(অভিযাত্রী তপন কুমার দাস সাইকেলে ঘুরেছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে। পরিবেশ রক্ষার বার্তা, সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে চলেছে যাত্রা। দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় পেয়েছেন অচেনা-অজানা মানুষের আপ্যায়ন। ধর্ম-ভাষা-দেশের বেড়া ভাঙা নানা ঘটনা বিনিময় করছেন পাঠকদের সঙ্গে। আজ প্রকাশিত হচ্ছেে তৃতীয় এবং শেষ পর্ব।)
পকেট ফাঁকা, ভাতের থালা এগিয়ে দিলেন দোকানি
ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভার সিমে-রাঙ প্রদেশ। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে কিছুটা। স্টেট হাইওয়ে, অন্ধকার পথ, দূরপাল্লার বাসগুলো ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলে যায়। খিদে পেয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু পকেটে ফাঁকা। শহর এলে এটিএম-এ টাকা তুলে তবে খাবার জুটবে। শহর তখনও চার কিলোমিটার দূরে। হঠাৎই বাঁ-হাতি মসজিদ দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মসজিদের সামনে সারি সারি বাইক। ঈদের ছুটিতে বাড়িমুখো সবাই। মাঝে রাত-খানি কাটিয়ে যায় অনেকেই মসজিদে। নিজের সাইকেল দাঁড় করিয়ে, ভেতরে হাতমুখ ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এপাশ ওপাশ করছি। পাশে বাড়ির মাঝেই এক দোকান। চা জলখাবার সবই রয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ল পকেটে তো টাকা নেই। ঘুরে চলে আসছিলাম, পেছন থেকে দোকানি মহিলার সুরেলা ডাক।
কিছু খাবেন ?
বললাম, ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু পয়সা নেই যে।
দোকানি চায়ের গ্লাস খানি ধরিয়ে বললো, নিন, পয়সা লাগবে না।
গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে আলোচনা জুড়লাম। বিমা অফিসার, কর্মসূত্রে ইংরেজি জানেন। সুবিধাই হলো, দেশ –কাল- রাজনীতি, সেদেশের অর্থনীতি কোন কিছুই আলোচনায় বাদ গেলো না।
রাত নটা, আর দেরি করা ঠিক হবে না। চলে আসব, এমন সময় আবার ডাক। হাতে রকমারি পদে সাজানো ভাতের থালা এগিয়ে দিলেন দোকানি। সসংকোচে বলে উঠলাম, আমার কাছে পয়সা নেই।
জবাব দিল যুবকের দল, আপনি খেয়ে নিন, পয়সা আমরাই দেব। আপনি আমাদের অতিথি।
ভালোবাসার এই রঙকে ঘৃণার কোনও জালেই বোধহয় আটকে রাখা যায়না।
অপরিচিত দম্পতিই ধরিয়ে দিলেন ফ্লাইট
দক্ষিণ কোরিয়া পরিক্রমা করে রাজধানী সিওলে ফিরে আসছি। আজ রাতেই ধরতে হবে দেশে ফেরার ফ্লাইট। দুপুর একটা। পাহাড়ি পথ এখনো ষাট কিলোমিটার বাকি। পাঁচটার আগে পৌঁছে সাইকেলের দোকানে সাইকেল প্যাক করা চাই। দোকান সব পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়।
কিভাবে পৌঁছাবো বুঝে উঠতে পারছি না। সাই সাই করে ছুটছি সাইকেল পথে, সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ পেরিয়ে। বিকেল চারটে, দূরে দেখা যাচ্ছে সিওল টাওয়ার। পাহাড়ি পথ ছেড়ে, নদীকে পাশে রেখে, হু-হু করে নিচে নেমে আসছি। এক কোরিয়ান স্বামী-স্ত্রী একটি বড় সাইকেলে দুই প্যাডেলে চাপ দিয়ে একসঙ্গে চালিয়ে আসছেন। তাঁদের পাশ কাটিয়ে কিছুটা এগোতে, হঠাৎ পেছনের ক্যারিয়ার ঝুলে পড়লো। তখনও দশ কিলোমিটার পথ বাকি। সাইকেল টানলেও এগোয় না। কি করি!
পাশে তাকাতে দেখি সাইকেল থেকে নেমে এসেছেন স্বামী-স্ত্রী। নিজের ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বার করে কিছু সময়েই সাইকেল ঠিক করে দিলেন ভদ্রলোক। মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, খাবার জল আছে? মহিলা অপ্রস্তুত মুখে বললেন, না, নেই। সাইকেল আবার চলতে শুরু করল। কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে দেখি, স্বামী স্ত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছেন জল আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল হাতে। কোল্ড ড্রিঙ্কসে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে, ভদ্রলোক আবার যন্ত্রপাতি নিয়ে আমার সাইকেল সারাতে নেমে পড়ছিলেন। আমি থামিয়ে বললাম, সাইকেল শহরে পৌঁছেই খুলতে হবে আমাকে। এখন আর বাকিটা ঠিক করার দরকার নেই। আপনি বরং শহরে একটি সাইকেলের দোকানে পৌঁছে দিন।
ওঁদের সাহায্যেই পৌনে পাঁচটায় সিওল শহরে এক সাইকেল দোকানে পৌঁছালাম। শুধু তাই নয়, দোকানদার প্যাকিং করতে কুড়ি ডলার চাওয়ায় তিনি দোকানদারের গজগজানি উপেক্ষা করে নিজেই যন্ত্রপাতি দিয়ে সাইকেল খুলে প্যাকিংও করে দিলেন।
এয়ারপোর্ট পাড়ি দিতে হবে দেশে ফেরার লক্ষ্যে, কিন্তু সেও এক জ্বালা। দূরত্ব বুঝে ট্যাক্সিও অনেকগুলো টাকা চেয়ে বসল। বাসে গেলেই ভালো, কিন্তু সে বাসস্ট্যান্ডও দুই কিলোমিটার দূরে, চিনিও না। এই বিরাট বাক্স নিয়ে যাবো, গাড়িও হাতের সামনে নেই।
দু-এক মিনিট কী করব ভাবছিলাম, তার ফাঁকেই অবাক হয়ে দেখি স্বামী-স্ত্রী তাঁদের বড় সাইকেলটার ঘাড়ে, আমার সাইকেলের বাক্সখানি চাপিয়ে দিয়েছেন। ভদ্রলোক সাইকেল টেনে নিয়ে চলেছেন, তার স্ত্রী পেছনে ঠেলছেন, আমি যেন সেখানে অতিথি মাত্র। অপরের জন্য প্রাণপাতের এমন দৃশ্য আমি জীবনে ভুলব না।
বাসস্ট্যান্ডে যখন পৌছালাম, তখন সন্ধ্যা ছ’টা। পৌঁছেও তারা আমায় ছেড়ে যেতে নারাজ। আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে, বাস এলে সাইকেল তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে ঠিকঠাক নামিয়ে দেবার জন্য বলে দিলেন। বাস ছাড়বে, ধন্যবাদ আর অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হাতখানি বাড়িয়ে দিলাম বললাম, আপনারা যা করলেন তার তুলনা নেই, না হলে হয়তো আমি ফ্লাইটটাই মিস করতাম।
ভদ্রলোক বলে উঠলেন, শুনুন, আমি ধর্মপ্রাণ খ্রীস্টান। আমার ধর্ম বলে, সমস্যায় পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াও। হোক না আপনার ধর্ম কিংবা দেশ আলাদা। আমার সেই কর্তব্য পালন করলাম মাত্র।
আমার বলার ভাষা ছিল না। নিজের হাতখানি অজান্তেই আঁকড়ে ধরল তার হাত। বাস এগোতে লাগল। আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে গেলেন তাঁরা।
মানবিকতার এই জীবন্ত ছবি, জানি না, ধর্মের প্রাচীর দিয়ে আড়াল করা যায় কিনা ?
এই মানবতাই আজ বড় হয়ে উঠুক ভারতে।
Comments :0