১৯৬২ সালের পর থেকে পর পর ২টি বিশ্বকাপ কোনও দেশই পায়নি। ব্রাজিলের কথাই ধরা যাক। ১৯৯৪ সালে তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতে ৪ বছর পর কাফু, রিভাল্ডোরা যখন ফের ফাইনালের টিকিট আদায় করে নেন, তখন ‘জোগো বনিতোয়’ আচ্ছন্ন সেলেকাও সমর্থকরা ভেবেছিলেন ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। কারণ, সেইবার পরপর ২টি বিশ্বকাপ জিতে নিয়ে ইতালির (১৯৩৪, ১৯৩৮) সাথে একই আসনে চলে আসেন পেলে, গ্যারিঞ্চাদের দেশ। কিন্তু, ১৯৯৮-এর ফাইনালে জিনেদিন জিদানের হ্যাট্রিকের সৌজন্যে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ব্রাজিলকে। প্রসঙ্গত, ফরাসি শিবিরের বর্তমান কোচ দিদিয়ের দেশঁ সেই সময় ফ্রান্সের অধিনায়ক ছিলেন। রবিবার যদি তাঁর ছেলেরা মেসিদের হারিয়ে দেয় তবে ফ্রান্স, ইতালির সাথে এক আসনে চলে আসবে তাঁর দেশ। খেলোয়াড় হিসাবে তিনি যা করতে পারেননি, কোচ হিসাবে তা বাস্তবায়িত করতে এমবাপেদের হেডস্যার তাঁর প্রিয় ‘গ্রিজির’ দিকে তাকিয়ে আছেন। অথচ, কিছুদিন আগে তিনি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে ৩১-এ পা দিয়ে ফেলা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের স্ট্রাইকারের আর আগের মতো গতি নেই। দ্রোগবা, রুনির মতো তাঁর শারীরিক সক্ষমতাও নেই। তবে ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির গ্রিজম্যানই কেন ফরাসি কোচের তুরূপের তাস? কারণ, গত বিশ্বকাপ ফাইন্যালে ম্যান অব দ্য ম্যাচ পাওয়া ‘গ্রিজি’ আর শুধু বক্স স্ট্রাইকার নন। তিনি এখন অনেকটা নিচ থেকে অপারেট করেন। তার মানে এই নয় যে, তিনি একজন প্লেমেকারের ভূমিকাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। বিপক্ষের কাউন্টার অ্যাটাকের সময়, তিনি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছেন। অ্যাটাকার হিসাবে সুনাম অর্জন করা গ্রিজম্যানের ব্লকিং, ট্যাকল, স্ন্যাচিং ফুটবল বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে। মাঝমাঠে, তিনি পেন্ডুলামের মতো ওপর নিচ করছেন, প্রচুর ওয়ার্ক লোড নিচ্ছেন। সারা মাঠ জুড়ে যেন শুধুই গ্রিজম্যান!
তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘নতুন ভূমিকাতেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ। আমাকে ডিফেন্স ও ফরওয়ার্ড লাইনের যোগসূত্র হিসাবে ভাবতে পারেন।’ ফরাসি মহাতারকা আরও জানান, ‘আমার সামনে এমবাপে, জিরু ও ডেম্বেলের মতো খেলোয়াড় থাকায় আমার কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে।’ অথচ ২০১৮ বিশ্বকাপের পর, একটা সময় মনে হয়েছিল, তাঁর কেরিয়ার শেষ! ২০১৯ সালে বার্সেলোনায় ১২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তিনি যখন সই করেন, তখন কাতালান ক্লাবটির সমর্থকরা ভেবেছিলেন যে তাঁর সাথে মেসির জুটি বিপক্ষ দলগুলির রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। কিন্তু, দু’বছর বার্সাতে থাকাকালীন গ্রিজম্যানের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। নিজের ফুটবল কেরিয়ারের সব থেকে খারাপ অধ্যায়ের সম্মুখীন হন ফরাসি মেগাস্টার। ফুটবলের রাজপুত্র লিওনেল মেসির সাথে তাঁর সেই সময়ের সম্পর্কের তিক্ততার কথা আজ আর কারো অজানা নয়। সেই সম্পর্কের প্রভাব খেলার মাঠে পড়ে। ২০১৪ সালে যে ক্লাব তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয়, সেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদেই তিনি ফিরে আসেন এবং বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ ইতিহাস গড়ার মুখে ফ্রান্সের মাঝমাঠের প্রাণভোমরা।
দেশঁর বয়ান থেকে গ্রিজম্যানের খেলার ধরনের একটা আভাস পাওয়া যায়। জার্মান কিংবদন্তি বেকেনবাউয়ারের মতো অধিনায়ক ও কোচ, উভয় ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ হাতে তোলা দেশঁ সাফ জানিয়ে দেন, ‘একটা গোল করিয়ে যতটা আনন্দ পাচ্ছে গ্রিজি, ঠিক ততটাই আনন্দ ও পাচ্ছে একটা ট্যাকল করে।’ বিগত চার প্রতিযোগিতার ফাইনালের ৩টিতেই জয় লাভ করা ফরাসি দলের অন্যতম স্তম্ভ গ্রিজম্যান একসময় যথেষ্ট লম্বা না হওয়ার জন্যে ও শারীরিক সক্ষমতায় অন্য স্ট্রাইকারদের থেকে পিছিয়ে থাকার জন্যে ফরাসি ফুটবলে পাত্তা পাননি ঠিক যেইভাবে একসময় হালে পানি পাননি বেয়ার্ন তারকা রিবেরি বা কান্তে। ফলে নিজের শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যে দেশের ফুটবল ঘরানা উপযোগী, সেই স্প্যানিশ ফুটবলকে বেছে নেন তিনি। ফলও পান হাতেনাতে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই স্পেনে পাড়ি দেন গ্রিজি। সেইখানে রিয়াল সোসিদাদ থেকে পথ চলা শুরু তাঁর। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ২০১৪ সালে তাঁর ফুটবল জীবনে নতুন মোড় আসে যখন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে সই করেন। বাকিটা ইতিহাস।
Comments :0