কোথাও সকাল থেকে বিকেল, কোথাও দুপুর থেকে রাত তো কোথাও সারারাত ধরে রাস্তায় থাকার মানসিকতা নিয়ে প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে ধরনায় বসেছেন অসংখ্য মানুষ। বকেয়া মজুরি, একশো দিনের কাজ ইত্যাদি হকের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাজ্যজুড়ে পঞ্চায়েতগুলিতে ধরনা-অবস্থান, ডেপুটেশন প্রদানের কর্মসূচি নিয়েছিল সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন। সেই দাবি জানাতে গিয়ে জীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত গরিব মানুষগুলিকে পড়তে হয়েছে তৃণমূলের আক্রমণের মুখে। যেমন বীরভূমের সাত্তোর পঞ্চায়েত। দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই স্বাভাবিক নিয়মে আন্দোলনকারীদের ওপর নেমে এসেছে তৃণমূলীদের আক্রমণ। চলেছে ব্যাপক মারধর। পুলিশ এখানেও সেই নীরব দর্শক।
সাত্তোর তৃণমূলের সন্ত্রাদের আঁতুরঘর। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বোমা মজুতের জন্য রাজ্যবাসীর কাছে পরিচিত হওয়া সেই সাত্তোরে এদিন খেতমজুররা মিছিল করে ডেপুটেশন দিতে গেলেই বাধা নেমে আসে তৃণমূলীদের। সেখানে আগে থেকে পরিকল্পনা করে জায়গাটা ঘিরে রেখেছিল তৃণমূলের দুষ্কৃতিবাহিনী। এরপর বাকবিতণ্ডা, বচসা চরম পর্যায় পৌঁছায়। লাল ঝান্ডা হাতে নাছোড় এলাকাবাসীরাও পালটা সুর চড়ায় তৃণমূলীদের বিরুদ্ধে। এরপরই নেমে আসে আক্রমণ, মারধর। জমায়েত ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা হয়। অবশ্যই পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশের সহায়তা নিয়েই তৃণমূলীরা তাণ্ডব চালায়। বেশ কয়েকজন সিপিআই(এম) কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। প্রচারের জন্য নিয়ে যাওয়া টোটোতে ভাঙচুড় চালানো হয়েছে। এদিন পঞ্চায়েত অফিস ঘিরে রাখে তৃণমূলীরা। নায্য দাবিতে ডেপুটেশনে বাধা কেন এই প্রশ্ন তুলে পুলিসকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হলে কোনও কাজ হয়নি।
মূলত অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজ চালু করা, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা প্রদান, সমস্ত গরিব মানুষকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় প্রকল্পে বাড়ি দেবার ব্যবস্থা করার দাবি তুলেছেন খেত মজুররা।
সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি তুষার ঘোষ এদিন বলেন, গ্রামের মানুষের হাতে কাজ নেই। খেত মজুরদের অবস্থা অসহনীয়। এর বিহিত চেয়ে গত ২৯ মে থেকে শুরু হয়েছে ধারাবাহিক আন্দোলন। আগামী ৮ জুন পর্যন্ত তা চলবে। তার মধ্যে বৃহস্পতিবার বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের ৪০০ টি পঞ্চায়েত এলাকায় দিনভর এবং কোথাও কোথাও সারা রাত ব্যাপী অবস্থান ধরণা চলেছে। ব্লকে ব্লকে ডেপুটেশন দিয়েছেন খেতমজুররা। তিনি বলেন, তৃণমূল এবং বিজেপি দড়ি টানাটানির খেলা খেলছে। টাকা বরাদ্দ-বকেয়ার নাটক করে চলেছে। আর গ্রামের মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। এর বিরুদ্ধে আরও বৃহত্তর আন্দেলনে শামিল হবেন খেত মজুররা।
সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক নিরাপদ সর্দার বলেন, গ্রামের গরিব মানুষ ক্রমশ আরও বেশি করে জাগছেন। লাল ঝান্ডা ক্রমশ আরও বেশি মাথাচাড়া দিচ্ছে। আর এই কারণেই ভয় পাচ্ছে তৃণমূল। আগামী দিনে ধরাশায়ী হবে তৃণমূল- পরিস্থিতি সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গরিব মানুষের উপকার হয়- এমন ক্ষেত্রগুলিতে বরাদ্দ কমেছে। তাহলে গ্রামের মানুষ কাজ পাবেন কি করে- এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। আগামী দিনে আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
এদিন বাঁকুড়া জেলার ছাতনা, বড়জোড়া, জয়পুর, বাঁকুড়া ১নং ব্লকের আধারথোল সহ অঞ্চল সহ একাধিক জায়গায় ধরনা ও ডেপুটেশন কর্মসূচি চলেছে। অন্যদিকে বীরভূমে লাভপুর সহ সবক’টি ব্লকের এক বা একাধিক পঞ্চায়েতে এদিন ধরনা অবস্থান শুরু হয়েছে। জেলায় এদিন ২৪টির মতো পঞ্চায়েতে ধরনা অবস্থান হয়েছে, এই ধরনা চলবে বলে জানা গেছে। পূর্ব বর্ধমানের মেমারি-২ ব্লকের কুচুট ও বড়পলাশন-১ গ্রামপঞ্চায়েত ও ভাতাড় গ্রামপঞ্চায়েতে এদিন টানা অবস্থান চলেছে, বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন হয়েছে। এছাড়া পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা ব্লকের মলানদিঘি গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তরে ও সালানপুর ব্লকের আল্লাডি গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তরে কৃষক খেতমজুররা দিনভর বিক্ষোভ অবস্থান করেন। ওদিকে মানকর গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তরে কৃষক ও খেতমজুরদের বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত হয়েছে।
হুগলী পণ্ডুয়ায় জামগ্রাম - মণ্ডলাই পঞ্চায়েত ঘেরাও অভিযান হয় এদিন। এছাড়া আরামবাগের মলয়পুর ১, পুরশুড়া ১ , গোঘাটের কামারপুকুর ও কুমুড়সা, খানাকুল ২ ব্লকের রাজহাটি ১ নং, তারকেশ্বরের কেশবচক, মগরা ১ নং, পোলবা, দাদপুরের বাবনান, বলাগড়ের বাকুলিয়া - ধোবাপাড়া, সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি, হরিপালে বাহিখণ্ড, জাঙ্গিপাড়া, চণ্ডীতলা ১ ব্লকের শিয়াখালা প্রভৃতি পঞ্চায়েতগুলিতে জমায়েতের মধ্য দিয়ে ডেপুটেশন ও বিক্ষোভ দেখিয়েছেন খেতমজুররা। পুরুলিয়া জেলাতেও সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকে জেলার ১৭০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই চে অবস্থান বিক্ষোভ এবং মিছিল। পূর্ব বর্ধমানে সারা ভারত ক্ষেতমজুর ইউনিয়ন রায়না-২ এরিয়া কমিটির উদ্যোগে প্রধানের নিকট স্মারকলিপি পেশ ও রাতভর অবস্থান বিক্ষোভ অবস্থান কর্মসূচিতে শামিল হয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে খেতমজুর ইউনিয়নের রানিগঞ্জ থানা কমিটির ডাকে অবস্থান কর্মসূচি হয়েছে এদিন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির ডাকে জেলার ২৫ টি ব্লকের ৩৩ টি স্থানে অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে। তমলুকের অনন্তপুর ২, শহীদ মাতঙ্গিনীর বল্লুক ১, কোলাঘাটের সাগরবাড়, নন্দকুমারের দামোদরপুর ও শীতলপুর, চণ্ডীপুরের ঈশ্বরপুর, ময়নার ময়না ২, সুতাহাটার গুয়াবেরিয়া, হলদিয়ার দেভোগ, মহিষাদলের সতীশ সামন্ত, নন্দীগ্রাম ১ এর হরিপুর ও সামসাবাদ, নন্দীগ্রাম ২ আমদাবাদ ১, এগড়ার ছত্রি, এগরা ২ এর পানিপারুল ও দুবদা, পটাশপুর ১ এর চিশ্তিপুর, পটাশপুর ২এর শ্রীরামপুর, ভগবানপুর ১ মহম্মদপুর ও কোটবাড়, ভগবানপুর ২ এর জুখিয়া, কাঁথি ১ বাদলপুর ও দুলালপুর, দেশপ্রাণের চালতি ও সন্তিয়া, কাঁথি ৩ কুসুমপুর ও দুর্মুট, রামনগর ১ এর তালগাছারী ২, রামনগর২ সটিলাপুর, খেজুরি ১ এর হেঁড়িয়া এবং খেজুরি ২ ব্লকের জনকা ও খেজুরি গ্রাম পঞ্চায়েতে অবস্থান বিক্ষোভ চলেছে। অন্যদিকে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন তাহেরপুর এরিয়া কমিটির আহ্বানে বারাসত গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের সামনে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার বেশি অবস্থানে সামিল হলেন বঞ্চিত মানুষেরা।
অন্যদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরা ব্লকের ডুঁয়া, রাধামোহনপুর, লোয়াদা- ষাড়পুর, জলিবান্দা,ডেবরা-১ ও ডেবরা-২, ভবানীপুর গ্রামপঞ্চায়েত দপ্তরে রাত ভোর অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। পিংলার কুসুমদা, সবং এর নওগাঁ, তেমাথানি, খড়্গপুর গ্রামীণ২ ব্লকের চাঙ্গুয়াল, গড়বেতার নলবনা, রসকুন্ডু এমন ৭৯টি গ্রামপঞ্চায়েত দপ্তরে বিক্ষোভ অবস্থান সহ রাতভোর ঘেরাও বিক্ষোভ অবস্থান কর্মসূচি হয়েছে।
উত্তরবঙ্গেও এদিন খেতমজুরদের দিনভর অবস্থান বিক্ষোভ, ডেপুটেশন চলেছে। শিলিগুড়ি মহকুমার মাটিগাড়া বাজার, নকশালবাড়ি পানিঘাটা মোড়, খড়িবাড়ি বাজার ও ফাঁসিদেওয়া বাজারে ধরণা কর্মসূচি চলেছে। দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চলের কার্শিয়াঙ, সুখিয়া ও বিজনবাড়ি ব্লকেও সারা ভারত কৃষক সভার পক্ষ থেকে বিডিও—র উদ্দ্যেশ্যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের খড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তরে। আলিপুরদুয়ার জেলার ১ ব্লকের শালকুমার ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ২ ব্লকের মহাকালগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে সামনে দুপুর দু’টো থেকে দিবারাত্র অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হয়েছে সারা ভারত ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন। কোচবিহার ১ ব্লকের পানিশালা গ্রাম পঞ্চায়েত, কোচবিহার ২ ব্লকের আমবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত, মাথাভাঙ্গা ১ ব্লকের পচাগড়, মাথাভাঙ্গা ২ ব্লকের রুইডাঙ্গা, শীতলকুচি ব্লকের শীতলকুচি, দিনহাটা ১ ব্লকের ভেটাগুড়ি ২ গ্রাম পঞ্চায়েত, তুফানগঞ্জের বারোকোদালি ও ছাট রামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে এদিন অবস্থান বিক্ষোভে শামিল হন খেতমজুররা। সারাভারত খেত মজুর সংগঠনের উত্তর দিনাজপুর জেলার ডাকে রায়গঞ্জ ব্লকের বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েত এবং হেমতাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির দপ্তরের সামনে ৪ ঘণ্টার গণঅবস্থান বিক্ষোভ হয়।
Comments :0