আসাম-মিজোরাম রক্তারক্তির পর এবার আসাম-মেঘালয় সঙ্ঘর্ষ!
মোদী সরকারের আমলে মঙ্গলবার ফের দুই প্রতিবেশী রাজ্যের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘর্ষের ঘটনা ঘটল। এবার আসাম-মেঘালয় সীমান্তে আসাম পুলিশের গুলিতে এদিন কমপক্ষে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৫ জন মেঘালয়ের খাসি উপজাতি সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ। অপরজন আসাম বন বিভাগের জওয়ান। নিহতদের মধ্যে দু’জন বৃদ্ধ রয়েছেন। এই ঘটনার পরে দুই রাজ্যই একে অন্যকে দোষারোপ শুরু করেছে। প্রসঙ্গত, আসাম-মিজোরাম সীমান্ত রক্তাক্ত হওয়ার মাত্র ষোল মাসের মাথায় এদিন আসাম-মেঘালয় সীমান্তে ফের একই ঘটনা ঘটল।
এদিনের ঘটনার জেরে মেঘালয়ে উত্তেজনা ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আতঙ্কে থমথমে পরিস্থিতি আসামের সীমান্ত অঞ্চলগুলিতেও। মেঘালয়ের শিলং শহরে আসামের বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। হাঙ্গামার খবর মিলেছে আরও কয়েকটি জায়গা থেকেও। পরিস্থিতি সামলাতে মেঘালয়ের ৭ জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, মেঘালয়ে প্রবেশের সবক’টি রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে আসাম। ফলে বহির্রাজ্যের সঙ্গে সড়কপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মেঘালয় সহ আসামের বরাক উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুর। এদিকে, আসামের পশ্চিম কার্বি আংলং জেলায় বন বিভাগের একটি ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা।
সীমান্ত বিরোধ ঘিরে গত বছরের ২৬ জুলাই আসাম-মিজোরাম সীমান্তে দুই রাজ্যের পুলিশের গুলির লড়াইয়ে আসাম পুলিশের ৬ জওয়ান নিহত হয়েছিলেন। সেদিন বিবদমান দুই রাজ্যের মুখোমুখি সংঘর্ষ দেখে গোটা দেশ স্তম্ভিত হলেও মোদী-শাহ ছিলেন নীরব। মঙ্গলবার একই কায়দায় আসাম-মেঘালয় সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরও তারা দু'জন নীরব!
এদিন আসাম-মেঘালয় সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে মেঘালয়ের পশ্চিম জয়ন্তিয়া জেলার মক্রু গ্রামে। জঙ্গলে ঘেরা এই গ্রামটি আসাম সীমান্তবর্তী। এদিন ভোর রাতে ঘটনার সূত্রপাত। গ্রামবাসীরা জানান, তখন রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটে। কয়েকজন গ্রামবাসী কাঠবোঝাই একটি লরিতে করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁরা সকলেই মেঘালয়ের খাসি সম্প্রদায়ের। মাঝপথে তাঁদের গাড়ি আটকান আসামের বন বিভাগের জওয়ানরা। গাড়ি থেকে নামিয়ে ৩ জনকে আটক করে আসামের বন বিভাগ। কিছুক্ষণের মধ্যে আসামের পশ্চিম কার্বি আংলং জেলার জিরিকিংডেঙ থানার পুলিশ এসে ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে ‘আসামের কাঠ চুরির’ দায়ে ৩ গ্রামবাসীকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয়। খবর পেয়ে মক্রু গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাঁরা দাবি করেন, এই এলাকা আসামের নয়, মেঘালয়ের। তাছাড়া আটক হওয়া ৩ জন বন-মাফিয়া নন, উনুনের জন্য এই কাঠ তাঁরা সংগ্রহ করেছেন। প্রতিদিন এই কাজ তাঁদের করতে হয়। কিন্তু আসাম পুলিশ নাছোড়বান্দা হয়ে ৩ জনকে নিয়ে আসামের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
এতেই উত্তেজিত হয়ে মেঘালয়ের জনতা আসাম পুলিশের গাড়ি ঘেরাও করে। অভিযোগ, ঠিক এই সময় হঠাৎ গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি চালায় আসাম পুলিশ। গুলিতে ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু ঘটে। পরে মারা যান আরও ২ জন। গুরুতর আহত হন আরও ২ জন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে গুলি চালিয়ে গাড়ি করে পালিয়ে যান আসাম পুলিশের জওয়ানরা। পুলিশের গুলিতে আসামের বন বিভাগের যে জওয়ান নিহত হয়েছেন, তাঁর দেহ ফেলে আসা হয়।
গ্রামবাসীরা জানান, গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে ভোর পাঁচটা নাগাদ। জঙ্গলের ভেতরে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা দেরি হয়। তবে এরই মধ্যে মেঘালয় সীমান্তবর্তী আসামের বন বিভাগের একটি ক্যাম্পে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। কয়েকটি বাড়িতে হামলারও খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে মক্রুর জঙ্গলের খবর ছড়িয়ে পড়তেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে মেঘালয়ের নানা জায়গা। আসামের কয়েকটি গাড়িতে ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। দুই রাজ্যের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। সকাল সাড়ে দশটায় মেঘালয় সরকার রাজ্যের ৭ জেলায় আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। এদিকে আসাম সরকারও মেঘালয়ে প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেয়। গুয়াহাটি-শিলং জাতীয় সড়কে আসামের জোরাবাটে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড তুলে দেওয়া হয়েছে। একইরকম আসামের কাছাড় জেলার দিগরখালে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি আটকানো হয়েছে। ফলে মেঘালয় সীমান্তের দু’দিকেই কয়েক হাজার গাড়ি আটকে পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সও রয়েছে।
সীমান্ত সঙ্ঘর্ষ নিয়ে এদিন বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করে গোটা ঘটনার জন্য আসাম সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা। তিনি বলেন, আসাম পুলিশ মেঘালয়ে ঢুকে গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। এতে মেঘালয়ের ৫ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন, থাল শাদাপ (৪৫), নিকাশি ধর (৬৫), সিক তালাং (৫৫), তাল নারটিয়াং (৪০) এবং চিরাপ সুমের (৩৫)। এছাড়া পুলিশের গুলিতে আসামের বন বিভাগের গার্ড বিদ্যাসিং লেখথে নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় রাজ্যের সমস্ত সরকারি উৎসব বাতিল ঘোষণা করেছেন সাংমা। এমনকি এই মুহূর্তে রাজ্যে চলতি ‘চেরি ব্লজম উৎসব’ও বন্ধের কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। তাছাড়া মৃত ৫ জনের পরিবারকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের কথাও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী সাংমা।
এদিকে কনরাড সাংমার সাংবাদিক বৈঠকের পর গৌহাটি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে গোলাগুলির ঘটনার তদন্ত ঘোষণা করেছে আসাম সরকার। তদন্ত রিপোর্ট আগামী তিন মাসের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে এই ঘটনা নিয়ে এখনও পর্যন্ত মুখ খোলেননি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা!
উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হলো, গত বছর ১৫ জুলাই শিলঙে উত্তর-পূর্বের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে ‘‘সীমানা বিবাদের নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে’’ বলে বুক ঠুকে দাবি করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর সেই বৈঠকের এগারো দিনের মাথায় ২৬ জুলাই আসাম-মিজোরাম দুই রাজ্যের পুলিশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। একইরকমভাবে, গত ২৯ মার্চ দিল্লিতে অমিত শাহর সীমা বিবাদ নিষ্পত্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন আসাম ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীরা। সেদিন এই চুক্তিকে ‘‘ঐতিহাসিক’’ আখ্যা দিয়ে শাহ দাবি করেন, ‘‘গত পঞ্চাশ বছরে যা কেউ করতে পারেনি, তা এখন বিজেপি সরকার করে দেখালো’’। শাহর এই ‘‘ঐতিহাসিক চুক্তি’’র পর দুই রাজ্যের সীমানা বিবাদ ঘিরে ৬ জনের মৃত্যু হলো! নিহতদের দেহ জোয়াই জেলা হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর বুধবার দেহগুলি নিকট আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে।
বিরোধীরা বলছেন, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে উত্তর-পূর্ব সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আগের সরকারের নীতি ছিল ‘লুক ইস্ট পলিসি’। আমার সরকারের নীতি হচ্ছে ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’।’’ মোদীর এই নীতি আসলে যে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত করে দেওয়া, তা এখন জলের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উত্তর-পূর্বের ৭ রাজ্যেই এনডিএ ক্ষমতায় রয়েছে। বিজেপি তাদের শরিকদের নিয়ে ‘নর্থ ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ (নেডা) গঠন করেছে। নেডা’র আহ্বায়ক হচ্ছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। অথচ সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে এখন রাজ্যে রাজ্যে সংঘর্ষ চলছে। এক রাজ্যের পুলিশের গুলিতে আরেক রাজ্যের পুলিশ কিংবা নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হচ্ছেন।
Comments :0