শান্তনু চক্রবর্তী
বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক তথা গণিতজ্ঞ পরিসংখ্যানবিদ ডি ডি কোশাম্বি ভারত-ইতিহাসের উপাদান প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ভারতবর্ষ এমন একটা দেশ, যেখানে সভ্যতার ইতিহাস কয়েকশো বছর একই সঙ্গে অবস্থান করে— আর সেটা মাটির ওপরেই। সে জন্যে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের দরকার হয় না। বিশ বা একুশ শতকের প্রযুক্তি-নির্ভর, হইহই করে ছুটে চলা নাগরিক জীবনযাপনের আরাম-আয়েশ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে দু’পা ফেললেই বা দেশের অন্দরমহলে কয়েকশো কিলোমিটার গেলেই দেখা যাবে সভ্যতা-প্রগতি-উন্নয়ন যেন এক ধাক্কায় কয়েকশো বছর আগে থমকে গেছে। আধুনিক আর প্রাগাধুনিক ভারতবর্ষ যেন একই সময়ে, একই সার্বভৌম ভূ-খণ্ডের ওপর পাশাপাশি, হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে!
কোশাম্বি কথাটা বলেছিলেন সমাজ-সভ্যতা-ইতিহাসের অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে দেশের একটা বিরাট অংশে বিশেষ করেছিলেন অর্থনীতিতে ‘উন্নত’ মহারাষ্ট্রে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও রাজনৈতিক উদ্যোগে সময়টাকে সোয়া ৩০০ বছর পিছিয়ে মুঘল যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। আসলে মুঘলদের মতো জবরদস্ত প্রতিপক্ষ খুঁজে না পেয়ে, একেবারে পাতি বিশুদ্ধ ভারতীয় মুসলিম জনতাকেই বাবর-আওরঙ্গজেবের ‘আওলাদ’হিসাবে ধরে নিয়ে তাদের ওপরেই ঝাল মিটিয়ে নেওয়ার পুরো বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। হলিউডের কাল্ট ছবি ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’-এর ২৫ বছরে সমাজ মাধ্যমে একটা ইংরেজি শব্দ নতুন করে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে ‘সিমুলেশন’। যার মানেটা হলো নিজেদের মর্জিমাফিক একটা ‘ভার্চুয়াল’ দুনিয়া বানিয়ে নিয়ে সেটার মধ্যেই বসবাস করা। সাম্প্রতিক বলিউডি ছবি ‘ছাওয়া’-কে ঘিরে সে রকমই একটা কাণ্ডকারখানা ঘটে চলেছে। আমাদের স্কুল-পাঠ্য ইতিহাসের বইয়ে অনালোচিত, প্রায় অপরিচিত ফুটনোট-সম সম্ভাজিকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন মারাঠি সাহিত্যিক শিবাজি সামন্ত। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের এই বড়পুত্রটি যেখানে মুঘল ও মারাঠা ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ প্রবাদপ্রতিম স্যার যদুনাথ, এমনকি হিন্দুত্ববাদের বিশাল বীরপুরুষ স্বয়ং সাভারকারের কলমেও মাতাল-লম্পট-দুশ্চরিত্র কিংবা ভীরু-কাপুরুষ-অপদার্থ শাসক হিসাবে নিন্দিত, ধিক্কৃত, সেখানে সাওন্তের উপন্যাসে সম্ভাজি পরাক্রান্ত, দুর্ধষ যোদ্ধা-ইসলামী মৌলবাদী সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে হিন্দু-প্রতিরোধের ট্র্যাজিক বীর শহীদ!
সাওন্তের ‘ছাওয়া’ উপন্যাস থেকে আগেই মঞ্চসফল জনপ্রিয় নাটক হয়েছে মারাঠি ভাষায়। এবার তো লক্ষ্মণ উতেকরের পরিচালনায় বক্সতাফিসে রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙে দেওয়া বলিউডি মেগাহিট সিনেমাও বাজারে এসে গেল। আর উপন্যাস, নাটক যেটা করতে পারেনি, সিনেমা সেটা করে দেখিয়ে দিল। একটা গোটা রাজ্য, একটা দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষকে একটা আশ্চর্য ‘সিমুলেটেড’ পৃথিবীতে নিয়ে গেল। সেখানে আমাদের চারপাশ থেকে একুশ শতকের ভারত তার ভারে দারিদ্র, বেকারত্ব, অসম উন্নয়ন কাজের খোঁজে ভেসে বেড়ানো অসংগঠিত শ্রমিক-বাহিনী। ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকের আত্মহত্যা, ক্রেতার অভাবে মুখ চুন করে বসে থাকা ছোট দোকানদার, বর্ণহিন্দুর কুয়ো বা সরকারি নলকূপের জল ছুঁয়ে দেওয়ার ভয়ানক অপরাধে ধর্ষিত-নিহত দলিত-কন্যার লাশ-সবশুদ্ধ কী অলৌকিক বাষ্পের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে! আমাদের ঘিরে জেগে উঠছে ১৭ শতকের শেষের দুটো দশক! যেন একুশ শতকের আমাদের সব সমস্যার বেমালুম সমাধান হয়ে গেছে— শুধু দাক্ষিণাত্য কার দখলে থাকবে মুঘল না মারাঠা, সেটাই যেন ভারতবর্ষের আজকের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!
‘সোনার কেল্লা’য় লালমোহনবাবুর কাছে জং ধরা একটা ভোজালি দেখে মন্দার বোস জিজ্ঞেস করেছিল, কোন্ পক্ষে লড়ছেন, মুঘল না রাজপুত্র? কিন্তু ‘ছাওয়া’ ঘিরে যে ‘সিমুলেশন’ ‘ভার্চুয়াল’ ইতিহাস বা ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর রাজনীতি, সেখানে এই ‘পক্ষ’ নেওয়ার কোনও ‘চয়েস’ নেই! কারণ এখানে সবাই অবশ্যই আওরঙ্গজেবের বিপক্ষে এককাট্টা। মহারাষ্ট্রে সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক যখন মিন মিন করে একটু বলতে গিয়েছিলেন, সিনেমার যতটা দেখানো হয়েছে, আওরঙ্গজেব ঠিক অতটাও খলনায়ক ছিলেন না অমনি তাঁকে বিধানসভা থেকে নিলম্বিত বা সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়। কেন? কারণ তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছেন! এখন এই ‘ভাবাবেগ’ তো অত যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। তাই তাকে যদি বোঝাতে চান, আওরঙ্গজেবের গোঁড়া সুন্নি মুসলিম হলেও, কট্টর ?? প্রতি তাঁর পক্ষপাত থাকলেও প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি তত হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগি করতেন না ভাবাবেগ সেকথা শুনবে না। তাই আপনি যতই হিসাব দিন তথাকথিত উদারপন্থী, তুলনামূলকভাবে বেশি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দিনইলাহি’র প্রবক্তা আকবরের রাজত্বকালে মুঘল-প্রশাসনে পদস্থ হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা যেখানে ছিল ২০-২১ শতাংশ, আওরঙ্গজেবের সময় সেটাই বেড়ে প্রায় ৩২ শতাংশ হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবাবেগের তাতে কিছু এসে যাবে না। যদি বলেন, মহামণি আকবরের আমলে যে দক্ষিণ এশীয় অর্থনীতি চীনের পরে দ্বিতীয়স্থানে ছিল, আওরঙ্গজেবের শাসনকালে সেটাই দুনিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল, ভাবাবেগের বন্যায় সেসব পরিসংখ্যান কোথায় ভেসে যাবে, খুঁজেই পাওয়া যাবে না!
এরপরেও যদি কেউ পাকামো দেখিয়ে, সতীশচন্দ্র, এম আজহার আলির মতো আলিগর-ঘরানার, মার্কসবাদ ঘেঁষা, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক ইতিহাস-চর্চার কারবারীদের উদ্ধৃত করে বলে যে ফেলেন আওরঙ্গজেব যেমন কিছু মন্দির ধ্বংস করেছেন, তেমনই অনেক হিন্দু মন্দির নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মুঘল রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দও করেছেন, তাহলে তো আর রক্ষা নেই! একুশ শতকের ‘হিন্দু পাদ-পাদশাহী’ আপনার ভূমিশয্যা নিশ্চিত করবে। সপা বিধায়ক আবু হাসমির উদাহরণ তো চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে। এমনকি যাঁরা ‘ছাওয়া’ নিয়ে এই গণহিস্টিরিয়া, কল্পকাহিনি ও ইতিহাসকে ঘুলিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক টেনশন। তৈরির ফিকির বা খামোকা ৩১৮ বছর আগে কবর দেওয়া আওরঙ্গজেবের সমাধি উপড়ে ফেলে দেওয়ার বেমক্কা বায়নার তীব্র বিরোধিতা করছেন, তাঁরাও অনেকেই বলেছেন, উত্তেজনার এই তীব্র বাতাবরণে সমাজবাদী বিধায়ক খামোকা এর মধ্যযুগীয় স্বৈরশাসকের পক্ষে কথা বলতে গেলেন কেন? একজন সংখ্যালঘু বিধায়ক যদি জনপ্রিয় সিনেমার ‘টার্গেট’ খলনায়কের পক্ষে ইতিহাসের যুক্তি সাজাতে বসেন। তাহলে তো হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে গোটা সম্প্রদায়কেই আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারী হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলাটাই অনেক সহজ হয়ে যায়! সঙ্ঘ-পরিবার সেই সুযোগটা যাতে না পেয়ে যায়, সে জন্যেই বাড়তি সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
এখন এই সতর্কতার বার্তায় তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ‘প্র্যাগম্যাটিজম’ বা চালাকি যতটা আছে, প্রাজ্ঞতা ততটা নেই। আর এখানেও তো সেই সত্যি ইতিহাসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভার্চুয়াল ইতিহাসের বুদ্বুদের অন্দরে বাস করাটাকেই মান্যতা দিয়ে ফেলা হয়, সেখানে সম্ভাজী ‘ছাওয়া’ বা সিংহ-শিশুর মতই দুর্জয়, দুঃসাহসী। এই ‘সিমুলেটেড’ বীরপুরুষ মুঘলদের দূর্গ দখল করতে গিয়ে কম্পিউটার নির্মিত মানুষখেকো সিংহের সঙ্গে খালি হাতে লড়ে যেতে পারেন। ইতিহাসের পাতায় তাঁর কাপুরুষতা নিয়ে যাই লেখা থাকুক, সঙ্গমেশ্বর প্রাসাদ-দুর্গের শেষ যুদ্ধে একাই কয়েকশো মুঘল সেনার মহড়া নিতে পারেন। বন্দিদশাতেও নিষ্ঠুর অত্যাচারী ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবের চোখে চোখ রেখে, সনাতন হিন্দুত্বের এমন তেজ দেখাতে পারেন যে, সম্ভাজির চোখ উপড়ে, জিভ কেটে, ফাঁসিতে ঝুলিয়েও তাঁকে দমাতে পারেন না মুঘল বাদশাহ। বরং হিন্দুত্বের এই জবরদস্ত আইনককে হাতের মুঠোয় পেয়েও তাঁকে ধর্মান্তরিত করতে না পারার চরম হতাশায় নিজেই হার্টফেল করে মারা যান! ময়দানি লড়াইয়ে সমূহ পরাজয়ের পরেও মতাদর্শেই নৈতিক যুদ্ধে হিন্দুত্ববাদ তার চূড়ান্ত জয় পেয়ে যায়।
আসলে এটাই সিনেম্যাটিক ছাড়পত্রের আড়ালে বা ছদ্মবেশে হিন্দুত্বের বড় ন্যারেটিভ নির্মাণের প্রয়াস। কারণ ইতিহাস বলছে, ১৬৮৯ সালে বন্দিদশায় ছত্রপতি সম্ভাজী নিহত হওয়ার পরেও আওরঙ্গজেব আরও ১৮ বছর রাজত্ব করেছেন। ১৭০৭ সালে গুজরাটের আহমেদনগরে তাঁর মৃত্যু হয় এবং মহরাষ্ট্রের ঔরাঙ্গবাদের (অধুনা নাম সম্ভাজীনগর) কাছে খলুতাবাদে তাঁকে তাঁর আর পাঁচজন প্রজার মতই খুবই সাধারণভাবে সমাধিস্থ করা হয়। ইতিহাস আরও বলছে সম্ভাজীকে শায়েস্তা করার জন্য আওরঙ্গজেব সেই যে দিল্লি ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে এসেছিলেন, সম্ভাজীকে হত্যা করার পরেও তাঁর আর রাজধানীতে ফেরা হয়নি। দাক্ষিণাত্যের মাটিতেই তাঁর শেষশয্যা রচিত হয়। তাই ‘ছাওয়া’ ছবির শেষে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুদৃশ্য ঐতিহাসিক না হলেও, তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতনের প্রতীক হিসাবে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সিনেমার আওরঙ্গজেবের ওইটুকু প্রতীকী মৃত্যু ও নৈতিক পরাজয়ে হিন্দুত্ববাদের মন ওঠে না। তারা তাই মুঘল বাদশার সাদামাটা কবরখানা ও দেহাবশেষকে অবমানিত ও ধ্বংস করে ইতিহাসের শোধবোধ করতে চায়। আওরঙ্গজেবের যেন এই সময়ের উপমহাদেশীয় কোনও রাষ্ট্রনায়ক বা আধুনিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মুখ্য-প্রশাসক, এমনভাবেই তাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। আর সাম্প্রদায়িক আক্রোশ, জিঘাংসা ও প্ররোচনাকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই সেই খড়ের পুতুলের সঙ্গে ইসলামের কিছু পবিত্র চিহ্ন, প্রতীক বা প্রার্থনার মন্ত্রও দাহ করা হয়।
আদতে এই দহন বা দাহ শুধু এক মধ্যযুগীয় ফিউডাল শাসকের কুশপুতুল বা তার গায়ে জড়ানো কোরান-এর আয়াত লেখা সুবজ চাদরেই পোড়াচ্ছে না। একই সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্র, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার অবশিষ্ট আদর্শগুলিকেও পুড়িয়ে ছাই করছে। এই দহন এক অন্ধত্বকে নির্মাণ করছে। এই অন্ধত্ব আবার নির্মাণ করছে কল্প-ইতিহাসের ভার্চুয়াল দুনিয়া। সেখানে সপ্তদশ শতকের মুঘল আর মারাঠার ক্ষমতা দখলের লড়াইকে অনায়াসে প্রতিস্থাপিত করে দেওয়া যাচ্ছে গর্বিত হিন্দুত্বের নতুন স্লোগানে। শিবাজি মহারাজের ‘স্বরাজ’-এর স্বপ্নকে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুরাষ্ট্রের নীল-নকশার সঙ্গে একাকার করে দেওয়া হচ্ছে। কমিউনিস্ট নেতা ও কুসংস্কার-বিরোধী গণআন্দোলনের নিহত সৈনিক কমরেড গোবিন্দ পানসারে, সাড়ে তিন দশক আগে মারাঠি ভাষায় লেখা তাঁর অসামান্য বই ‘শিবাজি’ কোন্ হোতা? (ইংরেজি অনুবাদে ‘পৃ ওয়াজ শিবাজি?’)-য় দেখিয়েছেন। হিন্দুবাদীরা কিভাবে শিবাজির ধর্মনিরপেক্ষ শাসকের ভাবমূর্তি বিকৃত করছে। হিন্দু-মুসলিম দলিত-মারাঠা সহ গোটা মহারাষ্ট্রবাসীর প্রাণের লোকনায়ককে। ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’, হিন্দুত্ববাদী ব্র্যান্ড-ওয়াগন বানিয়ে তোলা হচ্ছে। ‘জয় শিবাজি’, ‘জয়ভবানি’ ?? দিয়ে দলিত-বস্তি বা মুসলিম-মহল্লায় হামলা চালানো হচ্ছে।
পানেসর ১৯৮৮ সালে যা লিখেছিলেন, এই ২৩-২৫’এ ‘ছাওয়া’ সিনেমাকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা বাধানো হলো। সেখানেও সেই একই ‘মোডাস অপারেন্ডি’ দেখা গেল। অর্ধেক ইতিহাস আর বাকিটা কল্পনার ওপর ভরসা করে এবং দেশের আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী অবধি আওরঙ্গজেবের কবর উপড়ে ফেলার দাবি তুললেন। অথচ এই ইতিহাসটা কারোর খেয়াল রইলো না, সম্ভাজির পুত্র স্বয়ং শাহজি তাঁর অভিষেকের পরে, পিতার হত্যাকারী আওরঙ্গজেবের সমাধিস্থলে ফুল-মালায় শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। আসলে ইতিহাসকে চেপে-মেপে-ছেঁকে-ঝাঁছিয়ে-বাঁকিয়ে ব্যবহার করার ঝক্কিও কম নয়। সেখানে ‘সেমসাইড’ হওয়ার সম্ভাবনাকেও থেকে যায়। তাই মুঘল-মারাঠা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের রূপ দেওয়ার সঙ্ঘ-পারিবারিক মতলব ভাঁজতে গিয়ে মহারাষ্ট্রীয় সমাজের অন্দরের পুরানো সংঘাতগুলো বেরিয়ে আসছে। এও যেন এক সিমুলেশন প্রক্রিয়া। ‘ছাওয়া’-কে কেন্দ্র করেই মারাঠা জাতি-গোষ্ঠী আর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কয়েকশো বছরের প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবার নগ্ন চেহারায় বেরিয়ে এসেছে। যেন শিবাজি সম্ভাজিদের বংশধরদের সঙ্গে উচ্চ-ব্রাহ্মণ পেশোয়াদের নানান স্বার্থ আর ক্ষমতার টানাপোড়েনের ‘অ্যাকশন রিপ্লে’! ইতিহাসকে বিকৃত করে ফায়দা তুলতে গেলে, ইতিহাসও হয়তো এভাবেই প্রত্যাখ্যাত করে। শুধু সঙ্ঘ-পারিবারিক সনাতনীরাও দেশপ্রেমিক, বাদবাদী সবাই বিশ্বাসঘাতক, ‘গদ্দার’, এমন ন্যারেটিভ-এর বেলুনেও পিন ফোটাতে পারে ইতিহাসই। খোদ ‘বাবরনামা’-র সাক্ষ্য-প্রমাণেই যেখানে হিন্দু-দেশপ্রেমের মহাবীর আইকন, মেবারের মহাদানা সঙ্গ বা সংগ্রাম সিংহও সেখানে দিলির খানের পাশাপাশি ‘বিদেশি বহিরাগত’ বাবরের সহযোগী বা ‘কোলাঘাটে’র যেতে পারেন। অপ্রিয় সত্যটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসার জন্য সমাজবাদী সাংসদদের বাড়িতে বুলডোজার চালিয়েও তখন বিতর্কটা চাপা দেওয়া যায় না।
আসলে ইতিহাসকে ধর্মের ভিত্তিতে টনটনে স্পর্শকাতর বাবর গনগনে বিস্ফোরক বানিয়ে রেখে কাজ হাসিল করলে চাইলে এমনটা হতেই পারে। তার চেয়ে পুরানের রামচন্দ্রে ভরসা রাখাই ভালো। সাবেক ‘দুর্বাদলশ্যাম’ থেকে তাকে যখন খুশি অস্ত্রধারী রাগী পুরুষসিংহ বানিয়ে দেওয়া যায়। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তখন কীর্তনের আসরে গিয়েও ‘জাগো হিন্দু, জাগো হিন্দু’ বলে ধুয়ো তুলতে পারেন। আর মুখ্যমন্ত্রীই ঈদের নমাজ থেকে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার তালে তাল মেলাতে পারেন। সেই ভালো। ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলেই মুশকিল।
Comments :0