স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে বেআইনি বাংলাদেশি পরিযায়ী শনাক্তকরণের নামে দিল্লিতে পুলিশের অভিযানে মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। হয়রানি, এমনকি তোলাবাজিও হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমতি শাহকে লেখা চিঠিতে একথা জানালেন সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা করাত এবং পার্টির দিল্লির রাজ্য সম্পাদক অনুরাগ সাক্সেনা। বাংলাভাষী সংখ্যালঘু মানুষ, যাঁরা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক তাঁদেরকেও নানা ভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। চিঠিতে বলা হয়েছে পুলিশের এই শনাক্তকরণের এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের ভাষা ও ধর্মকে লক্ষ্য করে করা হচ্ছে। ভারতে কি এখন বাংলা ভাষা বলা অপরাধ? এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে এই চিঠিতে। একই সঙ্গে চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারতের সকল বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিককে কি অপরাধী এবং অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য করা হবে? পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ বাংলাভাষী মুসলিম। এছাড়াও, অবৈধ অভিবাসীদের নির্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম রয়েছে। দিল্লিতে শনাক্তকরণের এই পদ্ধতিগুলি এই সমস্ত নিয়মকে লঙ্ঘন করেছে। বাংলাভাষীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের কথা জানতে পেরে মঙ্গলবারই দিল্লির বাওয়ান অঞ্চলে জে জে কলোনি সহ একাধিক ঝুগ্গিতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন বৃন্দা কারাত, অনুরাগ সাক্সেনা সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ।
দিল্লির বাওয়ানা জয় হিন্দ কলোনির বাসিন্দার যে যে অভিযোগ জানিয়েছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে কথা বলায় যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাও এদিনের চিঠিতে উল্লেখ করেছেন বৃন্দা কারাত এবং অনুরাগ সাক্সেনা। তাঁরা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক দশক আগে কাজের খোঁজে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলা থেকে দিল্লিতে আসা মহম্মদ নিজামুদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সম্প্রতি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যালঘু পরিবারের যে মারাত্মক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা সবিস্তারে এই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে। অমিত শাহকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ৫ জুলাই জুলাই স্থানীয় থানার বেশি পুলিশ তাঁর বাড়িত আচমকা এসে মহম্মদ নিজামুদ্দিনের বিরুদ্ধে একজন বাংলাদেশি নাগরিককে অবৈধ কাগজপত্র জোগাড়ে সাহায্য করার অভিযোগ করে। পুলিশকে নিজামুদ্দিন জানান, ওই ব্যক্তি তাঁদের বাড়িতেই তিন বছর আগে ভাড়াটে হিসাবে থাকতেন এবং তাঁর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। এখন ওই ব্যক্তির সম্পর্কে কিছুই তিনি জানেন না। কিন্তু গত ৬ জুলাই সকাল ৬টা নাগাদ পুলিশ ফেরে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়। নিজামুদ্দিনকে হাতকড়া পরিয়ে, একজন ঘোরতর অপরাধীর মতো প্রকাশ্যে তাকে থানায় টেনে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশ থানার লকআপের মধ্যে তাঁকে মারধরও করে। এমনকি তারা তাঁকে বাংলাদেশি বলে অভিযোগ করে।
ওই দিন তাঁর ২৮ বছর মেয়ে শবনম থানায় গিয়ে ঝাড়খণ্ডে তাঁদের পরিবারের মালিকানাধীন সম্পত্তি সহ সমস্ত নথিপত্র পুলিশকে দেখায়। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে পুলিশ নিজামুদ্দিনকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। তাঁর বিরুদ্ধে একজন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনে জেরা করতে থাকে। এমনকি তাঁকে বাংলাদেশি হিসাবেও ঘোষণা করা হবে, এমন হুঁশিয়ারি দেয় পুলিশ। ওই দিন নিজামুদ্দিনের পরিবারের ১১ বছর এবং ৮ বছরের দুই শিশু সন্তান সহ সদস্যদেরও ধরে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। তাঁদের সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে পুলিশ। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা করার পর রাত ১টা নাগাদ তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরে ৮ জুলাই, সকাল ৬টা তাঁদের ফের বিজয় বিহার থানায় নিয়ে গিয়ে হেনস্তা করে পুলিশ। এমনকি নিজামুদ্দিনের পরিবারের অল্পবয়সি মেয়েদের ছবি তোলে পুলিশ। পরিবারের একাধিক সদস্যদের ছবি বারবার তোলে তারা। যদিও ওই সময় পুলিশের কোনও পদস্থ আধিকারিক থানায় ছিলেন না। কয়েকজন পুলিশ কর্মী তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে হুমকি, ভয় দেখানো ছাড়া অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু এরপর পুলিশ নিজামুদ্দিনের পরিবারের পিছু ছাড়েনি। বিভিন্ন নথিপত্র দেখার অছিলায় বিভিন্ন থানার পুলিশ তাঁদের বাড়িতে একাধিকবার চড়াও হয়। পুলিশ তাঁদের পরিবারের সমস্ত ছবি একটি একটি সাইটে আপলোড করেছে। এই কারণেই পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে।
পুলিশি হেনস্তার শিকার নিজামুদ্দিনের পরিবারের কথা জানিয়ে, অমিত শাহকে লেখা এই চিঠিতে বলা হয়েছে, আইন মেনে চলা ভারতীয় নাগরিকদের এভাবে হয়রানি করা হলো পুলিশের আইন বহির্ভূত আচরণের সুস্পষ্ট উদাহরণ। একই সঙ্গে বাড়িতে পুলিশ বারবার আসা, যাওয়ায় এই পরিবারের, বিশেষ করে তরুণীদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। নিজামুদ্দিনের ওপর যাঁরা মারধর করেছেন, তাঁদের কঠোর শাস্তির দাবিও জানানো হয়েছে এই চিঠিতে। একই সঙ্গে যে সমস্ত ছবি পুলিশের কোনও সাইটে আপলোড করা হয়ে থাকলে তা অবিলম্বে মুছে ফেলার দাবি জানানো হয়েছে এই চিঠিতে।
একই সঙ্গে বাওয়ানার সি ব্লকের ঝুগ্গির বাসিন্দা সাজান সওদাগর দাসের ওপর পুলিশের নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে এই চিঠিতে। সাজান সওদাগর দাসকে পুলিশ ৬ মে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রীতমপুরা থানার মধ্যে দু’জন পুলিশ কর্মী তাঁকে বেধড়ক মারধর করে এবং তাঁকে গালিগালাজও করে। সে বাংলাদেশী নাগরিক, একথা স্বীকার করতে পুলিশ তাঁর ওপর নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। সে হাত জোড় করে পুলিশের কাছে অনুনয় বিনয় করলেও তাতে কোনও আমল না দিয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারা হয়। মাটিতে ফেলে তাঁকে বুট দিয়ে পুলিশ লাথি মারে। পরে, এক পুলিশ অফিসার তার মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে বলেন যে সাজনকে ‘ভুল করে’ তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। সাজনের অপরাধ সে বাংলায় কথা বলে। এই ঘটনাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরও এককটি স্পষ্ট উদাহরণ।
একই সঙ্গে দিল্লি বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাভাষী নাগরিকদের ওপর বিশেষত সংখ্যালঘুদের ওপর যে ধারাবাহিকভাবে পুলিশের নির্যাতনের ঘটনা হচ্ছে তাও উল্লেখ করা হয়েছে এই চিঠিতে।
Karat's letter to Shah
পরিযায়ী হেনস্তা: অমিত শাহকে চিঠি বৃন্দা কারাতের

×
Comments :0