ঘটনা সোমবারের। ঘটনাস্থল মহারাষ্ট্রের থানে জেলার মুম্ব্রা লোকসভা আসনের একাধিক বুথ। ভোটারদের দীর্ঘ সারি বুথের বাইরে। সেই সারি আর এগচ্ছে না। এক ঘণ্টায় গড়ে মাত্র ১১ জন ভোট দিতে পেরেছেন ওই বুথগুলিতে।
এই চিত্র শুধু মুম্ব্রার বুথেই দেখা যায়নি। মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ সহ বেশ কিছু রাজ্যে ভোট পড়েছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচন কমিশনের তরফে নিযুক্ত পোলিং অফিসাররাই ভোট পড়ার গতি কমিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছাকৃতভাবে। তাঁরা কাজ করেছেন ধীর গতিতে, ভোটার তালিকায় ভোটদাতাদের নাম মেলাতে দীর্ঘ সময় নিয়েছেন, প্রত্যেক ভোটদাতার ক্ষেত্রে অহেতুক দেরি করেছেন ইভিএম’র কন্ট্রোল ইউনিট চালু করতে— যা চালু না করা হলে ভোটদাতা ইভিএম-ও বাটন টিপতে পারেন না।
কিন্তু কেন? বিরোধীদের বক্তব্য, যেখানে বিজেপি বা তার সঙ্গীদের হারার সম্ভাবনা বেশি বা ইন্ডিয়া মঞ্চের প্রার্থীরা প্রচারে এগিয়ে ছিলেন, এমন বেশ কিছু আসনে নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের বুথে ধীর গতিতে ভোট নিতে দেখা গিয়েছে— যাতে দীর্ঘ সময় বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হওয়ায় একসময়ে বিরক্ত হয়ে ভোটার লাইন ছেড়ে ফিরে যান ভোট না দিয়েই। এভাবে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচতে ইভিএম-এ বিরোধীদের প্রতি সমর্থনকে কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পরিকল্পনা বিজেপি’র, তাতে শামিল হয়েছে নির্বাচন কমিশন।
গত সোমবার পঞ্চম দফার ভোটে বিশেষত মহারাষ্ট্রে কমিশনের আধিকারিকদের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকা দেখা গিয়েছে ব্যাপকভাবে। সেখানে কংগ্রেস, শিব সেনা (উদ্ধব) এবং এনসিপি (শারদ পাওয়ার)-র জোট মহা বিকাশ আঘাড়ি এবার প্রচারে এগিয়ে ছিল বেশ কিছু আসনে। রাজ্যে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে বিজেপি পরিবার ও দল ভাঙিয়েছে বর্ষীয়ান নেতা শারদ পাওয়ারের, আর ক্ষমতা পেতে বিজেপি’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে উদ্ধব থ্যাকারেকে ছুরি মেরেছেন একনাথ শিন্ডে— মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ক্ষোভের চোরাস্রোতে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি, এনসিপি (অজিত) ও শিব সেনা (শিন্ডে)-র জোটের প্রচার। নিশ্চিত হার বুঝেই ভোট দেওয়ার গতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমানো হয়েছে, মঙ্গলবার বলেছেন শিব সেনা (উদ্ধব)-এর নেতা সঞ্জয় রাউত। এদিন মুম্বাইয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনকে বিজেপি’র সম্প্রসারিত শাখা বলেও কটাক্ষ করেছেন। তবে তিনি এও জানিয়েছেন যে, ভোটাররাও জেদ ধরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেই বুথে ঢুকেছেন।
উত্তর প্রদেশে আবার ধীর গতিতে ভোট পরিচালনার সঙ্গে বুথের বাইরে অপেক্ষমান ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টাও করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। বিশেষত, যেসব আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার বেশি, সেখানে এই চিত্র দেখা গিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী বা রাজ্য পুলিশ এই সব হুমকি বা সন্ত্রাস আটকাতে সক্রিয় হয়নি বললেই চলে, অভিযোগ করেছেন সংখ্যালঘু অংশের ভোটাররা। উপরন্তু প্রথম দুই দফার ভোটই এবার ফেলা হয়েছে শুক্রবারে এবং উত্তর প্রদেশে ওই দুই দফায় সেই সব আসনেই ভোট নেওয়া হয়েছে, যেগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার বেশি ছিলেন। বিরোধীদের বক্তব্য, এর পিছনেও অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করেছে। শুক্রবার মুসলিমদের কাছে জুম্মাবার, সেদিন তাঁরা নমাজের জন্য বিশেষভাবে ব্যস্ত থাকেন। তাই শুক্রবার তাঁরা কম সংখ্যায় ভোট দিতে আসবেন, এমন ভাবনা থেকেই বেছে বেছে সংখ্যালঘু-প্রধান আসনগুলির ভোট শুক্রবারে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল কমিশন। বিজেপি’র নির্দেশেই কমিশন এমনভাবে ভোটের সূচি সাজিয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছে বিরোধীপক্ষ।
উল্লেখ্য, ভোট পরিচালনায় কমিশনের ভূমিকা নিয়ে এবার প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষতা এবং স্বচ্ছতাকে প্রায় সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়েছে কমিশন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একের পর এক নির্বাচনী জনসভায় বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার চালালেও এবং তা নিয়ে কমিশনের কাছে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ জমা পড়লেও কমিশন কোমাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। এমনকী পাঁচ দফার ভোট হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কমিশন বুথভিত্তিক তথা আসনভিত্তিক প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। শুধু জানিয়েছে প্রদত্ত ভোটের শতকরা হার। তাতেও বিস্তর গরমিল সামনে এসেছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম কমিশনের তরফে ঘোষিত প্রদত্ত ভোটের প্রাথমিক ও চূড়ান্ত শতকরা হার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, চার দফায় যতগুলি আসনে ভোট হয়েছে, রাজ্যভিত্তিক মোট ভোটদাতার সংখ্যার নিরিখে সেগুলিতে প্রাথমিক হার থেকে চূড়ান্ত হারে প্রদত্ত ভোটের মোট সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭ লক্ষের মতো বেড়ে গিয়েছে। হিসাবের কোন গণ্ডগোলে চার দফায় মোট প্রদত্ত ভোটের চূড়ান্ত সংখ্যা এত বেড়ে গেল, না কি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনও খেলা— তা নিয়ে সংশয় ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে।
Lok Sabha Elections 2024
বেছে বেছে বিরোধীদের এগিয়ে থাকা আসনে ভোট ধীর গতিতে
×
Comments :0