নিরাপত্তা বাহিনী শুক্রবার দিনভর ব্যাপক তল্লাশি চালালেও গুলমার্গে সেনার গাড়িতে হামলাকারী সন্ত্রাসবাদীদের কোনও খোঁজ পায়নি। হামলার এলাকায় নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে এদিন চিরুণি তল্লাশি চালানো হয়েছে। হেলিকপ্টার, ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে, এমনকি গুলমার্গের গণ্ডোলা পরিষেবাও কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় তল্লাশি অভিযানের জন্য। কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের কোনও খোঁজ মেলেনি। যদিও নর্দান সেনা কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম ভি সুচিন্দ্র কুমার জানিয়েছেন, সন্ত্রাসবাদের বাস্তুতন্ত্র চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেওয়ার জন্য আলোচনা করা হয়েছে। বারে বারে সেনা এবং কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও লাগাতার সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়ে চলেছে জম্মু-কাশ্মীরে। গত এক সপ্তাহে এমন হামলায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে সেনা জওয়ান, সাধারণ মানুষ, ভিন রাজ্যের শ্রমিক, কাশ্মীরের চিকিৎসক- সকলেই আছেন।
বৃহস্পতিবার বিখ্যাত পর্যটন স্থল গুলমার্গের কাছে বুটি পাথরিতে ১৮ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের গাড়িতে হামলা চালায় উগ্রপন্থীরা। সেনা সূত্রে খবর, তিন জন সন্ত্রাসবাদী এলোপাতাড়ি গুলি চালায় গাড়ি লক্ষ্য করে। হামলায় ৬ জন জওয়ান জখম হন। দুই জন মালবাহকও গুলিবিদ্ধ হন। এদের মধ্যে ২ জন সেনা জওয়ান রাইফেলম্যান কাইসার আহমদ শাহ এবং রাইফেলম্যান জীবন সিং এবং ২ জন মালবাহক মুস্তাক আহমদ চৌধুরি এবং জহূর আহমদ মীর নিহত হয়েছেন বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারিভাবে শুক্রবার জানানো হয়েছে। বাকি আহত ৩জনকে উদ্ধার করে শ্রীনগরে সেনাবাহিনীর ৯২ বেস হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এদিন সেখানে আরও এক সেনা জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে বলে কাশ্মীরের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এদিন রাত পর্যন্ত এই নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
কেন্দ্রের মোদী সরকারের নীতি জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলে এদিন মন্তব্য করেছেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। তিনি এদিন এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদীদের কাপুরুষোচিত হামলায় সেনা জওয়ান এবং মালবাহকদের মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের নীতি জম্মু-কাশ্মীরে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের সাফল্যের দাবির বিপরীতে বাস্তবতা হলো, লাগাতার সন্ত্রাসবাদী হামলার জেরে জম্মু-কাশ্মীর এখন বিপদের মধ্যে আছে। আমাদের সেনা জওয়ান এবং সাধারণ মানুষের উপর হামলা হচ্ছে।’ এদিন ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রধান এবং জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা বলেছেন, ‘যতদিন না পর্যন্ত ভারত এবং পাকিস্তান বন্ধুত্বের রাস্তা খুঁজছে ততদিন পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরে সমস্যার সমাধান হবে না।’ তিনি জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘তিরিশ বছর ধরে আমি নিরীহ মানুষের এই হত্যাকাণ্ড দেখছি।’ পাকিস্তানের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদীরা কোথা থেকে আসে সবাই জানে। আমরা তো পাকিস্তানের অংশ হবো না। ১৯৪৭ সালেই কাশ্মীর জানিয়ে দিয়েছিল যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে না। তাহলে কেন পাকিস্তান এটা করেই যাচ্ছে। কেন আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে চলেছে। পাকিস্তান নিজেকে তো ধ্বংস করছেই একই সঙ্গে আমাদেরও বরবাদ করছে।’ জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী সমস্যার সমাধানের জন্য বারে বারেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্য আলোচনার পক্ষে সওয়াল করেন ফারুক আবদুল্লা। এদিনও তিনি বলেছেন, ‘দুই পক্ষ মিলে সমাধানের রাস্তা না খুঁজলে এই ঘটনা চলতেই থাকবে।’
সিপিআই (এম) সহ জম্মু-কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলি বারে বারে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের উপরে জোর দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ দমনে বাহিনীর নিরীহ নাগরিকদের উপরে দমন পীড়ন বন্ধের কথাও বার বার বলা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিপরীতে বিজেপি উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে দেশের বাকি অংশে কাশ্মীরকে ব্যবহার করে ভোটের লাভ তুলতে এই অঞ্চলকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শুধু কাশ্মীর নয়, এখন জম্মু এবং লাদাখের মানুষও একইভাবে ক্ষুব্ধ। সন্ত্রাসবাদীরা নানাভাবে মানুষের ক্ষোভ যন্ত্রণাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে তাদের উদ্দেশ্যপূরণে। মোদী-শাহরা বারে বারেই বন্দুকের নলেই কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার হুঙ্কার দিয়েছেন। গোটা কাশ্মীরকে জেলখানা বানিয়েছেন। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বছরের পর বছর জেলে পুরে রেখেছেন সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে। এত সব করেও জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ দমন করা যায়নি। উলটে জম্মু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন এমন জায়গায় সন্ত্রাসবাদী হামলা চলছে, যা নয়ের দশকে সন্ত্রাসবাদের গুরতর সময়েও হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল কুমার সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উপরে গুরুত্বের কথা বলেছেন শুক্রবার। যুবদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী এবং মূল ধারার বিষয়ে উৎসাহিত করার কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন। এই অঞ্চলের মূল্যবান সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পুররুত্থানের বিষয়ে তাঁদের অংশগ্রহণ, মহিলা এবং যুবদের ক্ষমতায়নের কথাও বলেছেন। সব মিলিয়ে শুধু বন্দুক নয়, মানুষকে জড়িয়ে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার পন্থা নিয়ে কথা বলেছেন সেনা আধিকারিক।
Kashmir Terror
এক সপ্তাহেই ১২ মৃত্যু, সন্ত্রাসবাদ দমেনি এখনও
×
Comments :0