রয়েছে কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী। তাও সরকার পোষিত স্কুল এবং মাদ্রাসায় বেড়েছে ‘ড্রপ আউট’। বেড়েছে নাবালিকার বিবাহও।
রাজ্যের শিক্ষক মহলের একাংশের কথায়, করোনা অতিমারীর কারণে যে ‘ড্রপ আউট’ বা স্কুলছুট বেড়েছে তা নয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই সরকারি স্কুল এবং মাদ্রাসাগুলিতে কমছে পড়ুয়ার সংখ্যা। প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। কাজে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে স্কুলে পড়ার সময়েই। অনেকে চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যেই। অনেক পরিবার বিয়ে দিয়ে ফেলছে।
তথ্য জানাচ্ছে, নাবালিকা বিবাহে দ্বিতীয় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। প্রথম ঝাড়খন্ড। রাজ্যে নাবালিকা বিবাহের হার ৫৪.৯ শতাংশ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘‘গত তৃতীয় পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন যেখানে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা দিচ্ছে, প্রায় কুড়ি শতাংশ স্কুলছুট আমরা দেখেছি। গত ২০২২ সালের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক টেস্টেও পরীক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ স্কুলছুট হয়েছে।’’
শিক্ষক শিক্ষিকাদের কথায় যারা স্কুলে আসছেন না পরীক্ষায় বসছেন না তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত স্কুলে আসতেন। তারা স্কুলে না আসায় স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে খবর নিয়ে জানা যায় তাদের অনেকেই কাজের জন্য সপরিবারে ভিন রাজ্যে কাজে চলে গিয়েছে।
কলকাতা সহ রাজ্যে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। কী কারণে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা?
শিক্ষক মহলের কথায় নিজেদের পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে তাঁদের এই পথ বেছে নিতে হচ্ছে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান ২০২২ সালে সাতজন ছাত্র- ছাত্রী মাধ্যমিককের অ্যাডমিট কার্ড নেয়নি। সেই সময়েও স্কুলের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। জানা যায় যে হয় কারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে বা কেউ টাকার অভাবে লেখাপড়া ছেড়ে কাজে যোগ দিয়েছে।
সুদীপ্তা হালদার। কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাই স্কুলের ছাত্রী ছিল। তাঁর এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ার কথা। কিন্তু সে এখন লেখা পড়া ছেড়ে বাবাকে সাহায্য করতে কাজে ঢুকেছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কিছুটা ইতস্তত করে জানাচ্ছে, টাকার অভাবে লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হয়। সুদীপ্তার বাবা ছোট কারখানায় কাজ করেন। লকডাউনের পর থেকে আয় কমেছে। সংসারের সঙ্গে মেয়ের লেখাপড়া চালানো সম্ভব হচ্ছিল না আর।
সুদীপ্তা একা নয়। সুদীপ্তার মতো আরও অনেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সুদীপ্তারা তো ‘কন্যাশ্রী’ পাওয়ার যোগ্য। শুধু স্কুল নয়, কলেজে পড়ার সময়তেও সে কন্যাশ্রীর টাকা পাবে। তাহলে কেন সে ছাড়ছে লেখা পড়া? জানা গিয়েছে, বার বার আবেদন করেও কন্যাশ্রী সে পায়নি। স্কুল থেকে বিডিও অফিস, এমনকি স্থানীয় তৃণমূল পার্টি অফিস- কোথায় না দৌড়েছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি।
কন্যাশ্রী পাচ্ছেন এমন ছাত্রীরাও লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কন্যাশ্রীতে বছরে দেওয়া হয় ১ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকায় একমাসের পড়ার খরচও ওঠে না।
মুর্শিদাবাদের দেবকুণ্ড শেখ আব্দুর রাজ্জাক মেমোরিয়াল গার্লস হাই মাদ্রাসা। সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েরা এই স্কুলে পড়েন। কিন্তু শেষ এক বছরে ব্যাপক ভাবে কমেছে ছাত্রী সংখ্যা। ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষিকা মুর্শিদা খাতুন বলেন, ‘‘লকডাউনের পর থেকে অনেক ছাত্রী স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে হয় কারুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে বা কেউ বাইরে চলে গিয়েছে কাজের জন্য।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে কখনও বাল্য বিবাহ আটকানোর জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা কয়েক জন ছাত্র ছাত্রীকে নিয়ে বাল্য বিবাহ আটকানোর জন্য চেষ্টা করেছি। অতীতে সেই কাজ আমরা সফলও হয়েছি। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যোগাযোগ নষ্ট হওয়ায় সেই কাজে খামতি দেখা দিয়েছে।’’
শুধু মুর্শিদাবাদ নয়। একই ছবি দেখা যাচ্ছে রাঢ় বঙ্গের আরও এক জেলা বাঁকুড়ায়। বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, রায়পুর অঞ্চলে ছেলের সমান সমান মেয়েরাও বাইরে চলে যাচ্ছে কাজের জন্য। আবার অনেক জায়গায় শিশু শ্রমিকের কাজও তারা করছেন। শিক্ষিকা অস্মিতা দাশগুপ্তের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘রোজগার বন্ধ থাকার কারণে অনেক গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা ১০০ টাকা ৫০ টাকা মজুরিতে ইটভাটা বা জোগাড়ের কাজে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে বাল্যবিবাহও বাড়ছে।’’ মেয়েদের পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন রাজ্যে চলে যাওয়ার পিছনে পাচার চক্রের দিকটিকে কোনও ভাবেই খাটো করে দেখছেন না শিক্ষকরা।
শিক্ষক শিক্ষিকাদের দাবি বাল্য বিবাহ আটকানোর বিষয় বার বার প্রশাসন ব্লক আধিকারিকদের বলা হলেও প্রশাসন এই বিষয় কোন সদর্থক ভূমিকা নেয়নি। গ্রামে গ্রামে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে কোন প্রচারও তারা করেননি, শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ বারেবারে এই অভিযোগ তুলছে। বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া জন্য প্রশাসনের কাছে দাবিও জানাচ্ছে।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথায়, শিক্ষায় দুর্নীতির প্রভাবও পড়েছে পড়ুয়া এবং অভিভাবকদের মনে। অভিভাবকদের মনে ধারনা হচ্ছে, লেখাপড়া শিখে লাভ নেই। কারণ ঘুষের মোটা টাকা না দিতে পারলে চাকরি পাওয়া এখন আর সম্ভব নয়।
Comments :0