শমীক ঘোষ
ভদ্রলোককে দেখতে পেয়েছিলাম আচমকাই। এসপ্ল্যানেডে, মেট্রোগলির ঠিক সামনেটায় হঠাৎই মিছিলের ঠিক মধ্যিখানে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। তারপর এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের দিকে। মাথায় ফেজ টুপি। গায়ে ঢোলা সালোয়ার। ক্লিশে বলিউড সিনেমার চর্বিতচর্বণ ‘মুসলমান’ চরিত্রের মতো এক মুখ দাড়িও ছিল তাঁর। আমাকে কিছুটা অবাক করেই হঠাৎ ডান হাতটা এগিয়ে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। সেই হাতে মুঠোভর্তি পলিথিনের জলের প্যাকেট।
আরও কয়েক পা এগোতেই দেখতে পেয়েছিলাম ভদ্রলোকের সঙ্গীদের। কান-মাথা হিজাবে ঢাকা কয়েকজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন রাস্তার পাশে। হাতে উর্দুতে লেখা প্ল্যাকার্ড। অচেনা হরফের গোলকধাঁধায় শুধু একটা শব্দই পড়তে পেরেছিলাম – রোমান হরফে লেখা ‘POLICE’।
তাঁদের ছেড়ে আরও এগিয়ে গিয়েছিল মিছিল। প্রতিবাদে মুখর হয়ে স্লোগান দিতে দিতে। হাঁটতে হাঁটতেই মাথার ভেতরে ঘুরছিল প্রশ্নটা। শহুরে, তথাকথিত ‘আলোকপ্রাপ্ত’, ‘শিক্ষিত’ আমাদের অনেকের কাছেই হিজাবও তো পুরুষতন্ত্রের প্রতীক। সেই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলা এই মিছিলের সঙ্গেই তো জলের প্যাকেট দিয়ে সংহতি জানালেন হিজাব পরা ওই ভদ্রমহিলারা। এর মধ্যে বিরোধাভাস কি নেই? নাকি, সেই সমস্ত স্ববিরোধিতা ঢেকে গিয়েছে অভয়ার ন্যায়বিচারের তীব্র দাবির কাছে?
১৪ আগস্টের রাত মনে পড়েছিল। মাত্র ক’দিন আগে আর জি করের সেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ শাসক ঘনিষ্ঠ সন্দীপ ঘোষের অপকীর্তিগুলো। তাকে আড়াল করতে চাওয়ার শাসকের নির্লজ্জ অভিসন্ধিগুলোও। এর মধ্যেই ১৪ আগস্ট রাত দখলের ডাক দিলেন মেয়েরা। যাব নাকি যাব না’র মধ্যবিত্তসুলভ দ্বান্দ্বিকতায় যখন ভুগছি, তখনই টের পেলাম আমার অদলীয়, রাজনৈতিক আলোচনায় ‘হাই তোলা’ স্ত্রী রাত দখলে যাওয়ার জন্য একা একাই তৈরি হয়ে গিয়েছে। সে একা শুধু নয়, তার সঙ্গে তার সমস্ত নারী সহকর্মীরাও।
কারণটা বুঝতেও পেরেছিলাম তাদের সঙ্গে কথা বলেই। মেয়েরা তো আর শুধু বাড়িতেই আবদ্ধ নয়। তাদের লড়াইটাতো বাইরেও। আর সেই বাইরে বেরিয়ে, পথেঘাটে, গণপরিবহণে লোলুপ পুরুষের দৃষ্টি-উক্তি-স্পর্শের সম্মুখীন হয় তারা প্রতিদিন। আর কাজের জায়গা – নতুন অর্থনীতির এই যুগে কাজের জায়গাতেই তো তাদের কাটাতে হয় দিনের বেশিভাগটাই। আর জি করে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে একজন কর্মরত ডাক্তারকে, তাঁরই কর্মক্ষেত্রে, সরকারি হাসপাতালে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায়।
আর তাঁর খুনিকেই আড়াল করার চেষ্টা চলছে শাসকের তরফে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে তাঁর খুন-ধর্ষণের মূল কারণগুলোকে, মূল পাণ্ডাদের। অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবি তাই আর দশটা মেয়েরও ব্যক্তিগত ন্যায়বিচারের দাবি হয়ে উঠেছে। আমার স্ত্রীর মতোই তারা বলতে চেয়েছেন, অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার এই ধর্ষণ-সংস্কৃতির মূল পৃষ্ঠপোষকদের জব্দ করতে হবে।
আবার ওই ১৪ আগস্টের রাতেই কিংবা ‘নয় নয় নয়’-এর পথ দখলের কর্মসূচিতেই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার পাড়ার তরুণ ছেলেটিকে। অল্পবয়সে বাবাকে হারিয়ে ছোট্ট একটা মিক্সিগ্রাইন্ডার, রান্নাঘরের চিমনি, ইন্ডাকশান কুকার সারানোর দোকান খুলেছে উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়তে পারা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটি। শাসকদলের হুমকি-সংস্কৃতির, তোলাবাজির, সিন্ডিকেট রাজকে সে প্রতিদিন সামনে থেকে দেখেছে। অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবির মধ্যে সে যেমন তার নিজের শিশুকন্যা বা স্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছে তেমনই সুযোগ পেয়েছে শাসকদলের চোখ রাঙানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
বন্ধু অনিন্দ্যসুন্দর চক্রবর্তীর লেখা সুর করা একটা গানের কলি মনে পড়ছে। গানটা প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য তাঁর সিনেমায় ব্যবহার করেছিলেন। ‘সবার কিছু দুঃখ আছে, দুঃখ আছে ব্যক্তিগত, দুঃখ ভোলার উপায় আছে, সবার আছে নিজের মতো।’ দুঃখ না রাগ? সবার কিছু রাগ আছে, রাগ আছে ব্যক্তিগত। কিন্তু শাসক তথা শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওই রাগটাই উগরে দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মানুষ।
এই আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা জুনিয়র ডাক্তাররা সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন। লালবাজার অভিযানে গিয়ে সারারাত ধরে রাস্তায় বসে থাকা, কিংবা স্বাস্থ্যভবনের সামনে তাদের অবস্থান সাধারণ মানুষকে আশা দিয়েছে। এবার অন্তত কিছু হবে। কিছুটা হলেও নিশ্চয় অবস্থার পরিবর্তন হবে। তাই আন্দোলনের প্রথম দিকে ডাক্তারদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটেছেন আম জনতাও। অভয়া আসলে প্রতিদিন প্রতিক্ষেত্রে ধর্ষণ, হুমকি, দুর্নীতি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট সংস্কৃতিরই শিকার। তাই অভয়ার ন্যায় বিচারের আন্দোলন তাদের ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভ প্রকাশের আন্দোলন হয়ে উঠেছে।
সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্যই সংবাদ-মাধ্যম এই আন্দোলনে ‘সুশীল-সমাজ’-এর মতো ‘খায় না মুখে দেয় কেউ মানে জানে না’ এমন শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে পারেনি। বরং নাগরিক সমাজের আন্দোলন বলতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তার পাশাপাশি, সংবাদ মাধ্যমের একাংশ এবং শাসকদল এই আন্দোলনকে ডাক্তারদের আন্দোলন বলে বারবার দেগে দিতেও চেয়েছে। ডাক্তাররা যে আসলে নাগরিক সমাজেরই অংশ এই কথা গুলিয়ে দিলে শেষ অবধি আসলে শাসকেরই সুবিধে। ডাক্তাররা সমাজের অগ্রগণ্য অংশ। একই কারণে ডাক্তাররা সমাজের মুষ্টিমেয় অংশও বটে। ডাক্তারি পেশার প্রতি সমাজের যেমন শ্রদ্ধা আছে, তেমনই প্রাইভেট হাসপাতাল, প্যাথোলজি ল্যাব, ওষুধ ব্যবসায়ের অপ্রতিহত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তাঁদের প্রতি চাপা ক্ষোভও আছে। এই আন্দোলনকে ডাক্তারদের আন্দোলন বলে দাগিয়ে দিতে পারলে সমাজের একটা বড় অংশকে খুব সহজেই এই আন্দোলন থেকে আলাদা করে দেওয়া যায়। আন্দোলনকে দমন করতেও তাহলে সুবিধেই হয়।
শাসক ও শাসনতন্ত্র নিয়ে মানুষের জমা ক্ষোভ ১৪ তারিখের রাতে জনপ্লাবন হয়ে আছড়ে পড়েছিল কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। তারপর আন্দোলন চলাকালীন আর জি করের অভয়ার মতোই আরও অনেক অভয়া ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হলেন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। জয়নগর অঞ্চলেই ভয়াবহতার শিকার হলেন এক শিশুকন্যা। তাঁদের কথা এই আন্দোলনের স্লোগানে এল বটে। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকটি ঘটনাকে কেন্দ্রে করে রাজপথে নামার আন্দোলনের আরও প্রসারিত হওয়ার যে স্বাভাবিক অভিমুখ তৈরি হয়েছিল তা কোথাও যেন আমরা হারিয়ে ফেললাম। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের ঘটনাগুলো আমাদের কাছে উপেক্ষিতই থেকে গেল। অথচ খাস কলকাতায় প্রতিবাদ করার যেটুকু পরিসর আছে তার সিকিভাগও নেই দূর মফস্বল বা গ্রামে। শাসকের দাঁত নখ সেখানে অনেক সহজেই চুপ করিয়ে দিতে পারে প্রতিবাদীকে।
একই সঙ্গে আন্দোলনকে অদলীয় অরাজনৈতিক রাখার একটা প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলাম আমরা কেউ কেউ। আসলে প্রতিবাদকে অদলীয় হতে হবে, এই কথাটা উত্তর আধুনিক নির্মাণ।
রাজনৈতিক দল মাত্রই ক্ষমতা দখল করতে চায়, এবং একবার ক্ষমতা দখল করলে তাদের আচরণে কোনও ফারাক থাকে না এই ধারণাই এর মূলে। কিন্তু যে কোনও রাষ্ট্র কাঠামোয় বদল আনতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক দলই। কোনও দাবি বা আন্দোলনকে ক্ষমতাসীন দলও তখনই গুরুত্ব দেবে যদি তাকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। অদলীয় অরাজনীতির রাজনীতি আসলে গণ-আন্দোলনের পরিসরকেই খর্ব করে দেয়। এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলের থেকে সমদূরত্ব নীতি রাখার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে কোথাও আন্দোলনের পরিসরই ছোট হয়ে গেল। শুধু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই আটকে থাকল। পরিস্থিতি সামলাতে শেষে জুনিয়ার ডাক্তারদের দশ দফা দাবির সঙ্গে আমজনতার স্বার্থ কতটা জড়িত তা বোঝাতেও আলাদা করে সমাজমাধ্যমে লিখতে হলো।
সবার কিছু রাগ আছে। রাগ আছে ব্যক্তিগত। ব্যক্তির সেই রাগ সমষ্টির রাগে পরিণত না হলে গণআন্দোলন সুদূরপ্রসারী হয় না। এসপ্ল্যানেডের সেই ভদ্রলোক ও তাঁর সঙ্গীরা মিছিলের সঙ্গে সংহতি জানাতে জল নিয়ে এসেছিলেন। কী আশ্চর্য তাঁদের এই সংহতিকে প্রাপ্যই ভেবে বসেছি আমি। কই মিছিল থেকে বেরিয়ে, তাঁদের দুঃখ রাগের কারণ তো জানতে যাইনি একবারও? তাহলে তিনিই বা আমার আন্দোলনকে, প্রতিবাদকে তাঁর নিজের আন্দোলন ভাববেন কেন? ভাবলেও তা কতদিন ভাববেন?
এই আন্দোলন শহুরে ‘শিক্ষিত’ ‘আলোকপ্রাপ্ত’ কোনও বিশেষ শ্রেণির আন্দোলন নয়। নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধিরও নয়। ১৪ তারিখের রাত থেকেই ছিল না। সেদিন সবাই পথে না নামলে এই আন্দোলন এত বড়ই হতো না। সেই দিন থেকেই এই আন্দোলন আসলে এই রাজ্যের আপামর জনতার। তাঁরাই এর মূল চালিকাশক্তি। তাঁরাই এর আসল ‘স্টেকহোল্ডার’। এই কথাটাই মনে রাখতে হবে আমাদের। একবার নয়। বারবার।
Comments :0