বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য
সেই ২০১১ থেকে নির্মমভাবে সিরিয়া দখলের দীর্ঘ ১৩ বছরের প্রচেষ্টা এবারে মাত্র ১৩ দিনে সফল হলো আমেরিকার, সঙ্গী ইজরায়েল ও তুরস্ক। সিরিয়ার বাথ পার্টির সরকার মানে আরব দুনিয়ার শেষ সেকুলার দলের সরকার, রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ। দীর্ঘ এক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন দিক থেকে লাগাতার হামলা ও হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে সিরিয়ার ‘সার্বভৌমত্ব’ অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, আসাদের পাশে শক্ত ঢাল হয়ে সবসময় ছিল রাশিয়া ও ইরান। কিন্তু এবারে সিরিয়ার প্রধান দুই মিত্রকে ব্যস্ত রেখে খুব দ্রুত দখলের ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলল আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যের আরও একটা দেশ তাদের কবজায় এল, আরও সম্প্রসারিত হলো বিশ্বজুড়ে মার্কিন আধিপত্য।
সামনে থেকে কাদের হাতে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন হলো ? যারা এই ঘটনা ঘটালো তারা কোনও রাজনৈতিক দল বা বিদ্রোহী আমজনতা নয়— তারা আমেরিকা, তুরস্ক, ইজরায়েল সমর্থিত সন্ত্রাসী বাহিনী। এরা কিন্তু এত দিন সশস্ত্র অবস্থায় সিরিয়াতেই ছিল, ইজরায়েল ও সিরিয়া সীমান্তের কাছেই। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়া যাকে সামনে এনে প্রায় বিপ্লবী বীরের মর্যাদা দিচ্ছে তার নাম আবু মহম্মদ আল জুলানি, যার ট্র্যাক রেকর্ড খুবই আকর্ষণীয়। জিলানি ২০০৩ থেকে ছিল আল-কায়দায়, সরাসরি ওসামা বিন লাদেনের সাথে কাজ করেছে । ২০০৬ সালে আমেরিকার হাতেই ধরা পড়ে আবু ঘ্রাইব জেলে বন্দি হয় এই জিলানি। তারপর তাকে পাঠানো হয় ইরাকে মার্কিন দখলীকৃত ক্যাম্প বুক্কায় , যেখানে ছিল আইএসএ’র প্রতিষ্ঠাতা শীর্ষ সন্ত্রাসী আবু বকর আল বাগদাদি। হিংস্র আইএস’র সৃষ্টির পেছনে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই ক্যাম্প বুক্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এক সময়ের ক্যাম্প বুক্কার বন্দি এবং পরবর্তীতে আইএস’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আবু আহমেদের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিল গার্ডিয়ান পত্রিকা। আবু আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, “যদি ইরাকে কোনও মার্কিন কারাগার না থাকত, তাহলে এখন আইএস’র কোনও অস্তিত্বই থাকত না। বুক্কা ছিল একটি কারখানা। এটি আমাদেরকে তৈরি করেছে। এটি আমাদের আদর্শ গড়ে তুলেছে।” জিলানিও এই ক্যাম্প বুক্কা থেকে তার ‘কোর্স’ কমপ্লিট করে বেরিয়ে ২০১১ তে তৈরি করে নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘জাভাত আল নুসরা’ , যারা খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকে আইএস’র সাথে । পরে আই এস কমজোরি হওয়ার পরে জিলানি তৈরি করে ‘হায়াত তাহরির আল শাম’ । এই আল শামে উজবেক ও চেচেনের মতো বিদেশি সন্ত্রাসীরাও আছে। পাখির চোখের মতো জিলানির লক্ষ্য ছিল একটাই– সিরিয়া।
২০১১ তে আরব বসন্তের ঢেউ তুলে সরাসরি আমেরিকা সিরিয়ার সরকার বিরোধী জনগণকে দিয়ে শুরু করায় আসাদ বিরোধী আন্দোলন, সেটাই মাত্র কয়েক মাসে হাতবদল হয়ে আই এস, আল নুসরা সহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে যায় একদম পরিকল্পনা মাফিকই। আসাদ সরকারকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে গোটা দুনিয়ায় একটানা প্রচার চালায় সিআইএ, যেটা এখনও চলছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিসদে সরাসরি সিরিয়ায় বিমান হামলার কথা বলে ২০১১ তে , কিন্তু তিন তিনবার রাশিয়া ও চীনের ভেটো দেবার জন্য তাদের সেই পরিকল্পনা আটকে যায়, নাহলে ২০১২-র মধ্যেই সিরিয়ার পরিণতি ইরাকের মতোই হতো। ২০১১ থেকে ২০১৬ অবধি সিরিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে আসে, একেবারে পতনের মুখে এসে যান আসাদ। ঠিক এই সময়েই রাশিয়া ও ইরান সরাসরি আসাদের সমর্থনে এগিয়ে এসে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে একেবারে কোণঠাসা করে আবার সিরিয়াকে বাঁচিয়ে তোলে। কিন্তু এবারে রাশিয়া ব্যস্ত ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে, ইরানে ব্যস্ত ইজরায়েলের একটানা একবছর ধরে হিজবুল্লা আর হামাসের ওপরে লাগাতার হামলা নিয়ে। এর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল সিরিয়া সরকারের আর্থিক সঙ্কট। আমেরিকার একাধিক নিষেধাজ্ঞার কারণে চরম আর্থিক সংকটে ছিলেন বাশার আল–আসাদ। এমনকি শেষ দিকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বেতনও দিতে পারছিলেন না। তাই সঠিক সময়ে বিনা বাধায় সিরিয়া দখলের এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হাতছাড়া করেনি ওয়াশিংটনের থিঙ্কট্যাঙ্করা।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভাবার আছে। একদল ধর্মান্ধ মানুষ বা কোনও দেশের একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি চাইলেই তো ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের’ জন্ম দিতে পারে না। একটা গোষ্ঠী চাইলেই তো অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেলের ভাণ্ডার তৈরি করতে পারে না । কারণ, শুধুমাত্র টাকা থাকলেই অটোমেটিক মেশিনগান কেনা যায় না , দোকানে বা শপিংমলে ওগুলো পাওয়া যায় না ।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সিএনএন তাদের খবরে একটি ভিডিও প্রকাশ করে দেখায় সশস্ত্র আই এস ও আল নুসরা বাহিনী টয়োটা কোম্পানির ট্রাকে করে প্যারেড করছে। একটা, দুটো নয়, দেড়শোর বেশি টয়োটা ট্রাক। এতো টয়োটা ট্রাক ওরা পেল কোত্থেকে? টয়োটার মার্কিনী মুখপাত্র এড্ ল্যুইস এবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান যে— ‘‘তাঁদের কোম্পানি কোনও আইনি স্বীকৃতি ছাড়া কাউকেই মিলিটারি ট্রাক বিক্রি করে না।’’ তাহলে কোন স্বীকৃত বাহিনী এদের জন্য ট্রাক কিনছে ? সেই উত্তর স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যায়নি ।
২০১৮-র জুন মাসে সিএনবিসি সংবাদসংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে কি পরিমাণ বিপুল মার্কিনী অস্ত্র সিরিয়ার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে । বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে তারা একটা তালিকা তৈরি করে – ১) ২৩০০ টি হামভি অস্ত্রবাহী যান , যার প্রতিটির দাম ৭০ হাজার ডলার। ২) ৪০ টিএমএ ১১ আব্রাম ট্যাঙ্ক, যার প্রতিটার দাম ৪ মিলিয়ন ডলার। ৩) ৫২ টি এম ১৯৮ হাওউতজার বন্দুক, যার প্রতিটার দাম ৫ লক্ষ ডলার। ৪) ৭৪ হাজার আর্মি মেশিনগান, যার দাম ৪ হাজার ডলার। মোট ২১৯ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র । মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে যে এই বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার তারা সরাসরি বিক্রি করেনি । সন্ত্রাসীদের হাতে তা পৌঁছেছে ‘ঘটনাচক্রে’। আদৌ কি ঘটনাচক্রে ? না কি মধ্য প্রাচ্যে ‘শত্রুদের’ বিরুদ্ধে একের পর এক ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী’দের তৈরি ও মদত দেওয়াটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঘোষিত বিদেশনীতি ।
আধুনিক বিশ্বে তথাকথিত প্রথম সন্ত্রাসবাদের গল্প তখনই প্রথম সামনে এল যখন আফগানিস্তানে তালিবান এবং পরে আল কায়েদাকে তৈরি করল রোনাল্ড রেগানের আমেরিকা। সিআইএ’র প্রাক্তন প্রধান রবার্ট গেটস তা স্বীকারও করেছেন তার বই ‘From the Shadows’ এ। আফগান ‘মুজাহিদিন’দের সাথে হোয়াইট হাউসেই দফায় দফায় বৈঠক করেন খোদ রোনাল্ড রেগান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন এদের বলতো ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’। সিআইএ নিজেই স্বীকার করেছে যে ওসামা বিন লাদেন তার কর্মজীবনের শুরুতে সিআইএ’র নির্দেশেই কাজ করতেন।
এডওয়ার্ড স্নোডেনের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, এই বাগদাদিকে বা জিলানিকে আসলে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, এরা ছাড়া পায়নি। কারণ লাদেনের পরিবর্ত হিসাবে মার্কিনী প্রভুরা এই জল্লাদদের চিনতে ভুল করেনি। লাদেনের পরে বাগদাদি আর বাগদাদির পরে জিলানি। এদের আসল ট্রেনিং হয় ইজরায়েলে । ট্রেনিং এর যৌথ দায়িত্বে ছিল মোসাদ ও সিআইএ। মার্কিন মিত্র ও ন্যাটোর সদস্যরাই ছিল আরব দুনিয়ায় এই ভুয়ো ‘আরব বসন্তের’ সাপ্লাই লাইন। অর্থ ও অস্ত্র দুটোই প্রধানত তুরস্ক হয়ে হয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় আসত। তুরস্ক কোনও রাখঢাক না রেখে সরকারিভাবেই এসব করত ।
কোনও একটি ঘটনা ঘটার পর থেকে কে বা কারা কতটা লাভবান হলো, তা দেখেই বোঝা যায় সেই ঘটনার আসল উদ্দেশ্য বা তাৎপর্য কী। সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর দেখা গেল, সিরিয়া ও ইজরায়েল সীমান্তের গোলান মালভূমি ১৯৭৪ সালের চুক্তি ভেঙ্গে ইজরায়েল সেনা দিয়ে দখল করে নিল, দখল করে নিল সিরিয়ার সরবচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট হেরমন, সেখানেও পতপত করে আজ উড়ছে ইজরায়েলি পতাকা । এখানেই ক্ষান্ত না দিয়ে লাগাতার ৫ দিন ধরে প্রায় ৫৫০ টি একতরফা হামলা চালিয়ে ইজরায়েল এখন সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে । সিরিয়ার প্রতিরক্ষার সব ক্ষেত্রগুলো ইজরায়েল প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে– বন্দর, সেনাঘাঁটি, অস্ত্রাগার, গবেষণাগার। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী – ইজরায়েল যা করছে তা ভবিষ্যতে নিজেদের সুরক্ষিত করার জন্যই। যেটা উনি বলছেন না সেটা হল আমেরিকার নির্দেশে বৃহত্তর ইজরায়েল গঠন করা হচ্ছে সিরিয়ার পশ্চিম দিকের ব্যপক অংশ বিনা বাধায় কেড়ে নিয়ে, ঠিক যেমন প্যালেস্তাইনের নব্বই ভাগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমেরিকা ও ইজরায়েলের এর পরের লক্ষ্য ইরান, বিপুল তেল সম্পদ। আসাদকে সাহায্য করার মাধ্যমে ইরান ইসরায়েল সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ সিরিয়ার বন্দরে অবস্থান করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছিল। কিন্তু আসাদের পতনের পর ওই অঞ্চলে ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই অনেক কমে আসবে।
সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি ইজরায়েলে জন্য অস্বস্তির বিষয় ছিল। ইরানি মিলিশিয়ারা শুধু সন্ত্রাসীদের কোণঠাসাই করেনি, একই সঙ্গে লেবাবনের হিজবুল্লাহদেরও সহায়তা করত। ইরান থেকে লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক সরবরাহের মূল পাইপলাইন ছিল সিরিয়া। আসাদের পতন ঘটিয়ে ইজরায়েল সফলভাবে হিজবুল্লাহর সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। জিলানির তাহরির আল–শামেরও শেষ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সিরিয়া থেকে ইরানের সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বিতাড়ন করা। ইজরায়েলেরও লক্ষ্য ছিল সিরিয়া থেকে ইরানকে বিতাড়ন করা। আমেরিকা হলো এদের দু’জনেরই প্রভু।
আমেরিকাই আফগানিস্তানে সোভিয়েতের প্রভাব মোকাবিলার জন্য গঠন করেছিল আলকায়দা ও তালিবান । এই আলকায়দা ও তালিবানকেই মার্কিনীরা পরবর্তীকালে ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও ইসলামকে সমার্থক করে তোলে আবার সেই সন্ত্রাস দমনের নামে দেশে দেশে হস্তক্ষেপ করার সুন্দর বাহানাও তারা পেয়ে যায় । সিরিয়াতে প্রথমে আইএস, আল নুসরা আর এখন নাম বদলে আল শামকে দিয়ে একই কাজ করালো আমেরিকা। এটাই আমেরিকার ঘৃণ্য বিদেশনীতি তথা দুনিয়া দখলদারির কূটনৈতিক সুত্র।
Comments :0