মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকার বার্ষিক আয় ৩ লক্ষ টাকা বেড়ে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। দুটি শিখণ্ডী সংস্থার ডিরেক্টর, কয়েক কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট, একাধিক চালকলের মালিক বনে যাওয়া অনুব্রত কন্যা সুকন্যা মণ্ডল গত দু’দিন ধরে দফায় দফায় ইডি জেরার মুখে।
বুধবারের পরে ফের বৃহস্পতিবার। গোরু পাচারকাণ্ডের তদন্তে দিল্লিতে ইডি’র সদর দপ্তরে দু’দিনে প্রায় ১৫ ঘণ্টা ধরে জেরা করা হয় সুকন্যা মণ্ডলকে। শুধু অনুব্রত কন্যা নয়, বৃহস্পতিবার একই সঙ্গে দিল্লিতে ইডি’র সদর দপ্তরে জেরা করা হয় অনুব্রত মণ্ডলের দেহরক্ষী সায়গল হোসেন, হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারি, অনুব্রত ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সাতটি চালকলের মালিক রাজীব ভট্টাচার্যকেও। গোরু পাচারের তদন্তের যোগসূত্রেই এই চারজনকে জেরা করা হয়। একইসঙ্গে এদিনই কলকাতায় নিজাম প্যালেসে আরেক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই গোরু পাচারকাণ্ডেই দীর্ঘ জেরা করে অনুব্রত ঘনিষ্ঠ কেরিম খানকে।
এদিকে গোরু পাচারকাণ্ডে তদন্তের তৎপরতার মাঝেই ইডি কয়লা পাচারকাণ্ডেও চলতি মাসে একের পর এক সমন পাঠানো শুরু করেছে। এবার কয়লা কাণ্ডে এই প্রথম তলবের মুখে পড়লেন বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস। কয়লা কাণ্ডে এর আগে যদিও কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার তলবের মুখে পড়েননি এই তৃণমূল নেতা।
ইডি’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়লা পাচারকাণ্ডে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ ফেরার যুব তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্রের সঙ্গে একটি যোগসূত্রেই তাঁকে তলব করা হয়েছে। কয়লা কাণ্ডেই ইডি এবং সিবিআই দুই সংস্থার তদন্তেই অন্যতম অভিযুক্ত বিনয় মিশ্র ইতিমধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও নিয়ে ফেলেছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই সে পলাতক। ওই বছরই অভিষেক ব্যানার্জি এই বিনয় মিশ্রকে যুব তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক পদে বসান, রাজ্য পুলিশের নিরাপত্তাও পেত এই পাচারকারী। কয়লা কাণ্ডে অর্থ নয়ছয়ের তদন্তে একাধিক শিখণ্ডী সংস্থার হদিশ মিলেছে। তাতে কলকাতার ঠিকানায় বিনয় মিশ্র ও তাঁর ভাইয়ের দুটি শিখণ্ডী সংস্থারও খোঁজ মিলেছে। সেই সূত্রেই সামনে এসেছে এবার মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের ভূমিকা।
ইডি’ সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ১৮ নভেম্বর দিল্লির তদন্তকারী সংস্থার সদর দপ্তরে তলব করা হয়েছে স্বরূপ বিশ্বাসকে। কয়লা কাণ্ডে আসানসোল শিল্পাঞ্চলের তৃণমূলী নেতা ভি শিবদাসনকেও তলব করেছে ইডি, দিল্লির দপ্তরেই। মলয় ঘটকের পরে শিবদাসনকেও তলব করা হয়েছে কয়লা পাচারকাণ্ডে পথ সুগম করে দেওয়ার বিনিময়ে বিপুল টাকার লেনদেনের অভিযোগে। কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালাকে জেরা করেই এসেছে এই তৃণমূল নেতার নাম, জানা গিয়েছে ইডি সূত্রে। একই সঙ্গে কয়লা কাণ্ডে তলব করা হয়েছে পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে। লালাকে জেরা করেই সামনে এসেছিল এই তৃণমূল নেতার নাম। ১৪ নভেম্বরও একই কয়লা কাণ্ডের জেরায় দিল্লির ইডির অফিসে তলব করা হয়েছে এই তৃণমূল নেতাকে।
বুধবার সকাল থেকে দফায় দফায় আট ঘণ্টা দিল্লি দপ্তরে অনুব্রত কন্যা সুকন্যা মণ্ডলকে জেরা করে ইডি। প্রথম দিনের জেরাতেও একাধিক প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন সুকন্যা মণ্ডল। তাঁর সম্পত্তি বৃদ্ধির ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। সন্তুষ্ট না হওয়ায় ইডি ফের এদিন সকালে তলব করে তাঁকে। বুধবার সুকন্যা মণ্ডলকে জেরার সময়তেই ইডি দপ্তরে আনা হয়েছিল সায়গল হোসেনকে। অনুব্রত কন্যার কীর্তির অনেক কিছুর সাক্ষী তাঁর নিরাপত্তারক্ষী এই পুলিশকর্মী। যদিও বুধবার তাঁদের মুখোমুখি জেরা হয়নি। এদিন জেরার দ্বিতীয় পর্বে সায়গল হোসেন ও সুকন্যা মণ্ডলকে মুখোমুখি বসানো হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে ইডি’র একটি সূত্রে।
গোরু পাচার মামলার তদন্তের ভরকেন্দ্রে থাকা অন্যতম নাম সুকন্যা মণ্ডল। চালকল থেকে জমি, বাগানবাড়ি থেকে দুটি কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে বসে রয়েছেন তিনি। এই ‘জমিদারি’ গড়ে তোলার অর্থের উৎস কি? গোরু পাচারের টাকার সঙ্গে কি যোগসূত্র আছে? অনুব্রত মণ্ডলের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির হদিশ পেতে তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই তাঁর কন্যার নামে দুটি সংস্থার হদিশ পাওয়া যায়। একটি সংস্থার নাম ‘এএনএম অ্যাগ্রোকেম ফুডস প্রাইভেট লিমিটেড’। এই ‘এএনএম’ কী অনুব্রত মণ্ডলের নামের আদ্যক্ষর? এই সংস্থায় দুজন ডিরেক্টর। একজন সুকন্যা মণ্ডল। আরেকজন বিদ্যুৎ বরণ গায়েন। গত কয়েক বছরের এই ব্যক্তিও কয়েকশো কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনুব্রত ঘনিষ্ঠতার জেরে। দ্বিতীয় সংস্থাটির নাম ‘নীড় ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেড’। এই দুটি সংস্থাতে গোরু পাচারের এনামুল সিন্ডিকেটের টাকা খেটেছে বলেই মনে করছেন তদন্তকারীরা। ইডি’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, জেরায় সুকন্যা মণ্ডল দাবি করেছেন তাঁদের চালকলের ব্যবসা আছে। সেই সূত্রেই এই টাকা। সুকন্যা অধিকাংশ প্রশ্নই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
একইসঙ্গে চারজনকে একইদিনে দিল্লি দপ্তরে এই জেরা রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ। অনুব্রতর হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারি ছাড়াও ব্যবসায়ী রাজীব ভট্টাচার্যকে দীর্ঘ জেরা করে ইডি। আহমেদপুরের তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি তথা সাত চালকলের মালিক রাজীব ভট্টাচার্য। এই রাজীব ভট্টাচার্যই অনুব্রতর প্রয়াত স্ত্রীর হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ বাবদ মিটিয়েছিলেন ৬৬ লক্ষ টাকা!
এদিকে বীরভূম জেলা পরিষদের তৃণমূলের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ কেরিম খানকে প্রায় একই সময়ে কলকাতায় নিজাম প্যালেসে জেরা শুরু করে সিবিআই। বোলপুরে গোরু পাচার তদন্তে প্রথম এই কেরিম খানের বাড়িতেই তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই। তদন্তের গোড়া থেকেই সিবিআই নজরে ছিল কেরিম খান। তৃণমূলের উত্থানের সাথে সাথেই তারও উত্থান হয়েছে রকেট গতিতে। মূলত বালি কারবার থেকেই বিপুল, তারপর জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ নির্বাচিত হওয়ার পর আয় আরও বাড়ে। অনুব্রতর সাথেও আছে আর্থিক লেনদেন। সেই লেনদেনের খোলসা করতেই সিবিআই’র জেরা বলে জানা গিয়েছে।
cattle smuggling case
গোরু পাচারকাণ্ডে দিল্লিতে দু’দিনে
১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ অনুব্রত-কন্যাকে
×
Comments :0