদ্ধি স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়েছে নদীয়া জেলাতেও। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে তেহট্ট এবং কৃষ্ণনগর সদর মহকুমায়। করিমপুর-২ ব্লকে তৃণমূল পেয়েছে ৫২,৭১৯ ভোট। সেখানে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেসের মিলিত ভোট ৪২,৫৮৭। বিজেপি পেয়েছে ২৭,২৪৮ ভোট।
তেহট্ট -২ নম্বর ব্লকে তৃণমূল পেয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ভোট। বাম কংগ্রেসের ভোট যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে ৩২ হাজার। বিজেপি পেয়েছে ২৩ হাজার ভোট। একইভাবে নাকাশিপাড়া ব্লকে তৃণমূল পেয়েছে ১ লক্ষ ২১ হাজারের কিছু বেশি ভোট। এখানে বাম কংগ্রেসের মিলিত ভোটের পরিমাণ ৬২ হাজার ৪০৮। বিজেপি পেয়েছে ৬১ হাজার ভোট।
নদীয়ার কালীগঞ্জ ব্লকে তৃণমূল পেয়েছে ৯৮ হাজার ভোট। সেখানে বাম-কংগ্রেস ভোট দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫১৫’তে। বিজেপির প্রাপ্তি ৪০ হাজারের কিছু বেশি। জেলার চাপড়া ব্লকে তৃণমূল পেয়েছে প্রায় ৯৩ হাজার ভোট। বাম কংগ্রেস পেয়েছে ৬৫ হাজার ৩৪৫ ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৩৩ হাজার ১৫৮।
কৃষ্ণনগর-২ নম্বর ব্লকে তৃণমূল পেয়েছে ৩৬ হাজার ভোট। বাম কংগ্রেসের প্রাপ্তি ৩১ হাজার ৩০২। বিজেপি পেয়েছে ২৫,৬৪৫ ভোট। আর নবদ্বীপ ব্লকে তৃণমূলের ৪৭ হাজার ভোটের উল্টোদিকে বাম কংগ্রেসের ভোট প্রাপ্তি সাড়ে ২৪ হাজার। বিজেপি পেয়েছে ২২ হাজারের কিছু বেশি ভোট।
অর্থাৎ এত জল মেশানোর পরেও কৃষ্ণনগর লোকসভা এলাকায় বাম কংগ্রেসের ভোটের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ছুঁইছুঁই। ২০১৯ সালে এই লোকসভায় বাম কংগ্রেসের মিলিত ভোট ছিল দেড় লক্ষের কিছু বেশি। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র ৬ লক্ষ ১৪ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। বিজেপির কল্যাণ চৌবে পেয়েছিলেন ৫ লক্ষ ৫১ হাজার ভোট।
এই ‘ফেনোমেনা’ বীরভূমের নলহাটি-২ ব্লকেও চোখে পড়েছে। ব্লকের ২টির মধ্যে ১টি জেলা পরিষদ আসন জিতেছে কংগ্রেস। অপর আসনে সিপিআই(এম) পরাজিত হয়েছে ২ হাজারের কিছু কম ভোটে। ব্লকে বাম কংগ্রেস তৃণমূল-বিজেপির থেকে বেশই ভোট পেয়েছে।
বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমার ৮টি ব্লকেই বাম কংগ্রেসের এই ঘুরে দাঁড়ানো পরিষ্কার নজর কেড়েছে।
একইভাবে হুগলীর পান্ডুয়া ব্লকে বাম কংগ্রেসের মিলিত ভোট ৬০ হাজার ছুঁয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই ব্লক নিয়ে গঠিত পান্ডুয়া বিধানসভা আসনে সিপিআই(এম) প্রার্থী পেয়েছিলেন ৪১ হাজার ভোট। বিজেপির প্রাপ্তি ছিল ৭১ হাজার ভোট। সেটা পঞ্চায়েতে কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারের ঘরে। জেলার বাকি আসনগুলিতেও ২০২১’র তুলনায় ভোট বেড়েছে।
Comments :0