‘ওরা বাঁচার জন্য চিৎকার করছিল। কিছু করতে পারলাম না আমরা। চোখের সামনে ঝলসে শেষ হয়ে গেল। ওদের কি অপরাধ ছিল গো...’ একটানা বিলাপ করে চলেছেন হরিমোহন ঘোষের পরিবারের লোকেরা। খোয়াই শহরের লালছড়া ঘোষপাড়া এলাকায় বাড়ি হরিমোহন ঘোষের। মঙ্গলবার গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে, সিপিআই (এম) কর্মীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিজেপি দুষ্কৃতীরা। সেই আগুনেই ঝলসে গিয়েছে দুটি প্রাণ। সারা গায়ে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে ধুঁকছে আরেকটি।
গোমাতার জন্য উৎসর্গীকৃত মোদী-শাহের বাহিনী প্রথমেই আগুন লাগায় গোয়াল ঘরে। দুটি গাভী আর একটি বলদ ছিল। গেরস্থালির আরও কিছু জিনিসপত্রও ছিল সেখানে। শীতের শেষের এই শুকনো সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। গোয়াল ঘরের খুঁটে বাঁধা অবলা প্রাণীগুলি আগুনের জ্বালা নিয়ে বাঁচার তাগিয়ে আর্ত চিৎকার করতে থাকে। পাশের বাড়ির লোকেরা প্রথম আগুন দেখে হইচই করতে শুরু করলে হরিমোহন ঘোষের পরিবারের লোকেরা বাইরে এসে দেখে গোটা গোয়াল জ্বলছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা জল ঢেলে আগুনের প্রকোপ কমিয়ে গোরুগুলিকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু তখনই ওই ঘরের কোনে রাখা একটি গ্যাস সিলিন্ডারে প্রবল বিস্ফোরণ হয়। এরপর আগুন নাগালের বাইরে চলে যায়। আমাদের আর কিছুই করার ছিল না, কান্নাবোজা গলায় বললেন কার্তিক ঘোষ।
ত্রিপুরায় জয়ের পর থেকে বিজেপি দুষ্কৃতীদের অবর্ণনীয় সন্ত্রাসের কবলে সমাজের সব অংশের মানুষ। এমনকি অবলা প্রাণীগুলিও ছাড় পাচ্ছে না। শুধুমাত্র সিপিআই (এম) কর্মীর বাড়িতে পালিত তারা, এই অপরাধে অবলা জীবগুলিকেও এইরকম নৃশংসতায় হত্যা করতে হাত কাঁপেনি গেরুয়া বাহিনীর। দেশজুড়ে যারা গোরক্ষার নামে মানুষ খুন করে অবলীলায়। তারা ত্রিপুরায় জয়ের আনন্দে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে গোরু। গোটা রাজ্যে চলছে বহ্ন্যুৎসব। সিপিআই (এম) কর্মীদের বাড়ি-ঘর, রিকশা-টোটো, অটো-গাড়ি, রবার বাগান সব জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না পরীক্ষার্থীদের বই-খাতা পর্যন্ত। মুহূর্তে ছাই হয়ে যাচ্ছে গেরস্তালির সবটুকু, রুটি-রুজির সংস্থান, জীবনের সব সঞ্চয়, ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন।
দমকল সূত্রে জানা গেছে, ২ তারিখ ফলপ্রকাশের রাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত গোটা রাজ্যে আগুন নেভানোর জন্য ২৩৮টি ফোন পেয়েছে দমকল বাহিনী। অর্থাৎ পাঁচ দিনে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি করে আগুন নেভানোর ফোন গেছে দমকলে। যদিও প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি। যেসব আগুন স্থানীয়রা জল ঢেলে নেভাতে পেরেছেন, সেগুলির ফোন যায়নি দমকলে। তাছাড়াও রাবার বাগান ইত্যাদির আগুনের কথা জানাতে জানতেই তা প্রায় জ্বলে ছাই হয়েছে। দমকলকে ডাকার কোনও সুযোগ মেলেনি।
বুধবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই প্রতাপগড়ের সদ্য নির্বাচিত সিপিআই (এম) বিধায়ক রামু দাসের বাড়ি সহ ৬টি বাড়িতে আক্রমণ করে বিজেপি দুষ্কৃতীরা। হামলা করেছে পুলিশের গাড়িতেও। বিজেপি দুষ্কৃতীরা রামু দাসের ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মা’কেও মারধর করে। আহত অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজ্য ছাড়ার আগেই এই আক্রমণ করা হয়। ইতিমধ্যেই সোনামুড়া এবং বক্সনগরের দুই সিপিআই (এম) বিধায়ক প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাধারঘাট বিধানসভা কেন্দ্রের বৈষ্ণবটিলায় ব্যাপক সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। বিজেপি’র হামলায় কম করে ১০ জন সিপিআই (এম) এবং কংগ্রেস কর্মী সমর্থক আহত হয়েছেন। ৫টি বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণে আহত হয়েছেন পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা শাসক অফিসের কর্মচারীরা সুকান্ত পাল। শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের সরকারি দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর গাড়ি আটকে মারধর করা হয়েছে। আহত হয়েছেন রতন বণিকের স্ত্রী মালতি পাল। দায়ের কোপে জখম পার্টিকর্মী তাপস পাল। প্রসেনজিৎ চক্রবর্তীর বাড়ি ঘর ভেঙে তাঁর বৃদ্ধ মা মঞ্জুরানী চক্রবর্তীর হাত ভেঙে দিয়েছে মোদী-শাহের বাহিনী। দিনমজুর সুজিত সরকারের বাড়িও ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। আক্রমণ করা হয়েছে কংগ্রেস নেতা উত্তম সরকারের বাড়িতেও।
রাতের অন্ধকারে রাজনগর বিধানসভার সোনাপুরের স্বপন পালের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঋষ্যমুখ বিধানসভার পার্টিকর্মী চিকন্তি চাকমা, গোকুল মজুমদার, গোবর্ধন দাস, লাকরই মগের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শপথ অনুষ্ঠান চলার সময়েই হামলা চলতে থাকে। ঋষ্যমুখের আমজাদ নগরীর ক্যানসারে আক্রান্ত মৃত্যুশয্যায় হতদরিদ্র তারা মিয়ার বাড়িতে হামলা করা হয়। বিলোনিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের চিত্তামারা এলাকার ধনেশ্বর ত্রিপুরার রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয় গেরুয়া বাহিনী। বড়টিলা এলাকার অর্জুন দাসের রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়। রাজনগর বিধানসভা কেন্দ্রের চোত্তাখোলা এলাকার মলেনদ্র ত্রিপুরা বুধবার দুপুরে নিজ বাড়িতেই আক্রান্ত হয়। আমজাদ আমজাদ নগরের বেলাল মিয়া এবং মাফ্রু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করা হয়৷ এছাড়া এলাকায় থাকতে গেলে প্রচুর পরিমাণে চাঁদা দিতে হবে বলে হুলিয়া জারি করছে বিজেপি। যুবরাজনগর বিধানসভা কেন্দ্রের পশ্চিম দেওয়ানপাশার নিবাসী ৬৫ বছরের বিধবা মা পূর্ণিমা দেব ও রেহাই পেলেন না বিজেপি দুষ্কৃতীদের হাত থেকে। রক্তাক্ত হয়ে মাথায় ৮টি সেলাই পড়েছে। হাত ভেঙেছে কয়েক জায়গায়।
বুধবার সকালে যখন আগরতলায় আস্তাবল ময়দানে নতুন মন্ত্রীসভার শপথ অনুষ্ঠানে হাত নাড়ছেন মোদী-শাহরা, তখন খোয়াই পৌরসভার টিম এসে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া গোরু দুটিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে লালছড়া ঘোষ বাড়ি থেকে। সারা শরীরে আগুনে ঝলসে যাওয়ার জ্বালা নিয়ে আরেকটি গাভী চেয়ে আছে তাদের দিকে। চোখের কোল গড়িয়ে নেমেছে জলের ধারা। সে কি শুধুই শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায়, নাকি সঙ্গীদের মর্মান্তিক পরিণতির জন্যেও- বুঝিয়ে বলতে পারবে না।
ঘোষ পরিবারের আর প্রতিবেশী মহিলারা আঁচলের খুঁটে চোখ মুছছেন। একটাই প্রশ্ন তাদের, আমরা লালপার্টি করি কিন্তু ওদের কী দোষ ছিল? অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে অশ্রুসজল মায়েদের অস্ফূট আর্তি, ওদের যেন শাস্তি হয়। খোয়াইয়ের লালছড়ার ঘোষপাড়ার হাহাকারে যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো সাহিত্যের পাতার গফুরের সেই হৃদয় বিদারক আর্তি, ‘মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে।... তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ করো না।’
Comments :0