Post Editorial 16 Feb 2023

তীব্র শোষণের যাঁতাকলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা

সম্পাদকীয় বিভাগ

তীর্থঙ্কর রায়
 

ইমারতি বাড়ি থেকে, ঠিকায় কাজ, ঠেলায় করে সবজি তরিতরকারি বেচা থেকে, হকারি, নিজে অভুক্ত থেকে কাঁধে ক‍‌রে খাবার পৌঁছে সমাজের চাকা যারা ঘোরাতে সাহায্য করেন বা করছেন তাদের অধিকাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত।
পরিসংখ্যান বলছে দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাং‍‌শের বেশি মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক। গড়ে ধরলে ভারতের মাত্র গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বিশাল সংখ্যক মানুষের সামান্য আয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। সমগ্র বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অধোগতি, তার মধ্যে অন্যতম হলো শিল্প হ্রাস ও পেশার সংকট যার জেরে ধীরে ধীরে বহু বেকার যুবক তাদের পেশা বদল করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের দিকেই ঝুঁকছেন। মার্কসিস্ট পত্রিকায় ৩৮তম সংখ্যায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ক তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন নয়া উদারবাদ এমন একটা পর্যায়ে ছুঁয়েছে যেখানে বৈষম্য বাড়ছে এবং তা বিশ্বের অর্থনীতির সাথে সাথে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে মুক্ত পুঁজির বিনিময় যতটা হয়েছে শ্রমের স্বাধীন গমনাগমন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শিল্প হ্রাসের ফলে এমন পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে যা দেশকে ঔপনিবেশিক কালের মতো পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত অধ্যাপক পট্টনায়েকের রেশ ধরেই বলা যায় আমাদের দেশ ভারতবর্ষে উদারনীতির পথে নেমে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা যত বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি তার নিরিখে বাড়েনি। অর্থনীতির বিরূপ অবস্থার অজুহাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন হচ্ছে। শিল্প হ্রাসের ফলে পেশাগত ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে, লাগামছাড়াভাবে বাড়ছে বেকারত্ব। বেকারত্ব বৃদ্ধি, কাজের অভাবের জন্য শ্রমের অভাবী বিক্রি বাড়ছে। ফলে একদিকে যেমন কাজ হারিয়ে বেকারেরা সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে অসংগঠিত শ্রমিক বনে যাচ্ছেন তেমনই অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। পরিযায়ী ও ঠিকা, পরিষেবা, অস্থায়ী কর্মচারীদের কাজের নিরাপত্তা সামাজিক সুরক্ষা সংকুচিত হচ্ছে।
২০১৭ সালে ওডিশার পুরীতে অনুষ্ঠিত সিআইটিইউ-র সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে নতুন স্লোগান জন্ম নেয়। স্লোগানটি হলো ‘যাদের কাছে পৌঁছানো যায়নি, তাদের কাছে পৌঁছাও। ইংরাজি তর্জমায় ‘Reach the Unreached’ । মূলত শ্রম লুট হয়ে যাওয়া বৃহত্তর অংশের শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার লক্ষ্যেই এই ভাবনা গৃহীত হয়েছিল। মূলত অকৃষি শ্রমিকসহ প্রান্তিক এলাকা গ্রাম মফঃস্বলের শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানোর একটা লক্ষ্যমাত্রা ধরে নেওয়া হয়।


আগে শিল্পাঞ্চলই ছিল শ্রমিক-আন্দোলনের মূল ক্ষেত্র। সংগঠিত শ্রেণি আন্দোলনই ছিল মূল বিষয়। কিন্তু ক্রমশ সংগঠিত শ্রমিকদের এক ছাতার তলায় না রেখে বাইরে থেকে নিয়োগ করে বা (আউটসোর্সিং) অস্থায়ী বা ঠিকা শ্রমিকদের দিয়ে করানো শুরু হয়। এখন গৃহভিত্তিক শ্রমিকের মতো নতুন পরিচয়ে শ্রমকে বিভাজিত করে দিচ্ছে। রিকশাভ্যান, বিড়ি, নির্মাণ, মুটিয়া, টালি-ইটভাটা, দরজি, দোকান কর্মচারী, রাইসমিল, মিড-ডে-মিল, আইসিডিএস কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়নের পতাকার তলায় সংগঠিত হচ্ছেন ঠিকই তবে এখনও অকৃষি শ্রমজীবী অংশের মানুষের একটা বিরাট অংশ আছেন যাদের সংগঠিত করা প্রয়োজন। গ্রামের অকৃষি শ্রমজীবী মানুষের ৮০ থেকে ৯০% অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বড় সমস্যা তাহলে কী? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বেশকিছু খবরের স্মৃতি রোমন্থন করলেই বুঝতে সহজ হবে। ১ জানুয়ারি নাসিকে জিন্দালদের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে প্রাণ বাঁচাতে শ্রমিকরা কারখানার উঁচু শেড থেকে লাফ মারেন। সরকারি ও মালিকগোষ্ঠীর সূত্রে মাত্র ২ জন মারা গেছেন প্রচার করা হলেও সেদিনের ভয়াবহ আগুনে ১০০ জন শ্রমিকের অধিকাংশের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় মানুষজন। সমস্যাটা হলো আজকে বহু কারখানার স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের কাজের জন্য অংশত মজুরি স্থির হচ্ছে আজ। চুক্তির নাম করে শ্রমিকদের শ্রম লুট করছে মালিকেরা। অনেক ক্ষেত্রেই ট্রেড ইউনিয়নের ছাতার তলায় সংগঠিত হওয়ার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা। স্বার্থান্বেষি কর্পোরেট সংস্থা ও মালিকেরা অতিরিক্ত লাভের জন্য কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলা করছেন। জিন্দালদের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতেও একইভাবে শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকটি অবহেলা করা হয়েছিল। ২ জানুয়ারি, ২০২৩ গণশক্তি পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। ১৭ জন শ্রমিক ভর্তি হয়েছিলেন সেদিন হাসপাতালে।
এই একই রকম মনোভাব আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কিছু কর্পোরেট সংস্থা ও শিল্পপতি দেখাচ্ছেন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরের দিল্লি রোড সংলগ্ন ছাঁট লোহার কারখানায় বিস্ফোরণ হয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের বাতিল ছাঁট লোহা বা যুদ্ধাস্ত্রের শেল কাটতে গিয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান দু’জন শ্রমিক। জানা যায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক বোঝাই যুদ্ধাস্ত্রের শেল কোনভাবে ছাঁট লোহার মধ্যে ছিল। সেটা কাটতে গিয়েই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এক্ষেত্রেও চাপে পড়ে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের মুখ বন্ধ করার জন্য গুরুতর আহতদের নামী হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে। কিন্তু তাদের পরিবারবর্গ জানিয়েছেন কারখানায় কোন পিএফ, গ্র্যাচুইটি নেই, ইএসআইয়ের সুবিধে নেই। মাত্র ২৮০ টাকা রোজ মজুরিতে এরকম বিপজ্জনক কাজ হাসিমুখে করছেন শ্রমিকেরা। দিল্লি রোড সংলগ্ন কারখানাগুলির ছবি একইরকম। নাসিক ও শ্রীরামপুরের মধ্যে মিল একটাই শ্রমিকরা তাদের অধিকারের কথা বলার জন্য ইউনিয়ন করতে পারবে না। প্রতিবাদ করলেই বিনা বাক্যব্যয়ে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হবে। কারখানাগুলিতে এই বিষয়টিই একটা অঘোষিত নিয়ম হয়ে গেছে।


শুধু এইরকম কারখানার ক্ষেত্রে শোষণ আছে অন্য শিল্পের ক্ষেত্রে নেই এমনটা নয়। আমাদের দেশ তথা পশ্চিমবঙ্গের সীমাহীন বেকারি শ্রম চুরির একটা সুযোগ দিয়েছে শিল্পপতিদের। শ্রমিক মহল্লায় কান পাতলে শোনা যাবে বহু শ্রমিক অন্যত্র ঠিকায় কাজ করেন। সকালে বাসে বা গাড়িতে করে ঠিকাদারেরা অন্য জুটমিলের জন্য তাদের নিয়ে যায়। সামান্য মজুরিতে তার শ্রম বিক্রি হয়। প্রতিবাদ করা যাবে না কারণ কায়িক শ্রমের মূল্য এখন সস্তা। এখন এই অঘোষিত নিয়মে জুটমিলে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। এই ঠিকায় কাজ করা জুট শ্রমিকদের সমস্যা হলো এরা রোজ হিসেবে মজুরিভিত্তিক চুক্তিতে কাজ করে সামাজিক সুরক্ষা ইএসআইয়ের সুবিধে দিতে হয় না। যদি কোন দুর্ঘটনা হয়ও মিল মালিক দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন। চুক্তিভিত্তিক এই ঠিকা শ্রমিকদের মজুরি কম যেকোন সময় কাজ হারিয়ে যেতে পারে তাই অনেকক্ষেত্রেই এরা সংগঠিত ইউনিয়নের ছাতার তলায় আসতে ভয় পায়।
পরিষেবা ক্ষেত্র যেমন জোম্যাটো, স্যুইগি, অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের সঙ্গে যুক্ত পরিষেবা শ্রমিকদের অবস্থাও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের থেকে আলাদা নয়। তাঁদেরও চাকরির কোন স্থায়িত্ব নেই। যেকোন দিন তাদের চাকরি যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়ের যদি সামান্য দেরি হয় তাহলে অনেক সময় গ্রাহক মোবাইল অ্যাপে রেটিং কম দেন। কোম্পানি এই রেটিংকে কর্মচারীর সক্ষমতার সূচক হিসেবে চিহ্নিত করে। রেটিং কম থাকলে সেই কর্মচারী যত সচলই হোক তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় কোম্পানি।
মুটিয়াদের অবস্থান, রিকশা ও ভ্যানচালক, টালি, ইটভাটাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেরর অসংগঠিত শ্রমিকদের অবস্থান একই। সামাজিক শোষণের ধরনও একই ধরনের। হিমঘর, রেলের ইয়ার্ডের মুটিয়াদের সব থেকে বড় সমস্যা হলো মজুরির তুলনায় কায়িক শ্রমটা বেশি। সামাজিক সুরক্ষা তেমন নেই। অনেকের তো মাথার ওপর ছাদও নেই। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হন। সামাজিক সুরক্ষা নেই। টালি ইটভাটা শ্রমিকদের অধিকাংশই পরিযায়ী, এখানে অনেক শ্রমিকই অত্যন্ত কম মজুরিতে নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এদের সাথে মালিকপক্ষের ব্যবহার অনেকাংশেই অমানবিক। কিন্তু এখন সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে শহর মফঃস্বল গ্রাম প্রত্যন্ত এলাকাতেও অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ হচ্ছে ঠিকই তবে এখনও বৃহত্তর অংশের শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানো গেছে এখনও এটা বলা যাবে না। তবে প্রয়াস চলছেই।
সারা দেশের শ্রমিকদের ওপর বিশেষ করে অসংগঠিত ও পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে লকডাউন ও করোনা মহামারী। যা শ্রমিকদের সমস্যার দিকেই ঠেলে দিয়েছে। লকডাউনে লাখো লাখো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের চাকরি গিয়েছে। বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছায় হাজার হাজার কিমি পথ হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করেনি। সিআইটিইউ সহ দেশের একাধিক কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের দেশব্যাপী আন্দোলনের পরে ট্রেন চালু করতে বাধ্য হলেও ততদিনে মারা গিয়েছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক।


করোনার মহামারী লকডাউনকে ব্যবহার করে কেন্দ্রের সরকার শ্রমিক-বিরোধী শ্রম কোড এনেছে এমনকি কৃষি আইন পাশ করিয়েছে আইনসভায়। খাদ্য সম্পদ ও শ্রমিকের শ্রমের অভাবী বিক্রি করে কর্পোরেটদের মুনাফা আদায়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল। করোনা যে বিষয়টিকে আরও প্রকট করে দিয়েছে তা হলো বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির ভয়াবহ সংকটকে। বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি শ্লথ অবস্থায় রয়েছে। আইএমএফ’র গ্লোবাল ইকনমিক আউটপুট রিপোর্ট ২০২২-এ বিশ্বজুড়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমার নির্দেশ করেছে। ২০২১-এ যা ছিল ৬%, তা ২০২২-এ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেকটা কমে ৩.৭ শতাংশ। অর্থনীতির সংকটের সাথে সাথেই যে বিষয়টি নির্লজ্জভাবে বেড়েছে তা হলো বিশ্বের তাবড় ধনীদের সংখ্যার বৃদ্ধি ও চরম আর্থিক বৈষম্যের ছবি। বিশ্বের অর্থনৈতিক বৈষম্যের রিপোর্টে ভয়াবহ যে ছবি ফুটে উঠেছে তা হলো বর্তমানে বিশ্বের ৫০% গরিব মানুষের আয় ১৮২০ সালের গরিব মানুষের আয়ের তুলনায় অর্ধেক। বিশ্বের সব চাইতে ধনী ১০% মানুষের আয় সারা বিশ্বের মোট আয়ের ৫২% সেখানে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের অর্ধেকের আয় মাত্র ৮.৫%।
করোনার সঙ্গেই স্পষ্ট হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ও রা‍‌জ্যের তৃণমূল সরকারের শ্রমিকবিরোধী অবস্থানের ছবি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার উদারনীতির পক্ষে কর্পোরেটের পক্ষে তা জানাই ছিল। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের ওপর তাদের সবচেয়ে বড় আঘাত শ্রমিকদের সুরক্ষা কবচ শ্রম আইনকে সং‍‌শোধন করে চারটি অমানবিক শ্রমকোড তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। চারটি শ্রম কোডের মাধ্যমে কর্পোরেটের চাহিদায় খোলাবাজারে শ্রম বিক্রি করার মাধ্যম করে দিল। অন্য দিকে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, তাদের স্থায়িত্ব, কাজের মানবিক পরিবেশের বিষয়গুলি এড়িয়ে যাওয়া হল। ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি ৪২নং ধারায় কাজের জন্য মানবিক পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে শ্রম কোডের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কাজের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। মজুরির সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। দৈনিক মজুরির সাথে ঘণ্টা পিছু মজুরি এবং ফুরন মজুরি চালু‍‌ করার কথা বলা হয়েছে। স্থায়ী চাকরিকে টুঁটি চেপে মেরে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী চাকরির বিষয়টি পাকা করা হল। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তুলে দেওয়া হল। ধর্মঘট করতে গেলে ৬০ দিন আগে নোটিস দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত করা হল। স্থির হল ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে ১ দিনের ধর্মঘট ডাকলে ৮ দিনের বেতন কাটা যাবে। ধর্মঘট করলে বা সাহায্য করলে জেল ও জরিমানার বিষয়টি পাকা হল। ৩০০ বা তার বেশি শ্রমিক যে সংস্থায় কোম্পানি‍‌তে কাজ করে সেই সংস্থার মালিকেরা শ্রমিকদের ছাঁটাই, ক্লোজার, লকআউট, সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেবে না। শিল্পক্ষেত্রে এক অলিখিত জঙ্গলরাজকে মান্যতা দেওয়া হল। শুধু কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই নয়, রাজ্যের তৃণমূল সরকারও বিজেপির রাস্তাতেই শ্রমিকদের শোষণের নয়া নিয়ম চালু করেছে। জুটমিল মালিকদের পরোক্ষে মিল বন্ধ করাতে প্রশ্রয় দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। বিজেপির সমস্ত জনবিরোধী নীতিকে মান্যতা দিয়ে একই উপায়ে রাজ্যেও শিল্পবিরোধী অবস্থান বজায় রেখেছে তৃণমূল। রাজ্যেও লাগামছাড়া বেকারত্ব সস্তায় শ্রম বিক্রির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। যার জন্য শ্রমের মূল্য নিম্নগামী হচ্ছে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে আরও বেশি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসংগঠিত অংশের শ্রমিকেরা।
১৯৮৬ সালে সিআইটিইউ পঞ্চম সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের কানপুরে। এই সম্মেলনে বিটি রণদিভে সভাপতির ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কোনো আইনি সুবিধা নেই। এখনই যদি ট্রেড ইউনিয়ন এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের সংগ্রাম, সাহসী শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে হাত না দেয় তাহলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শক্তিশালী হবে না।


বামফ্রন্ট আমলে এমনটা ছিল না। আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট আমলে চালু ২০০১ প্রভিডেন্ট ফান্ড স্কিম, ২০০৪ সালের নির্মাণ কল্যাণ স্কিম, ১৯৭৭ ও ২০০৭-এর বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ স্কিম এবং ২০১০ সালে পরিবহণ শ্রমিক কল্যাণ স্কিম চালু করে। ধারাবাহিক ভাবে রাজ্যের বহু শ্রমিক এই আইনগুলির ফলে উপকৃতও হন। ২০১১ সা‍‌লে পালাবদলের পর সব স্কিমকেই একসাথে জুড়ে সব জট পাকিয়ে দিয়েছে। কোনো স্কিমেই শ্রমিকেরা আর্থিক সুবিধার জন্য আবেদন করেও তা পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে নির্মাণ কল্যাণ তহবিল থেকে ১৬০০ কোটি টাকা রাজ্য সরকার তাদের কোষাগারে নিয়ে গেছে আইন বিরুদ্ধভাবে। চা বাগান শ্রমিকদের নাম করে ৮৫৪ কো‍‌টি টাকা নিয়ে গেল ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিরোধিতা সত্ত্বেও।
তাই অধিকার আদায়ের লড়াই জা‍‌রি থাকবে যতদিন না অধিকার আদায় হচ্ছে। এই অসংগঠিত শ্রমজীবী অংশের মানুষরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী অংশ। কিছু লুটেরা, তছনছকারী চোর ডাকাতেরা শেষ কথা বলতে পা‍‌রে না। গোটা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের ই‍‌তিহাস বারবার প্রমাণ করেছে তাদের অধিকার তারা আদায় করেছে তাদের রক্ত ঝরানো সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। আমাদের দেশ ও রাজ্যের এই বৃহত্তম অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করে সামনের দিনে বিজেপি, তৃণমূল সহ লুটেরা কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইকে জোরদার করার শপথ আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। সমাজ পরিবর্তনের মতাদর্শে বলীয়ান হয়ে আমরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।
কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারির সমাবেশ হতে চলেছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের ১৬ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ। সারা রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে দলে দলে শ্রমিকরা যোগ দেবেন এই সমাবেশে। এই সমাবেশের পরে আরও তীব্র হবে নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে প্রচার। সিআইটিইউ, কৃষক সভা ও খেতমজুর ইউনিয়নের আহ্বানে ৫ এপ্রিল দিল্লি‍‌তে হতে চলেছে মজদুর কিষান সংঘর্ষ সমাবেশ, শাসকের নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীন ভারতবর্ষের বৃহত্তম জঙ্গি শ্রেণি সমাবেশ। ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের দায়িত্ব আগামীর প্রচার পর্ব জুড়ে প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং তাঁদেরকেও শামিল করা পালটা আক্রমণাত্মক লড়াইতে শামিল করা।

Comments :0

Login to leave a comment