আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কেলেঙ্কারির তদন্তে দি সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) শেয়ারের কারচুপির তথ্য গোপন করেছে বলে সুপ্রিম কোর্টে এবারে সরাসরি অভিযোগ দায়ের হলো। আদানি পরিবারের সঙ্গে সেবির শেয়ার কমিটির শীর্ষ আধিকারিকের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে জেনে বুঝেই সেবির এই তথ্য গোপন বলে জানানো হয়েছে।
আদানির শেয়ার কেলেঙ্কারি নিয়ে বছরের শুরুতেই তদন্তের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এনিয়ে তদন্তে সুপ্রিম কোর্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে এবং সেবিকে পৃথক তদন্ত রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দেয়। বিশেষজ্ঞ কমিটি ইতিমধ্যে রিপোর্ট পেশ করে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার লেনদেন নিয়ে ক্লিন চিট নিয়ে দায় সেরেছে। সেবি তদন্তে আদানির শেয়ার লেনদেনের বেনিয়ম নিয়ে কোনও রিপোর্ট দাখিল করতে পারেনি। সেবি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তে আদানির শেয়ার বাজারে বেআইনি লেনদেনের তথ্য জেনে বুঝে কীভাবে গোপন করেছে তা হলফনামা পেশ করে জানানো হয়েছে মামলায়। সুপ্রিম কোর্টে বিশেষজ্ঞ কমিটি ও সেবির তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়ার পরেই এই মামলা দায়ের করেছেন অনামিকা জয়সোয়াল।
প্রসঙ্গত আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার বাজারে কারচুপি ও জালিয়াতির তথ্য প্রথম ফাঁস করে দেয় আমেরিকার হিন্ডেনবার্গ। মোদী ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কারচুপির খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শেয়ার বাজারে ধস নামে, প্রায় ২০লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে উবে যায়। এতে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় পড়ে যায়। এনিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তদন্তে কোনও তথ্য প্রকাশ না হলেও চলতি মাসে ফের অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যন্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) সংস্থা আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার বাজারের কারচুপি জালিয়াতি নিয়ে আরও তথ্য প্রকাশ করে রিপোর্ট প্রকাশ করে। মামলায় দ্বিতীয় রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে জানানো হয়েছে কারচুপির তথ্য সেবির জানা থাকলেও তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তারা তা গোপন করছে। এতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিত তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে।
এদিন সিপিআই(এম) এনিয়ে বিবৃতিতে জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার বাজারে জালিয়াতি কারচুপি নিয়ে কেন্দ্র একেবারেই নীরব থেকে যাচ্ছে। একের পর এক নতুন তথ্য সামনে আসায় আমরা এনিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তদন্তের দাবি জানিয়েছি। এছাড়াও আমরা চাই সুপ্রিম কোর্টে এতে পদক্ষেপ গ্রহণ করুক যাতে কোনোভাবে সব তদন্ত ধামা চাপা না দেওয়া হয়।
এদিকে বিরোধীরা তদন্তে আদানির জালিয়াতির তথ্য যাতে গোপন করা না হয় সেদিকে নজর দেওয়ার দাবি জানালেও তা কার্যত উপেক্ষিত থাকছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিত তদন্তে সেবি যে তথ্য গোপন করেছে জয়সওয়াল হলফনামায় তা স্পষ্টই উল্লেখ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন সেবি চেয়ারপার্সন ইউ কে সিনহাকে অর্থমন্ত্রকের রাজস্ব সংক্রান্ত তদন্তকারী সংস্থা ডিরেক্টরেট অব রেভেনিউ ইনটেলিজেন্স আদানির শেয়ার বাজারের অর্থ পাচার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তদন্ত চালাতে চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে জানানো হয় আদানি গোষ্ঠীর সৌদি আরব থেকে পণ্য আমদানির অর্থ মুল্যায়নে প্রচুর বেশি করে দেখানো হয়েছে। তাতে আরও বলা হয়েছে, এই বেশি টাকা পরিমাণ হবে ৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। এই টাকা ভারত থেকে দুবাই হয়ে মরিশাসে চলে যাচ্ছে। এভাবে দেশের টাকা সরিয়ে তা মরিশাস পথে শিখণ্ডী সংস্থার মাধ্যমে আদানির শেয়ারে লগ্নি হয়। এতে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর তুলে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নেয় আদানি। সেবি প্রধান ইউ কে সিনহাকে আদানির বেআইনি অর্থ পাচার নিয়ে ২০১৪ জানুয়ারিতে চিঠি দেওয়া সত্বেও সেবি প্রধান তা নিয়ে কোন তদন্ত করেননি। এরপরেই মোদী আসে কেন্দ্রে ক্ষমতায়। ফলে আদানির শেয়ার বাজারে টাকা পাচারের ঘটনা নিয়ে কোনও তদন্ত আর হয়নি। মোদী ক্ষমতায় থাকায় তা পাকাপাকি চাপা পড়ে যায়। এই সেবি প্রধান ইউ কে সিনহাকে আজকে আদানি গোষ্ঠী তাদের কিনে নেওয়া মিডিয়া এন ডি টিভির ডিরেক্টর নিয়োগ করেছে। মামলায় বলা হয়েছে, শুধু একটি ঘটনা নয়, ডিরেক্টর অব রেভেনিউ ইন্টটেলিজেন্স মুম্বাই জোন অফিস আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার বাজারে বেআইনী লেনদেন নিয়ে আরও অনেক তথ্য সেবিকে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেবি প্রধান তা নিয়ে কোনও তদন্ত করেননি। তা চেপে গিয়েছেন। আজকে সিনহা আদানির মিডিয়া এনডিটিভির প্রধান হওয়ায় এটা স্পষ্ট এতে স্বার্থের সংঘাত থাকায় আদানির বিরুদ্ধে বেনিয়মের সরকারি তথ্য থাকা কোনও তদন্ত চালাতে চায়নি সেবি।
এদিকে সেবির বিরুদ্ধে অভিযোগ, আদানির সঙ্গে সেবি আধিকারিকের আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে সেবি তদন্তে আদানির শেয়ার বাজারে বেনিয়মের সব তথ্য গোপন করেছে। হলফনামায় বলা হয়েছে, সিরিল শ্রফ হলেন সেবির শেয়ার বাজারে ইনসাইড ট্রেডিং কমিটির সদস্য। যে কমিটি শেয়ার বাজারে কোনও বেনিয়ম আছে কিনা তা দেখার দায়িত্বে রয়েছে। এই সিরিল শ্রফ হলেন সিরিল অমরচাঁদ মঙ্গলদাসের ম্যানেজিং অংশীদার। সিরিল শ্রফের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আদানি মালিক গৌতম আদানির মেয়ের। ফলে সম্পর্কে আদানির জামাই হলেন শ্রফ। ফলে সেবির শেয়ার বাজারে বেআইনি লেনদেনের দায়িত্বে থাকা আদানির জামাই শ্রফ যে আদানির শেয়ার বাজারে লেনদেনে কোনও বেনিয়ম খুঁজে পাবেন না তা স্বাভাবিক।
সেবি এবং মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও আদানির শেয়ার বাজারে বেনিয়মের তথ্য গোপনের আরও তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালে মোদী সরকার আদানির প্রয়োজন মতো সেবির শেয়ার বাজারের বিধি নিয়মে নানা সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনের ফলে এতে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আদানি গোষ্ঠীর পাঁচটি সংস্থায় শিখণ্ডী সংস্থার মাধ্যমে অবাধে শেয়ারের লেনদেন চলতো। বিধি নিয়ম সংশোধন করায় নিয়ম মতো তার তথ্য সংরক্ষিত করা হয়নি। আদানির সব সংস্থায় এতে শেয়ার বাজারের নিয়ম ভেঙে যাবতীয় লেনদেন চলেছে। এতে বিদেশে আদানির সব শিখণ্ডী সংস্থাই লেনদেন চালিয়েছে বলেও জানা গেছে। হলফনামায় মরিশাসের দুটি সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যারা আদানির শেয়ারের প্রচুর টাকার লেনদেনে যুক্ত ছিল। সেবি তাদের রিপোর্টে এই দুই সংস্থার কোনও হদিশ দিতে পারেনি। অভিযোগ করা হয়েছে হদিশ দিতে পারেনি না, ইচ্ছা করে সেবি তাদের পরিচয় গোপন করে গেছে।
এদিকে আদানির তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিশেষজ্ঞ কমিটি গত মে মাসে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কিন্তু নির্দেশ মতো সেবি তার তদন্ত শেষ করে উঠতে পারেনি। গত মাসে তার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, তারা ২৪টি ক্ষেত্রে তদন্তে ২২টি ক্ষেত্রে তদন্ত শেষ করেছে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। উল্লেখ্য, এই দুটি ক্ষেত্র হলো সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। যেখানে আদানির শিখণ্ডী সংস্থার বেআইনি লেনদেনের তথ্য রয়েছে। সেবি কোর্টে জানাচ্ছে, যেসব বিদেশি সংস্থা (পড়ুন শিখণ্ডী সংস্থা) আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিল এবং যার জেরে শেয়ার বাজারে দর ওঠানামা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে সেই সংস্থাগুলির তথ্য জানার জন্য সেবি অপেক্ষা করছে। তথ্য জানা গেলে তার তদন্ত শেষ হবে। তারা আরও জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে সংস্থাগুলি সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। এপ্রসঙ্গে বিরোধীদের অভিযোগ, আদানির শিখণ্ডী সংস্থার জন্য সেবির অনন্তকাল অপেক্ষা চলবে। তথ্য আর প্রকাশ হবে না। পুরোটাই আদানি সেবির নিজেদের স্বার্থের বিষয়। তাই সব কারচুপি গোপন থেকে যাবে।
ADANI-SEBI
আদানির কারচুপি জেনেও গোপন করেছে সেবি
×
Comments :0