(অভিযাত্রী তপন কুমার দাস সাইকেলে ঘুরেছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে। পরিবেশ রক্ষার বার্তা, সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে চলেছে যাত্রা। দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় পেয়েছেন অচেনা-অজানা মানুষের আপ্যায়ন। ধর্ম-ভাষা-দেশের বেড়া ভাঙা নানা ঘটনা বিনিময় করছেন পাঠকদের সঙ্গে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব।)
ছোটবেলায় দেখতাম সুরেলা গানের সুরে হাতের চামর খানি দুলিয়ে বাড়ি বাড়ি আসতেন পীর বাবারা। আমার মায়ের মত অনেক মা-ই এগিয়ে দিতেন তার সন্তানদের একটু আশীর্বাদের আশায়।
বাড়ির কাছেই রয়েছে পুরনো কবরস্থান। আসতেন ইসলামের উপাসকরা, সন্ধ্যায় আলো জ্বালিয়ে নমস্কার করে যেতেন তাদের আরাধ্য দেবতাকে। চলতে চলতে প্রায়শই নজরে আসতো, হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে, কায় মনো বাক্যে একই দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে প্রার্থনা করছেন কোন হিন্দু রমনী। কখনো কারও মনে হয়নি যে বিধর্মীর দেবতার নৈবেদ্য তুলে দিচ্ছেন। আসলে সহস্র বছরের পাশাপাশি অবস্থান শুধু একের প্রতিও আস্থা বৃদ্ধি শুধু নয় অন্য ধর্মের প্রতি সমান বিশ্বাস আর ভরসার জায়গাখানি তৈরি করে দিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সাইকেল নিয়ে ঘোরার সময়েও মিলেছে সেই ছবি।
কাম্বোডিয়ার মসজিদে
এতক্ষণ ওদের কৌতুহলী চোখ আমাদের নাড়ি নক্ষত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মুখ থেকে কথা না খসতেই, হৈ হৈ করে আমাদের ব্যাগ সাইকেল সব নিয়ে এগোতে থাকলো মাদ্রাসার দিকে। ভেতরে বড় হলঘর গোটা দুয়েক। এক ভাগে ওদের শোবার গোটা কয়েক মাদুর পাতা। তারই পাশে ঝাঁড় দিয়ে আরো গোটা দুই মাদুর পেতে তারা বললে,‘‘নাও,শুয়ে পড়ো।" বললাম সে কিরে, স্নান খাওয়া সারবো-না ? স্নান সেরে, চিরঞ্জিতকে খাবার আনতে পাঠাবো, হঠাৎ আরেক ছাত্র এসে হাজির। গাট্টা গোট্টা চেহারা, কিন্তু কথা কইতে পারেনা। ইশারায় কি বলতেই বাকি ছেলের দল নড়ে চড়ে উঠলো। চলো চলো করে আমাদের ব্যাগপত্র নিয়ে এগোতে থাকলো।
আরে চললি কোথায় ?
উত্তর এলো, গুরু মশাই এর আদেশ হয়েছে। তোমরা অতিথি, তোমাদের মসজিদে থাকতে হবে।
বললাম, বেশতো ছিলাম, আবার ওখানে কেন ? কিন্তু গুরু মশাইয়ের আদেশ বলে কথা, আমার কথা শুনবে কেন?
বেশ বড় মসজিদ, কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার। কারেন্ট বাঁচাতে হবে। তাই পাখা যদিও বা চললো, কিন্তু নো লাইট।
অন্ধকারে বালিস মাদুর পেতে দিতে বসলাম। কিন্তু খালি পেটে তো ঘুম আসবে না। তাই, চিরঞ্জিত ওদের নিয়ে চললো খাবারের দোকানে। সামনে প্রায় অন্ধকারে বসে একে অপরের দিকে তাকিয়ে, আমি আর নবাগত সেই মূক বধির বালক। কেন জানিনা, মাঝে মধ্যেই ও আমার হাতটি টেনে ধরার চেষ্টা করছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাষা বোঝবার চেষ্টা করছি। হঠাৎই আচমকা ও যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর, হাত খানা জোরে চেপে ধরল। ঘাবড়ে গিয়ে এই কি করছিস বলে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
পরক্ষণেই আমার ভুল ভেঙে গেল। চোখ ফেটে যেন জল বেড়িয়ে এল। বুঝলাম, অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি, গুরুমশাইয়ের আদেশ, তাই ও আমার হাত-পা টিপে দিতে চায়।
আচমকা মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো, ‘ এরা তো দেবদূত! তাদেরই আমি চোর ডাকাত বলে ভাবছিলাম! নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হল।
বুঝলাম এরকম ভুল ভাবনা, ভুল বোঝাবুঝিই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দুই সম্প্রদায়ের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাড়িয়ে আছে। যে কোন মূল্যে এই প্রাচীর ভাঙতেই হবে আমাদের।
সুলতান মসজিদ, মালয়েশিয়া
চলেছি মালয়েশিয়ার মালাক্কা বন্দর ছাড়িয়ে সিঙ্গাপুরের পথে। সন্ধ্যা পেরিয়ে পৌঁছালাম মাঝারি মাপের এক শহরে। কোথায় থাকা যায়? মসজিদ আছে কী ?
ততদিনে মসজিদে রাত কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। প্রবাসী বাংলাদেশি যুবক জবাব দিল, হ্যাঁ, চলে যান, সামনে সুলতান মসজিদ।
বিরাট চৌহদ্দি নিয়ে গড়ে ওঠা চোখ ধাঁধানো, মালয়েশিয়ার সব চেয়ে বড় মসজিদ। নামাজ শেষ, লোকজন বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা বাইকে, কেউ বা চার চাকায়।
ফাঁকা হতে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। গোলকধাঁধা পেরিয়ে ভেতরে হলে পৌঁছে মৌলবী সাহেবকে নিজের পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করলাম, রাতটা কাটাবো এখানে?
উত্তরে ভদ্রলোক পরম স্নেহে জবাব দিলেন, ‘‘কেন নয় ? কিন্তু এমন দিনে এলেন, আমাদের এখন উপোস চলছে, কি খেতে দিই আপনাকে?’’
কিছুক্ষণ পরে এক রেকাবিতে সুজির বরফি, গোটা কয়েক মিষ্টি, কাটা ফল দিয়ে বললেন, খান খেয়ে নিন। গোটা দুয়েক বাচ্চার সাথে কথা বলতে বলতে ভাবছি, কেন এই মাঝখানের তৈরি করা অদৃশ্য বেড়া? মানবসত্তায় কোনও ফারাক আছে কী?
Comments :0