PAATHSHALA

এই আকালেও স্বপ্ন দেখায় এক পাঠশালার ক্লাসরুম

রাজ্য কলকাতা

PAATHSHALA পাঠশালার ক্লাসঘর।

অরূপ সেনগুপ্ত 

হ্যালো, সুমিতের মা বলছেন? আজ বাংলা ক্লাসে আপনার ছেলে আসেনি কেন? সামনে পরীক্ষা তো, তাই নিয়মিত পড়া করাটা দরকারি।

স্যার, ছেলের তো আজ জ্বর এসেছিল, তাই ক্লাসে যেতে পারেনি। কাল নিশ্চয়ই যাবে।

এটি একটি কথোপকথন। 

আর একটি ছবিতে যাই। 

কিরে, ক্লাসে ঝিমোচ্ছিস যে? ক্লান্ত বুঝি, নাকি টিফিন খাওয়া হয়নি?”

ম্যাম, ডাক্তার বলেছে অ্যানিমিয়া হয়েছে। সব সময়ে খুব ক্লান্ত লাগে। আজ স্কুল দিয়ে সোজা এসেছি। টিফিন খেয়ে আসতে পারিনি।’’

ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়। এই বিস্কুট কটা খেয়ে একটু জল খা, আয়।’’ 

না, কোনও সিনেমা কিংবা থিয়েটারের দৃশ্য-সংলাপ নয়। নয় তথাকথিত নামীদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কোট-টাই পড়া স্কুল-বাচ্চার ক্লাস-টিচারের সঙ্গে বা তার অভিভাবকের সঙ্গে কথাও। দক্ষিণ শহরতলির এক তথাকথিত কোচিং সেন্টারের সত্যি ঘটনাতাও ফ্রি কোচিং সেন্টারের।  

 

সিপিআই(এম)র দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার যাদবপুর (পূর্ব) এরিয়া কমিটি। তার উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতার সন্তোষপুর আর মুকুন্দপুরে তিনটি কেন্দ্রে চলছে ফ্রি কোচিং সেন্টার— “নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিকল্প পাঠশালা।’’ ভাবনাটা চলছিল অনেকদিন ধরেই। একেই তো গত বছর দশেকে সরকারি স্কুলগুলির পড়াশোনার মান নেমে এসেছে ভয়ানক রকমে। তার ওপরে চলেছে স্কুলগুলিই তুলে দেবার পালা। 

এই ২০২৩ সালেই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে গিয়েছে ৪ লক্ষ! রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ভর্তি করেও প্রায় ২ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেনি। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পড়ুয়ার সংখ্যা কমেছে ৬,০৮,৯৫৬ জন। আর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরেই ছাত্রসংখ্যা কমেছে প্রায় ৮ লক্ষ। প্রাইমারি, জুনিয়ার হাই আর হাই স্কুল মিলিয়ে শিক্ষকের মোট শূন্যপদ ১,১০,০০০। ৮ হাজারের বেশি স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। ২০১৯ সালে এল কোভিড- ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর প্রায় দুটি শিক্ষাবর্ষ স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ রইলো। সরকারের পক্ষ থেকে স্কুল খোলা, বা পড়াশোনার তদারকির নামে মাত্র কিছু লোকদেখানো কাজে স্কুলশিক্ষা এগলো না কিছুই। ঢালাও ক্লাসে তুলে দেওয়া হলো পড়ুয়াদের, ঘাটতি থেকে গেল বিপুল। 

আমাদের মনে হয়েছিল কিছু করা দরকার। ওই পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানো দরকার, তাদের পড়ার ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। 

দক্ষিণ শহরতলির এই বিস্তীর্ণ এলাকা ছড়িয়ে আছে পুবে খেয়াদা থেকে পশ্চিমে সন্তোষপুর। উত্তরে জগতিপোতা থেকে দক্ষিণে নয়াবাদ পর্যন্ত। সম্পন্ন ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী থেকে দিনমজুর- বিভিন্ন জীবিকা বিভিন্ন আর্থিক সামর্থ্যের মানুষ এই এলাকার বাসিন্দা। এখানকার স্কুলগুলিতে যে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে, তারা কিন্তু বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা-মা, পরিবার ভেদে বড়ো দাদা-দিদি কর্মরত। প্রধানত তাঁরা অস্থায়ী, চুক্তি-ভিত্তিক কর্মী, প্রান্তিক শ্রমিক বা গৃহপরিচারক। কেউ বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নিজেদের জীবনে যে স্বপ্ন এঁরা দেখতে সাহস বা সুযোগ পাননি, সেই পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠা পাবার- ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-চাকুরে হবার স্বপ্নের পিছনে নিজেদের সন্তানদের ঠেলে দেবার সাহস তাঁদের নেই। নিত্য তাদের পড়াশোনার খোঁজখবর নেওয়া বা তদারকির জন্য লেগে থাকার সময়, সুযোগ বা দক্ষতা তাঁদের নেই। তাই তাঁদের সন্তানদের কাছেও পড়াটা শুধু পড়ার জন্যই পড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখাপড়া শিখে বাস্তব জীবনে কোন প্রতিষ্ঠার সুযোগ আজ এদের সামনে খোলা? সেটা এরাও বোঝে। 

তাই এই সব ছেলেমেয়েদের স্কুলে আসাটাও অনিয়মিত। মানসিকতাও যেমন অপরিণত, ঘরের পরিস্থিতিও অনেক সময়েই প্রতিকূলকাউকে ঘরে রান্না করতে হয় তো কাউকে ছোটো ভাই-বোনকে দেখতে হয়, দোকানে বসতে হয়, পেপার দিতে বা গাড়ি ধুতে হয়। কারও বাবা স্কুলে আসার বাসের ভাড়াটাও কোনোদিন দিতে পারেন না। 

পড়াশোনা অনিয়মিত, পড়ার মানসিকতাও গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। পড়ার মান তাই নিম্নবর্গেররিডিং পড়তে না পারা, পড়ে মানে বুঝতে না পারা, লিখতে বা অঙ্ক করতে না পারা। রোজ ক্লাসের পড়া হয় না, বাড়ির পড়াও হয় না। আবার, বাবা-মায়েরা নিজেদের ঘাটতি বোঝেন বলে, রোজগারপাতি ভালো না হওয়া সত্ত্বেও দেদার খরচ করে প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার চেষ্টা করেন। এদের কাছে টেনে নিয়েই চলছে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিকল্প পাঠশালা।’ 

দরকার মতো বড় ক্লাসঘর চাই। হরেক কাছের-দূরের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, গবেষক আর ছাত্ররা পড়াবেনতাঁদের সমবেত করা। পাঠশালার কাজ তদারকি করবেন ব্যবস্থাপকেরাতাঁদের যুক্ত করা। এলাকার স্কুলগুলিতে, আর পাড়ায় পাড়ায় বাবা-মায়ের কাছে পাঠশালার বার্তা নিয়ে পৌঁছানো। নানা উপকরণ- বোর্ড, পেন, খাতা। লাইট-ফ্যান, রোজের কিছু টিফিন এসবের ব্যবস্থা করা। সময় লেগেছিল।

সাড়া মিললো অভূতপূর্ব, আশাতীত। এলাকার বাবা-মায়েরা হাত ধরে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এলেন, এলাকার স্কুলগুলির মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা পাঠালেন পড়ুয়াদের। শুধু সন্তোষপুর নয়, কোথায় যাদবপুর, কোথায় সোনারপুর এমনকি নুঙ্গির স্কুল থেকে মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা এলেন পড়াতে। পাড়ার যুবক, প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী সরকারি কর্মচারীরা এলেন পাঠকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হতে। ঘর পাওয়া গেল দুটি- একটি সন্তোষপুরের মডার্ন পার্কে, এখানে পড়বে ১০৩ আর ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডের ছেলে-মেয়েরা, আরেকটি মুকুন্দপুরে, ১০৯ নম্বর ওয়ার্ড আর লাগোয়া খেয়াদা পঞ্চায়েত আর সোনারপুর-রাজপুর পৌরসভার মতো এলাকার পড়ুয়াদের জন্য। পাঠকেন্দ্রের নাম সবাই ঠিক করলেন- নাম হোক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিকল্প পাঠশালা।’ 

বিকল্প? হ্যাঁ, তাই তো। হরবখত যে সব কোচিং সেন্টারগুলিতে দামি টিউশন ফি দিয়ে নামী শিক্ষকদের কাছে পড়তে হয়, আমাদের পাঠশালা তা তো নয়এ হলো কোনও মাইনে ছাড়াই ছাত্র আর শিক্ষকের ভালবাসা আর দায়িত্ববোধের ওপরে গড়ে ওঠা পাঠশালা। ছেলেমেয়েদের এগিয়ে চলার সঙ্গে তাদের বাবা-মায়েদেরও জড়িয়ে নেওয়া। উপার্জন নয়, পড়ুয়াদের ভালোবেসে তাদের গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার কর্মোদ্যোগ। বিকল্প নয় তো কী? 

যাত্রা শুরু হলো ১৬ জুলাই, ২০২২ মুকুন্দপুরে। আর ১৭ জুলাই, ২০২২ মডার্ন পার্কে। শুরু হলো ক্লাস নাইন আর ইলেভেন নিয়ে। এক-একটা ক্লাসে এল নানা স্কুলের ১৬-১৭টি করে কচিকাঁচা। রুটিন হলো। রোজ দুটো করে ক্লাসসন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা, আবার সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৯টা। বাদ রবিবার। ক্লাস নাইন সপ্তাহে চারদিন, ক্লাস ইলেভেন দুদিন। ক্লাস নাইন সব সাবজেক্ট, ক্লাস ইলেভেন আপাতত বাংলা আর ইংরেজি। সবাই টিফিন খেয়ে আসতে পারে না। হাতে হাতে সামান্য একটু টিফিন, কোনোদিন একটুকরো কেক, কোনোদিন বা এক প্যাকেট বিস্কুট। তাতেই মহাখুশি। 

সমস্যা রয়েছে। এরা সবাই নিয়মিত আসে না। পড়াও নিয়মিত করতে পারে না। অভাবের সংসারে বাবা-মায়েরা পড়াশোনার দেখভাল করতে পারেন না। আবার এই পড়ুয়াদের নিজেদের অনেককেই কাজ করতে হয়, পড়ার সময় হয় না। উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে এদের অসুস্থতা বা দুর্বলতাও আর একটা কারণ। তাহলে শুধু পড়া করানোই নয়, পাঠশালার মাস্টারমশাই-দিদিমণি আর ব্যবস্থাপকদের আরও একটি কাজ ওই বাচ্চাদের নিয়ত খোঁজ নেওয়া- কে কেন ক্লাসে এল না, কেই বা কেন পড়াটা নিয়মিত করলো না, শরীর-স্বাস্থ্য কেমন আছে। 

ভর্তির সময়েই অভিভাবকদের দিয়ে একটা ফর্ম ভরে নেওয়া হয়। তাতে পড়ুয়ার নাম, অভিভাবকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদি থাকে। ওই ফোনে যোগাযোগ রাখা হয় বাড়ির সঙ্গে। 

লেখার প্রথমেই যে দুটি ঘটনা বলা হয়েছে, তা ওইভাবেই  স্যর-ম্যামেদের বা ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকে অভিভাবক বা পড়ুয়াদের খোঁজ-খবর নেবার উদাহরণ। তবে সবটা যে সমান ভালো সব সময়েই চলবে, এমন নয়; অনেক পড়ুয়ারই ফোন আসলে বাবা-মায়ের নিদেন দাদা-দিদির ফোন, তাদের কাছেই সারাদিন থাকে, মেসেজ দেখার সুযোগ হয় দিনান্তে ওঁরা যখন ঘরে ফেরেন। কী করা, রাতেই কথা বলতে হয়। 

মুকুন্দপুরে সমস্যা একটু বেশি- এখানের পড়ুয়াদের আর্থিক মান আরও একটু নিচে, সবার স্মার্ট ফোন নেইই। মডার্ন পার্কের মতো এখানে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ করা যায়নি। পাড়ায় পাড়ায় আছেন শুভানুধ্যায়ীরা। তাঁদের কাছে ফোন গেলে তাঁরা অনুপস্থিত ছাত্রর খবর সংগ্রহ করে জানান। ফল? হাতে হাতে। বাবা-মায়েরা শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন। যোগাযোগ করেন। অনিয়মিত পড়ুয়ারা আবার আসে। পড়ার ঘাটতি পুষিয়ে নেবার চেষ্টা হয়। ২০২২ সালে ক্লাস শুরু হয়েছিল দেরিতে, চারটি মাস মাত্র পড়ার সময় পাওয়া গিয়েছিল। তবু বার্ষিক পরীক্ষায় নম্বর এসেছে ভালোই। 

আর শুধু তো পড়াশোনা নয়। পাঁচটি দিন উদ্‌যাপন করা হয়- বিবেকানন্দ, নেতাজী, আম্বেদকার, রাধাকৃষ্ণণ আর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। নেতাজীর জন্মবার্ষিকী আমাদের পাঠশালার আনুষ্ঠানিক জন্মদিনও বটে। অভিভাবকরাও আসেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ব্যবস্থাপক আর পড়ুয়াদের মিলেমিশে ঘর সাজানো, ছবি জোগাড় করা, সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা, গান-নাচ আর দেদার ছবি আর সেলফি তোলা। 

বছর ঘুরে ২০২৩ সালপুরানো ক্লাস নাইন এবারে ক্লাস টেনে। আসবে নতুন ইলেভেন, আগের ইলেভেন যাবে টুয়েলভে। ঘর এবারে বেড়েছে। মডার্ন পার্কের পুরানো ঘরে রয়েছে নতুন টেন আর আগের ইলেভেন; সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কের নতুন ঘরে হয়েছে নতুন নাইনের ক্লাস। মুকুন্দপুরে তিনতলার ছাদে নতুন ঘর তুলে তাতে চলছে নাইন, টেন, ইলেভেনের ক্লাস। ক্লাসের সময় এগিয়ে সাড়ে পাঁচটা করা হয়েছে, বাচ্চারা যাতে একেবারে এখানে এসে, টিফিন খেয়ে পড়ে নিয়ে বাড়ি যেতে পারে, ওদের পরিশ্রম কম হয়। নতুন ব্যবস্থাপকও যুক্ত হয়েছেন পাঠশালার সঙ্গে। 

পড়ার সমস্যা কি সব মিটে গেছে? না; বর্তমান পরিস্থিতিতে তা হবার সুযোগ নেই। বহু পড়ুয়া নানা কারণে অন্য কোচিংয়ে পড়ে; অনেকে তাই সব বিষয়ের দিন আসে না; তার ছাড় দিতে হয়েছে। অনিয়মিত হাজিরা সবটা সমাধান করা যায়নি। বেশ কিছু ছাত্রী রক্তাল্পতায় ভুগছে; ফলে প্রায়শই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই অপুষ্টিতে ভোগার কারণে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিছু পড়ুয়া পড়া ছেড়ে কাজে যোগ দিয়েছে। এই সব সমস্যা যথাসম্ভব মোকাবিলা করেই পাঠশালা এগিয়ে চলেছে।

Comments :0

Login to leave a comment