Tet

‘মরে গেলে দায়িত্ব নেব’, চিকিৎসায় না, মারে অসুস্থ চাকরিপ্রার্থী সম্পর্কে বললেন পুলিশ কর্তা

রাজ্য কলকাতা

মরে গেলে তখন আমরা দায়িত্ব নেব, বুধবার আহত চাকরিপ্রার্থীরা চিকিৎসার কাতর আবেদন জানালে এই উত্তরই দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিক। নৃশংসতার নতুন উদাহরণ কলকাতা পুলিশের!  
বুধবার পুলিশের নৃশংস অত্যাচারের পর হেয়ার ষ্ট্রিট থানায় নিয়ে আসা হয় টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের। থানায় এক চাকরিপ্রার্থীর বমি করা, অসুস্থ হয়ে পড়ার পর গুরুতর আশঙ্কা নিয়ে প্রার্থীরা হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য কাতর আরজি জানাতে গেলে প্রত্যুত্তরে হেয়ার ষ্ট্রিট থানার এক পুলিশ অফিসারকে ভিডিওতে বলতে শোনা গেছে, ‘‘ও মরে গেলে আমরা দায়িত্ব নেব।’’ তখন প্রার্থীরা বলেন, ‘‘বলছেন দায়িত্ব নেবেন?’’ ফের পুলিশকে বলতে শোনা গেলে, ‘‘আমি কথা দিচ্ছি।’’(ভিডিও’র সত্যতা গণশক্তি যাচাই করেনি)
‘‘মরে গেলে আমরা দায়িত্ব নেব’’ বলতে শোনা গেছে হেয়ার স্ট্রিট থানার অ্যাডিশনাল ওসি সচিন মণ্ডলকে। বর্তমানে হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসি ছুটিতে থাকায় তিনি ভারপ্রাপ্ত ওসি হিসাবে কাজ করছেন। থানার মধ্যে, থানার বাইরে টেট প্রার্থীদের উপর অত্যাচারের এমন একাধিক অমানবিক ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। গতকাল টেট প্রার্থীদের আন্দোলন ভেস্তে দেওয়ার নাম করে অরুণিমা পালের হাত কামড়ে দেওয়া অভিযুক্ত কনস্টেবল ইভা থাপার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে, হাতে কামড় খাওয়া প্রার্থী অরুণিমা পালকে একদিন লকআপে রেখে দেওয়া হয়। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি পুলিশ। অরুণিমা পালকে চিকিৎসা না করে কনস্টেবল ইভা থাপাকে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বর্তমানে কনস্টেবল ইভা থাপা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। প্রার্থী অরুণিমা পালকে কামড় দেওয়ার আগে প্রকাশ্যে আসা এক ভিডিও’তে দেখা গেছে, দু’জন সহযোদ্ধা প্রার্থীর সঙ্গে রাস্তার এককোণে অরুণিমা পাল দাঁড়িয়ে ছিলেন। কনস্টেবল ইভা থাপাকে দেখা গেছে, হঠাৎই সপাটে গালে থাপ্পড় মেরে অরুণিমা পালের সালোয়ারের কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কালো রঙের পোশাক পরা আরেক মহিলা কনস্টেবলও হাত লাগিয়েছেন অরুণিমা পালকে প্রিজন ভ্যানে তুলতে। প্রিজন ভ্যানের সামনে আসতেই কনস্টেবল ইভা থাপা কামড় দেয় অরুণিমা পালের বাঁ হাতে। গোল চাক্তির মতো হাতে কামড়ে দাগ রয়ে যায়। এরপর অরুণিমা পাল সহ মোট ৩০জনকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ।


আক্রান্ত প্রার্থী অরুণিমা পাল সহ মোট ৩০জনকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁদেরই বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানো, পুলিশের উপর হামলা সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার তাঁদের ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পেশ করা হয়। এদিন চাকরি প্রার্থীদের ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির করিয়ে নিজেদের হেপাজতে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। তাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে আদালত কক্ষ। চাকরি প্রার্থী অরুণিমা পালকে কামড়ানো হয়েছে বলে এদিন পুলিশ স্বীকার করে নিয়ে দাবি করে, অভিযুক্ত মহিলা পুলিশকর্মীর হাতেও কামড়ানো হয়েছে। মামলার শুনানিতে আন্দোলনকারীদের পক্ষের আইনজীবীরা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘পুলিশ যাঁদের হেপাজতে নিতে চাইছেন, তাঁরা কি মাওবাদী?’’ সরকারি আইনজীবীর পালটা যুক্তি, শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভে পুলিশের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন বলেই পুলিশ তাঁদের আটকেছে।
শুনানি চলাকালীন চাকরিপ্রার্থীদের আইনজীবী ইয়াসিন রহমান এবং অমিত হালদার কটাক্ষ করে বলেন, পুলিশ যাঁকে কামড়েছে, তিনি লক-আপে। অথচ, যিনি কামড়েছেন, তিনি হাসপাতালে ভর্তি। ইয়াসিন রহমান প্রশ্ন তোলেন, ‘‘সরকার চাকরি দিতে পারছে না। দুর্নীতি করে সকলে জেলে রয়েছেন। তারপরেও পুলিশ বলছে, চাকরিপ্রার্থীদের সংগঠনকে খুঁজে বার করতে হবে? চাকরিপ্রার্থীরা কি মাওবাদী? কোন যুক্তিতে তাঁদের পুলিশ হেপাজত চাওয়া হচ্ছে? চাকরিপ্রার্থীদের পুলিশ হেপাজত দেওয়া হলে সমাজের প্রতি অবিচার হবে।’’ পুলিশ হেপাজতের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সরকারি আইনজীবী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল বলেই পুলিশকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। পুলিশের যা কর্তব্য, পুলিশ তা-ই করেছে। শিক্ষকেরা শিক্ষকদের মতো আচরণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু নিয়মভঙ্গ হয়েছে।’’
পুলিশের এই দাবি অবশ্য মানতে রাজি নন চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য, আন্দোলনকারীরা হিংসাত্মক হয়ে উঠলে, তাঁদের হাতে লাঠি থাকত। তাঁদের কাছ থেকে কি সে রকম কোনও লাঠি পাওয়া গিয়েছে? অমিত হালদার বলেন, ‘‘কামড়াচ্ছে তো পুলিশ! রক্ষকই ভক্ষক হয়ে গিয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল। পুলিশই আক্রমণাত্মক হয়ে লাঠিচার্জ করেছে। চাকরিপ্রার্থীরা আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা তাঁদের জামিনের আবেদন করছি।’’ দুই পক্ষের সওয়াল জবাব শেষে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচারক শৌনক মুখোপাধ্যায় ধৃতদের জামিন মঞ্জুর করেন।


এদিকে গতকাল পুলিশের নারকীয় অত্যাচারের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে বলে অরুণিমা পালের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় অরুণিমা পালের পরিবার। আতঙ্কিত সত্তরোর্ধ্ব অরুণিমা পালের মা অলোকা পাল এদিন সংবাদ মাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন, ‘‘আমার মেয়ে পুলিশের কামড়ে জখম, তাকে চিকিৎসা দেওয়া হলো না। সে তো অপরাধী বা দুষ্কৃতী নয়। ন্যায্য দাবিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করতে গিয়েছিল। এরকম ঘটনা আমার জীবদ্দশাতে কখনো শুনিনি।’’ যোগ্য প্রার্থীদের চাকরির দেওয়ার দাবি জানিয়ে অলোকা পাল সংবাদ মাধ্যমের সহায়তায় মানবাধিকার কমিশন, মুখ্যমন্ত্রী এবং সমাজের সকলের কাছে পুলিশের এই আচরণের বিরোধিতার আবেদন জানিয়েছেন। পুলিশের অত্যাচারের বিভিন্ন ভিডিও এদিন সংবাদ মাধ্যমের কাছে দিয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। এক ভিডিওতে মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বাসিন্দা চাকরি প্রার্থী সাবির আহমেদকে বলতে শোনা যাচ্ছে, পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে পর পর প্রিজন ভ্যানের সামনে তিন-তিনবার তাঁকে আছাড় দিয়েছে। তাঁর হাত পুলিশ কেটে দিয়েছে। হাতে ক্ষতের ছবিও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে। 


একাধিক সংগঠন সহ সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সুভাষ মুখার্জি ও সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু  চাকরিপ্রার্থীদের উপর পুলিশের এই বর্বরোচিত আক্রমণের নিন্দা করে জানিয়েছেন, যোগ্য প্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগ করে দোষী পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

Comments :0

Login to leave a comment