Movement and Friendship

বিচার চেয়ে রাস্তার লড়াই মিলিয়েছে নতুন বন্ধুকে

রাজ্য

অরিজিৎ মণ্ডল

আরজি করের ঘটনার পর কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। আন্দোলন ও এগিয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের অভিমুখ কোনো ব্যাকরণ মেনে এগোয়নি। 
স্কুলের ক্লাস ৮-৯ এর ছাত্রছাত্রী থেকে খেলার মাঠকেও কাছে টেনেছে এই আন্দোলন। গ্রামের গৃহবধূ থেকে সল্টলেকের আইটি হবে চাকরিরত তরুণীকেও দেখা গেছে মিছিলে। আগে মিছিল মানুষকে খুঁজত, এই সময় কালে মানুষ মিছিল খুঁজেছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু কিছুই মানে না আন্দোলন। আন্দোলনের আর্কাইভ ঘাটলে এই সারমর্মই আমরা খুঁজে পাব। 
৯ আগস্টের পর আন্দোলন সমানে ছড়িয়েছে। আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা আন্দোলন শুরু করেন।  যুক্ত হন অন্যান্য মেডিক্যালে কলেজের ছাত্ররা। প্রথম থেকেই পাশে থেকেছেন সিনিয়র চিকিৎসকরা। ১৪ আগস্টের রাত দখলের পর পুলিশ নানা ভাবে আন্দোলনের নামা জনতাকে সমন পাঠিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি কিছুই। বরং শক্ত হয়েছে পায়ের তলার মাটি। মানুষ একাত্ম হয়েছেন। খুন, তা ঢাকতে শীর্ষ স্তরের চাপ, শাসানি সংস্কৃতি, দুর্নীতির যোগ ধরা পড়েছে জনতার‌ দরবারে। 
আন্দোলনের যাঁরা এসেছেন, যোগ দিয়েছেন সমাজের কথা মাথায় রেখে। 
এই সময় কালে শুধুমাত্র মিছিলে হাঁটার জন্য অনেক খেসারত দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কোনও দিনও থানায় পা না দেওয়া মা-কে কোর্টে চক্কর কাটতে হয়েছে ছেলের জন্য। ছেলের অপরাধ ১৪ তারিখ রাত দখলের মিছিলে হাঁটা। কোর্টে এসেই পরিচয় হয়েছে তাঁরই ছেলের বয়সী একজনের সঙ্গে, তাঁরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই ওই রাত দখলের মিছিলে হেঁটেছেন। স্ত্রীকে সমন পাঠিয়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরপর থেকে এই দুটো পরিবার যুক্ত হয়ে গিয়েছে আন্দোলনে। 
মদনমোহন দাস। রিসার্চ করছেন যাদবপুর বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে। বাড়ি কলকাতার কালিকাপুরে। গত ২ বছর ধরে গবেষণা করছেন। শেষ হতে এখনো প্রায় বছর ৩ বাকি। প্রথমে পথের দাবি ও রাত দখলে অংশ নেন পরবর্তীতে  জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তৈরি হয় অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব। একের পর এক কর্মসূচি আন্দোলনে নিয়মিত আসা। সকালে গবেষণার কাজ করে ঘুমিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ধর্ণা স্থলে চলে আসা, রাত জেগে স্লোগান ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে আবার বাড়ির পথে রওনা হওয়া। মদন মোহন বলেন, "রোজ সকালে যখন বাড়ি যাই ভোরের আলো ফোটার সময় মনে হতো এই রকম স্বচ্ছ দিনের জন্যই তো রোজ রাত জাগছি।"
নাম প্রকাশে অনাগ্রহী এক মহিলা, যিনি কখনও  মিছিল বা সামাজিক সংগঠনের মিছিলেও পা মেলাননি, তিনিও এসেছেন আন্দোলনের যুক্ত হতে। দিনের পর দিন থেকেছেন সবাইকে আগলে রেখেছেন। ছোটরা তাঁর থেকে পেয়েছে স্নেহ ভালোবাসা। আবার ভুল করলে বকাও দিয়েছেন। তিনি বললেন, "এই ঘটনার পর নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমার নিজেরও মেয়ে আছে। সে বিবাহিত। সমাজের জন্য কিছু করতে পেরেছি বলে আমি মনে করি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে একটা খোলা আবহাওয়ায় বাঁচতে পারে তার জন্যই একটু চেষ্টা চালাচ্ছি।" বাড়ি সামলে কী ভাবে যুক্ত থাকছেন এই আন্দোলনে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "আগে একটু বেশি ঘুমাতাম এখন ঘুমটা একটু কম হয়। কাজের চাপ যা ছিল তাই আছে। কিন্তু এতো নতুন মানুষ জুড়ে যাচ্ছে তাদের সাথে পরিচয় হচ্ছেই এটাই একটা অভিজ্ঞতা। কেউ আমার থেকেও বড় আবার কিছু আমার চেয়ে মেয়ের বয়সী। স্নেহ ভালোবাসায় রাগে দুঃখ অভিমানে সবাইকে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছি।'' 
জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থানের দিন গুলিতে পরিচয় হয় কয়েকজনের। তাঁদের কারোর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়া কারোর বারাসাত আবার কারোর হুগলির শ্রীরামপুর বা চন্দননগর। নিজেদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপ আছে, সেখানেই যোগাযোগ থাকছে নিজেদের মধ্যে। কে কখন আসবে কত কখন থাকবে সেখানেই জানিয়ে দিচ্ছে সকলে। যদি কারোর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না তখন সোজাসুজি ফোন করে জেনে যাওয়া হচ্ছে সমস্যা। এই কথা প্রসঙ্গে উঠে এলো এই গ্রুপের এক সদস্য, বাড়ি যার ব্যারাকপুরে, বেশ কয়েক দিন ধরে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শেষে ঠিক হলো কয়েকজন মিলে তার বাড়ি যাওয়া হবে। বাড়ি গিয়ে জানা গেলো বাবার শরীর ৩ দিন ধরে খারাপ। তারপর হাসপাতালে ভর্তি থেকে বাড়ি ফেরত আনা পর্যন্ত কত জন যে ছিল জানা নেই।    
কথাটা এমন যে আন্দোলনে শুধুই যোগ আছে, কোনও ভাগ নেই।

Comments :0

Login to leave a comment