এক উপজাতি সম্প্রদায়ের কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় আসাম পুলিশের কুকীর্তির নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরিচারিকা হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল পুলিশ। একথা জানিয়েছেন সিআইডি’র তদন্তকারী আধিকারিকরা। হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যার রূপ দিতে পাঁচ লক্ষ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে সিআইডি। এই ঘটনায় ভুয়ো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তৈরির দায়ে মঙ্গলবার তিন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। সোমবার দরং জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেরদিন ধুলা থানার ওসি-কে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু দরং জেলার পুলিশ সুপার এখনও ফেরার। তাঁর বাড়িতে মঙ্গলবারও তল্লাশি চালায় তদন্তকারী সংস্থা। কয়েকমাস আগে রাষ্ট্রপতি কালার পাওয়া আসাম পুলিশের ফের মুখ পুড়লো।
উল্লেখ্য,গত জুন মাসে রাজ্যের দরং জেলার ধুলা থানার অধীন ঢেকিয়াজুলি এলাকার এসএসবি জওয়ান কৃষ্ণকমল বরুয়ার বাড়িতে তেরো বছরের কিশোরী ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। কিশোরী ওই বাড়িতে পরিচারিকার কাজে নিযুক্ত ছিল। সেদিন তার মৃত্যুকে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালিয়ে দেয় পুলিশ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও কিশোরী আত্মহত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তার পরিবারের লোকেরা তা মানতে পারেননি। কিশোরীর মা-বাবার অভিযোগ করেন, তাদের মেয়েকে খুন করা হয়েছে। কারণ,মৃতদেহের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। গোপনাঙ্গে রক্তের দাগ ছিল। এই মৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা রাজ্য। বিভিন্ন দল-সংগঠন মৃতার পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। আন্দোলনের চাপে ফের ময়নাতদন্ত করতে বাধ্য হয় পুলিশ। দ্বিতীয়বারের ময়নাতদন্তে কিশোরীকে ধর্ষণ করার প্রমাণ মেলে। ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা পরে আরতির গৃহকর্তা কৃষ্ণকমল বরুয়া ধর্ষণ করেছে। ময়নাতদন্তের এই রিপোর্ট আসার পর আসাম পুলিশের ভূমিকার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন দরঙের মানুষ। সরকারের মুখ বাঁচাতে ওই কিশোরীর বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। সেদিন তিনি এই ঘটনার তদন্তের ভার সিআইডি’র হাতে তুলে দেন। ডিআইজি দেবরাজ উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের সিআইডি’র বিশেষ টিম গত ১২ আগস্ট তদন্ত নামে। সিআইডি’র তদন্তে ভয়ঙ্কর তথ্য সামনে আসে। দেখা যায় মৃতদেহ উদ্ধারের সময় ভিডিওগ্রাফি করেনি পুলিশ। এমনকি ফুটপ্রিন্টও নেওয়া হয়নি। সেদিন ধর্ষক কৃষ্ণকমল বরুয়াকে জেরার পর আসল তথ্য পায় তদন্তকারী দল। মোটা টাকার বিনিময়ে কিশোরীর মৃত্যুকে আত্মহত্যার রূপ দিতে ওসি উৎপল বরা একাজ করেছে, তা সামনে আসে। তখন বিপদ বুঝে দুবাই পালায় ধুলা থানার ওসি উৎপল বরা। দুবাই থেকে জরুরি তলব করে ওসি বরাকে আসামে আনা হয়। গত ১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তারপর সিআইডি জেরায় ভেঙে পড়ে ঘটনা খুলে বলে ওসি। সে এই কাজ করেছে পুলিশ সুপার রাজমোহন রায় ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রূপম ফুকনের নির্দেশে এই ঘৃণ্য কাজ করেছে বলে স্বীকার করে ওসি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আত্মহত্যার কথা লিখতে মঙ্গলদৈ হাসপাতালের তিন চিকিৎসক মোটা টাকা নিয়েছেন বলেও জানায় ওসি। তাঁর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গত ৬ নভেম্বর পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রূপম ফুকনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৭ নভেম্বর মঙ্গলদৈ হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ অরুণ ডেকা,ডাঃ অনুপম শর্মা ও ডাঃ অজন্ত বরদলৈকে আটক করে তদন্তকারী সংস্থা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়।এদিন তিন চিকিৎসক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে গুয়াহাটির বিশেষ আদালতে সোপর্দ করে দু'দিনের হেপাজতে এনেছে সিআইডি।
মঙ্গলবার সিআইডি’র মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রাজীব শইকিয়া সংবাদমাধ্যমকে জানান, দরঙের পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার,ধুলা থানার ওসি ও তিন চিকিৎসক মিলে আরতির খুনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এজন্য ধর্ষণে অভিযুক্ত কৃষ্ণকমল বরুয়ার কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিয়েছে। শইকিয়া জানান, একমাত্র পুলিশ সুপার ছাড়া বাকি অপরাধীরা ধরা পড়েছে। পুলিশ সুপারকে শীঘ্রই জালে পুরা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে এই ঘটনায় আসাম পুলিশের ভূমিকা ফের প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়েছে। মোটা টাকার বিনিময়ে এক গরিব উপজাতি সম্প্রদায়ের কিশোরীর মৃত্যু ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল পুলিশ। কিছুদিন আগে তিনসুকিয়ার পুলিশ সুপার দেবজিৎ দেউরির এক অডিও টেপ ভাইরাল হয়। এতে তিনি দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই শোনিতপুর জেলার পুলিশ সুপার সুশান্তবিশ্ব শর্মা ভুয়ো এনকাউন্টারে তিনজনকে হত্যা করেছেন। দেউরির এই অভিযোগ সামনে আসার পর আশ্চর্যজনকভাবে আজও তদন্ত করেনি রাজ্য সরকার।
Comments :0