এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবি মোসাব আবু তোহার বয়স একত্রিশ। প্যালেস্তাইনের বাসিন্দা তোহা উচ্চশিক্ষার জন্যে প্রথমে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মাস্টার অব ফাইন আর্টস ইন পোয়েট্রি’ ডিগ্রি অর্জন করেন ২০২৩-এ। নভেম্বরে যখন গাজায় ইজরায়েলী হামলা শুরু হয়, তিনি তখন গাজাতেই ছিলেন সপরিবারে। বিপর্যস্ত গাজায় প্রথমে বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। পরে সেই ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে। শেষে গাজা ছেড়ে যাওয়ার সরকারি ছাড়পত্র পেলে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে দেশান্তরের চেষ্টা। রাফা সীমান্ত পেরোনোর আগে চেকপয়েন্ট থেকে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। নিয়ে যাওয়া হয় ডিটেনশন সেন্টারে। চলে মারাত্মক নির্যাতন। তাঁর মুক্তির দাবি উঠতে থাকে পৃথিবীর নানান প্রান্তে। অবশেষে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ইজরায়েল। এখন আছেন মিশরের কায়রোতে। গত ২৫ ডিসেম্বর সেখানে বসেই লিখেছেন এই সময়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায়, ১-৮ জানুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। ‘আনসেফ প্যাসেজ’ শিরোনামে। ‘মার্কসবাদী পথ’ পত্রিকায় তার ভাষান্তর প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। গণশক্তি সেই লেখার সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশ করছে। ভাষান্তর করেছেন সৌম্যজিৎ রজক।
---------------------------------------------------
দক্ষিণের দিকে যে সকালে যাত্রা শুরু করলাম, মারাম একটা হিজাব পরেছিল। শেয়ালের মাথা আর দু'টো হাতাওয়ালা একটা ইয়াফার কম্বল সঙ্গে নিয়েছিল সে, যাতে প্রয়োজনে সেটাকে গায়ে গলিয়ে নিতে পারি আমরা। এক লিটার জল ছিল আমাদের কাছে। যতক্ষণে সমস্ত বাক্স-প্যাঁটরা জড়ো ক'রে আমরা হাসপাতাল গেটে গিয়ে পৌঁছালাম– মারামের ছোট ভাই ইব্রাহিমের সঙ্গে— ততক্ষণে ওঁদের কাকারা বেরিয়ে গিয়েছেন।
গাধার গাড়ির চালক এক কিশোরকে দেখতে পেয়ে হাঁকলাম,‘দক্ষিণে যাবে ভায়া?’
দক্ষিণের দিকে যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে ছেলেটার ধারণা ছিল না কোনও। তবু জিজ্ঞেস করল,‘কত দেবেন?’
একশো ইজরায়েলী শেকেল, আমি বলেছিলাম। মানে ওই সাতাশ মার্কিন ডলারের মতন আর কী! মা-কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে এসেছিলেন আরেকটি যুবক। ভাড়াটা ভাগাভাগি করে গাড়িতে সঙ্গী হলো তাঁরা।
বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়া সারি সারি বাড়ি আর দোকানগুলিকে পাশ কাটিয়ে গাধার গাড়িটা এগিয়ে চলল। অগুনতি মানুষের একটা নদীতে পরিণত হয়েছে যেন রাস্তাটা। দক্ষিণবাহী নদী। অনেকেরই হাতে শ্বেত পতাকা, যাতে দূর থেকে বোঝা যায় যে তাঁরা অসামরিক নাগরিক মাত্র। ইব্রাহিম গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল হঠাৎ। একটা লাঠি তুলে নিয়ে তাতে নিজের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটাকে বেঁধে নিল।
ভিড়ের মধ্যে আমি রামিকে দেখলাম। লোকটা আমার সঙ্গে ফুটবল খেলত এককালে। বছর দশেকেরও আগেই হবে! আমাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল সে। আমাদের গাড়িতে ওর সত্তরোর্ধ্ব বুড়ো বাপটার একটু জায়গা হবে কি-না জানতে চাইল। আমরা খানিক জায়গা ক'রে দিলাম। উনি চড়ে বসলেন।
প্রায় তিরিশ কিলোমিটার যাত্রাপথে আল-কুয়েত স্কোয়ার পেরিয়ে এলাম। দূর থেকে একটা ইজরায়েলি চেকপয়েন্ট চোখে পড়ল। সৈন্যরা সেখানে ট্যাঙ্ক আর বালির ব্যারিকেড গড়ে বিপুল পদাতিক স্রোত নিয়ন্ত্রণ করছে। রাস্তাটা আঁটকানোর হলে ওরা ট্যাঙ্কটাকে রাস্তার উপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল। শত শত লোক– আবালবৃদ্ধবনিতা– রাস্তার উপর সেই ট্যাঙ্কের সামনে গিজগিজ করছিল। এ-রকমেরই অন্য একটা দৃশ্যের কথা মনে করতে পারি আমি– নাকবা– ১৯৪৮-এ যখন লাখ-লাখ ফিলিস্তিনীয়কে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিল জায়নবাদী মিলিশিয়াগুলো, সেসময় থেকেই ফিলিস্তিনের মানুষেরা পায়ে হেঁটে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে সপরিবারে। যেটুকু যা বেঁচে আছে, সেইসব বোঁচকাবুঁচকি কোনোমতে আগলাতে আগলাতে। দেখেছি ছবিতে।
বাচ্চারা ভীষণই ভয় পেয়ে গেছিল। মোস্তাফা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে কি ফের ফিরে যেতে পারে না উত্তরে! ঠাম্মির কাছে। ঠাম্মি ওকে কত আদরে বিছানায় শুইয়ে দিত, আহা! ছেলেটাকে কী জবাব দেব, বুঝতে পারছিলাম না। আমরা ওঁকেই দেখতে যাচ্ছি, বললাম অবশেষে, একটু ধৈর্য ধরো!
ট্যাঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছাতেই আমি আমাদের বৈধ ছাড়পত্রগুলোর তাড়া তুলে ধরলাম হাতে। সবার সামনে মোস্তাফার নীল-রঙের মার্কিন পাসপোর্টটা। ট্যাঙ্কের উপর থেকে একজন সেপাই চোঙা ফুঁকছিল, আরেকজন একটা মেশিনগান তাক্ করে রেখেছিল। জীবনের প্রায় পুরোটাই আমি গাজায় কাটিয়েছি। কিন্তু এটাই আমার প্রথম ইজরায়েলী সেনা দর্শন। ওদের দেখে ভয় করেনি আমার। তবে করবে শিগগিরই।
ভিড়ের মধ্যে, আমাদের সামনের দিকে, মারামের কাকাদের দেখতে পেয়ে আহ্লাদ হলো আমাদের। ইব্রাহিম চিৎকার করে ডাকল খুব। ওঁদের মধ্যে একজন, আমজাদ, সোৎসাহে প্রত্যুত্তর দিলেন। চেঁচিয়েই। ‘তোমরা পেরেছ!’
লাইনটা এগচ্ছিল খুবই ধীরে ধীরে। মারামের এক জ্যেঠা, ফায়েজ, নব্বই বছরের মা-কে– মারামের ঠাকুমাকে–হুইলচেয়ারে ঠেলতে ঠেলতে এগচ্ছিলেন। বয়স্কদের আগে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে তিনি সেপাইদের রাজি করিয়ে ফেললেন। বয়স্কদের সাহায্য করার জন্য তাঁদের সঙ্গে একজন ক'রে যাবে। বিস্মিতই হলাম। তবে দু'টো লোক মিলে একটা হুইলচেয়ার ঠেলে এগনোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। ‘থামো’, চেঁচিয়ে উঠল এক ক্রুদ্ধ সেপাই। আচমকাই চালিয়ে দিল গুলি, মাটিতে।
খানিকটা ধুলো আর হাওয়া উড়ে গেল। বাচ্চাকাচ্চাগুলো সিঁটকে গেল ভয়ে। একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হলো লাইনে। ট্যাঙ্কটাকে আবার দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো রাস্তার উপরে। প্রায় মিনিট কুড়ি থম্ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।
আমরা চেকপয়েন্টটা পেরোতে যাব, এমন সময়, অকস্মাৎ একটি সেপাই চিৎকার ক'রে নির্দিষ্ট কয়েকজনকে চিহ্নিত করতে শুরু করল। তাদের ডেকে ডেকে লাইনের বাইরে বেরিয়ে, একটা নির্দিষ্ট জাযগায় এসে দাঁড়াতে বলল। পুরোটাই খামখেয়াল মাফিক।
‘তুমি, ওই যে ছোঁড়া, হলুদ জ্যাকেট, হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ! মালপত্র নামিয়ে এদিকে এসে দাঁড়াও!’
‘এই যে সাদা চুল, বাচ্চা ছেলেটার হাত ধ'রে, তুমি,  তুমি! ওকে ছেড়ে এদিকে এসে দাঁড়াও!’
আমকে আর ডাকবে না, মনে হলো। একহাতে মোস্তাফাকে, আরেক হাতে মোস্তাফার নীল পাসপোর্টটা ধরেছিলাম আমি। তখনই আচমকা সেপাইটা ডাকল,‘পিঠে কালো ব্যাগ, লাল চুলো ছেলেটাকে ধ'রে আছ, ইউ ইয়ং ম্যান– চলো, বেরিয়ে এসো। ছেলেটাকে রেখে এদিকে এসে দাঁড়াও!’
তৎক্ষণাৎ ঠিক করলাম, আমাদের পাসপোর্টগুলো দেখাবো ওদের। মারামের কাছে আমার ফোনটা ছিল। আর ওর নিজের পাসপোর্টটা। ‘আমি ওদের সবটা খুলে বলব– বলব, আমরা রাফাহ্ সীমান্ত পেরিয়ে যেতে চাইছি, আরও বলব, আমাদের খোকা আসলে তো মার্কিন নাগরিক’– মারামকে বললাম। যদিও কয়েক পা এগতে না এগতেই একজন সেপাই আমাকে থামতে বলল। এতই ঘাবড়ে গেলাম যে পেছন ফিরে মোস্তাফাকে দেখতেও ভুলে গেলাম। ছেলেটা কাঁদছিল, শুনতে পেয়েছিলাম।
হাঁটু মুড়ে ব'সে থাকা জোয়ান ছেলেদের লম্বা লাইন। আমিও ভিড়ে গেলাম তাতেই। দু'জন বয়স্ক মহিলা, দেখে মনে হলো, আটক হওয়া ছেলেদের মুক্তির অপেক্ষা করছিলেন। একটা সেপাই ওঁদের ধমক দিল, ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যেতে আদেশ করল। ‘‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে গুলি ক'রে দেব, চলো চলো, ফোটো!’’ আমার ঠিক পেছনেই যে যুবকটি ছিল, গজগজ করছিল। "আমাকে কেন তুলল ওরা? আমি চাষবাস করি।’’ খানিকটা আশ্বস্ত করতে চাইলাম তাকে। বললাম,  ভয় নেই, কয়েকটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেবে।
......…
আধ ঘণ্টা পরে, সহসাই, আমার পুরো নামটা ধ'রে কে যেন ডাকল। পরপর দু'বার। ‘মোসাব মোস্তাফা হাসান আবু তোহা!’ অবাক কাণ্ড! যখন ওরা আমাকে লাইন থেকে বের করেছিল, পরিচিতিপত্রটা দেখেনি তখন! তাহলে নামটা জানল কী করে?
একটা ইজরায়েলী জিপের দিকে নিয়ে গেল। বন্দুকের নলটা আমার দিকে তাক্ করা। আইডি নম্বর জানতে চাইলে, যত জোরে সম্ভব, আমি মুখস্ত বললাম।
‘বেশ। বাকিদের পাশে বসে পড়!’
আমরা জনা দশেক তখন বালিতে হাঁটু গেড়ে আছি। এক তাড়া টাকা, সিগারেট, মোবাইল, ঘড়ি, মানিব্যাগ এ'সব এক জায়গায় রাখা। আমাদের মহল্লারই একজনকে, আমার বাবার চেয়ে সামান্যই ছোট, চিনতে পারলাম। বললেন,‘ওরা ওদের কামানের সামনে বন্দিদের মানব-ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে না, এটাই আসল কথা, বুঝলে!’ সম্ভবনাটা আর মাথা থেকে বেরলো না আমার, আতঙ্ক বাড়তে থাকল।
দু’জন দু’জন করে দেয়ালের সামনে ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়াতে বলা হলো। তিন জন সেপাই। হাত-মাইকে একজন জামাকাপড় খুলে ফেলার নির্দেশ দিল। বাকি দু’জন আমাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একে একে সব খুলে ফেললাম আমি, জাঙ্গিয়াটুকু ছাড়া। পাশেরজনও তাই করল।
বাকিটুকুও খুলে ফেলতে বলল সেপাইটি। আঁতকে উঠলাম। দু'জন দু'জনের দিকে তাকালাম। সেপাইগুলো কী করতে পারে ভেবে– জান বাঁচাতে– আমরা বাকিটুকুও খুলে ফেললাম।
‘ঘুরে দাঁড়া!’
প্রথমবার, আমার জীবনে এই প্রথমবার, কোনও অচেনা ব্যক্তি আমাকে এভাবে দেখছে– সম্পূর্ণ ন্যাংটো– এভাবে।
হিব্রুতে কীসব বলাবলি করছে ওরা নিজেদের মধ্যে, বেশ ফুর্তিতেই, মনে হল। ওরা কি আমার রোমশ শরীরটা নিয়ে খিল্লি করছে? আমার কপালের, ঘাড়ের দাগগুলো– ষোলো বছর বয়সে ধারালো ছুরিতে কাটা দাগগুলো– ওরা বোধহয় দেখতে পাচ্ছে। একজন সেপাই আমার ট্র্যাভেল ডকুমেন্টগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করল। ‘এই আমাদের পাসপোর্ট’, কাঁপতে কাঁপতে বললাম,‘আমরা রাফাহ্ সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলাম।’
‘চোপ, কুত্তীর বাচ্চা!’
ওরা আমাকে জামাকাপড় পরার অনুমতি দিল। যদিও জ্যাকেটটা পরতে দিল না। মানিব্যাগটা কেড়ে প্লাস্টিকের হাতকড়া দিয়ে হাত দু'টো পিছমোড়া করে বেঁধে দিল। ইউএনআরডব্লুএ’র আমার যে পরিচিতিপত্র, সেটার কথা তুলল একজন। বললাম,‘আমি একজন শিক্ষক।’ আবার খিস্তি করল সে।
ওরা আমার চোখ বেঁধে দিল। কব্জিতে একটা ব্রেসলেট পরিয়ে দিল। তাতে একটা নম্বর খোদাই করা ছিল। ইজরায়েলীগুলোর কেমন লাগত, যদি ওদেরকেও এভাবে স্রেফ সংখ্যা দিয়ে চেনানো হতো! মনে হলো।
এমন সময় কে একটা আমার ঘাড়ের পেছনটা খামচে ধরল। আর ঠেলতে লাগল। যেন ভেড়াদের জবাই করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি কারও সঙ্গে একটা কথা বলতে চাইলাম, কেউ সাড়াই দিল না। দুনিয়াটা ভারি ঠান্ডা আর কর্দমাক্ত। পৃথিবীটা ধ্বংসের স্তূপেই যেন-বা আকীর্ণ।
হাঁটুতে ধাক্কা মারল একটা, তারপর টেনে দাঁড় করানো হলো, ফের হাঁটু মুড়ে আমাকে বসতে বলল ওরা। আরবিতে প্রশ্ন করা হলো,‘নাম কী? আইডি নম্বর?’ 
আরেকজন সেপাই ইংরেজিতে বলল,‘তুই তো অ্যাক্টিভিস্ট। হামাস, রাইট?’
‘আমি? কিছুতেই নই, কসম্! ২০১০-এ, ইউনিভার্সিটি যাওয়া শুরু করার পর থেকে আমি মসজিদে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছি। শেষ চার বছর তো মার্কিন মুলুকেই কাটিয়েছি। সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে এম এফ এ ডিগ্রি অর্জন করেছি সে দেশে।’
লোকটা বিশ্বাস করল না।
‘আমরা কয়েকজন হামাস সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি়। তারা বলেছে, তুইও তাদেরই একজন।’
‘মিথ্যে বলেছে ওরা’, আমি প্রমাণ চাইলাম।
কানের তলায় থাপ্পড় মারল একটা। ‘তুই যে হামাস নোস, তুই-ই প্রমাণ কর।’
চারপাশ অন্ধকার তখন আমার। ভয়াবহ। আমি যা নই, কীকরে তার প্রমাণ দেব, দিতে হয়? অতঃপর আবার ওরকম ঠেলতে ঠেলতে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হলো আমায়। কী করতাম তখন? আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে ওরা?
জুতো খুলতে বলা হলো। আমাদের একটা গ্রুপকে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আলাদা করে। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিল পিঠে। ঝাপটা মারছিল কনকনে হাওয়া।
‘আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করেছিস তোরা’, কেউ একটা বলল। ‘খুন করেছিস আমাদের শিশুদের।’ কথাটা শেষ হতে না হ'তেই ঘাড়ে গর্দানে কিল-ঘুষি, পাছায় দমাদম লাথি শুরু হলো। ভারী বুট পায়ে। দূরে কামান গর্জে উঠছে, বাতাসে বয়ে আসা সে শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
একজন একজন করে একটা ট্রাকে তোলা হলো আমাদের। ঠেসে দেওয়া হলো। আমার কোলের উপর একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লোকটা নিথর। তবে কি ওরা কোনও লাশ ছুঁড়ে দিল আমার গায়ে? এটাও কি অত্যাচারেরই কোনও কায়দা? ‘এই, বেঁচে আছো’, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।
‘আছি, ভাই!’ জানালো কোনোমতে। যাক, আশ্বস্ত হলাম একটু!
ট্রাকটা থামল যখন, কিছু আওয়াজ শুনতে পেলাম। গুলিরই আওয়াজ যেন! নিজের শরীরটারই অস্তিত্ব আর টের পাচ্ছিলাম না।কফিনের কথা আমার মনে পড়ছিল খুব, সেনাদের গায়ের গন্ধে। এরচেয়ে হার্টঅ্যাটাক, এক্ষুনি হার্টের অ্যাটাকে মরে যাওয়া শ্রেয়। মনে হচ্ছিল।
......…
পরবর্তী এই স্টপেজটিতে, ফের হাঁটু মুড়ে বসতে হলো আমাদের। সন্দেহ হলো, ইজরায়েলী মিলিটারিরা কি আটক বন্দিদের ছবি দেখাতে চাইছে দুনিয়াকে! আমার ঠিক পাশেই, আচানক্, কেঁদে কঁকিয়ে উঠল এক তরুণ, ‘নো হামাস, নো হামাস!’ বেধড়ক লাথির আওয়াজ তারপর শুধু। যতক্ষণ না ছেলেটার কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ নিভে গেল।
আরেকজন লোক, বোধহয় তাকেই বলল,‘আমি আমার মেয়ে আর পোয়াতি বউটার কাছে যেতে চাই, প্লিজ!’
আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। মারামের কথা, ছানাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। চেকপয়েন্টের ও-পারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। একটা কম্বল, এমনকি যথেষ্ঠ কাপড়চোপড়ও নেই ওদের কাছে। কয়েকজন মহিলা-সেপাইয়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। হাসি-ঠাট্টা করছে নিজের মধ্যে।
আচমকা কে একটা ঘুষি মারল তলপেটে। উড়ে গিয়ে,খানিকটা দূরে, মাটিতে আছড়ে পড়লাম। শ্বাস রোধ হয়ে এল। আর্তনাদ করে উঠলাম আরবিতে। মা-গো।
হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করা হলো ফের। নাকে, মুখে ভারী বুটের লাথি পড়তে থাকল। মনে হচ্ছিল, আমি শেষ, যদিও দুঃস্বপ্ন কিছু বাকি থেকে গেছিল তখনও।
এমনই মারধর খেয়েছি যে ট্রাকে ফিরে মনে হলো, এই বাহু, এই হাতগুলো না- থাকলেই বরং ভালো হতো। এত ব্যথা! যা মনে হলো, নব্বই মিনিট মতোই হবে, চলল গাড়িটা। থামল। ট্রাক থেকে এক জায়গায় নামানো হলো আমাদের। ধাক্কা দিয়েই ফেলে দেওয়া হলো। একজন সেপাই প্লাস্টিকের হাতকড়াটা খুলে দিল। ‘দুটো হাতই বেড়ার উপরে রাখ’, আদেশ করল।
এবার সে আমার হাতগুলো সামনের দিকে বাঁধল। খানিকটা স্বস্তি পেলাম। পনেরো মিটার মতো হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। অবশেষে দেশি-ফিলিস্তিনীয়-আরবিতেই একজন কথা বললেন আমার সঙ্গে। লোকটা আমার বাবার বয়সি।
শুরুতে ওঁকে ঘৃণাই করেছি। কোলাবরেটর-ই মনে হয়েছিল। তবে পরে শুনলাম, নিজেকে শওয়িশ পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক। (‘শওয়িশ’ পূর্ব-জেরুজালেমের দামাস্কাস-গেট-এর সুপ্রাচীন এক ফিলিস্তিনীয় পরিবার। পরবর্তীকালে বাস্তুচ্যুত, অভিবাসিত।) শওয়িশ বংশোদ্ভূত লোকটি আমাদের মতনই বন্দি, তবে জেলারদের কাজকম্ম করে দেন ব'লে সামান্য কিছু স্বাধীনতা পান। বললেন,‘তোমাকে কিছু সাহায্য করতে দাও।’
লোকটি আমাকে কিছু নতুন কাপড় পরতে দিলেন। বেড়ার ভেতরে হাঁটতে দিলেন। চোখে ফেট্টি বাঁধা ছিল, মাথাটা তুলতেই, একটা ঢেউ-খেলানো ধাতব ছাদের আবছা আভাস পেলাম। একটা ডিটেনশন সেন্টারেই আনা হয়েছে আমাদের। সেনারা আমাদের চারপাশে পায়চারি করছে, নজর রাখছে। শওয়িশ ভদ্রলোকটি যোগা-ম্যাটের মতন একটা জিনিস বিছিয়ে দিলেন আমার জন্যে, একটা কম্বলও দিলেন। বাঁধা হাতদু’টোকে মাথার পেছনে বালিশের মতো রাখলাম। ঘাড় থেকে কনুই অব্দি টনটন করছিল ব্যথায়, যদিও দেহে খানিকটা উষ্ণতা ফিরে এল। প্রথম দিনটা ফুরালো এভাবে।
.........…
শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল আমাকে। একটি বিছানায়। ডিটেনশন সেন্টারে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। একজন নিতে আসছিল আমাকে, সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল, আরেকজনের সঙ্গে কিছু কথা বলল সে। ঘরটায় আমাকে একা ফেলে চলে গেল ওরা। একটা হিব্রু গান বাজছিল, সেটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। গায়কটির গলা ভারী পছন্দ হয়েছিল আমার।
যখন উঠলাম, একজন সেপাই কিছু কথা বলল আমাকে, ইংরেজিতেই বলল। ওর কথা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আমি।
‘আমাদের ভুলের জন্যে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি বাড়ি যেতে পারবেন এবার।’
‘তুমি কি সিরিয়াস?’
নিঃশ্চুপ।
‘গাজা ফিরে যাব আমি? আমার পরিবারের কাছে?’
‘সিরিয়াস নয় এমন কথা কেন বলব আমি?’
অন্য একটা গলা ভেসে এল তখুনি,‘এই সেই লেখকটি না?’
ডিটেনশন সেন্টারে ফিরে, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শুয়ে শুয়ে সেপাইটার কথাগুলোই মনে পড়েছিল সেদিন খালি। ‘আমাদের ভুলের জন্যে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’ বটে! ইজরায়েলী সেনারা এমন কত কত ভুল যে করেছে এতদিন! আর কত জায়গায়, আর কত জনের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে ওরা?
মঙ্গলবার, আমি স্কুলবাড়িটা ছেড়ে আসার দিন দুই পরে হাত-মাইকওয়ালা সেপাইটি, হিব্রুতে সুপ্রভাত কীভাবে বলতে হয়, শেখালো আমাদের। ‘বোকের তোভ, ক্যাপ্টেন’, একসুরে আমরা বললাম। নতুন কয়েকজন বন্দিকে ধ'রে আনা হয়েছে, দেখলাম। ঘেরাটোপের মধ্যে তাদের নিয়ে এল যে সেনারা, তাদের তো ফুর্তির শেষ নেই। ছোটদের একটা আরবি গানের কিছুটা গাইছিল ওরা একসঙ্গে, ‘ওহ, আমার ভেড়া!’, আর উত্তরে বন্দিদের বাধ্য করছিল ‘ব্যা ব্যা’ আওয়াজ করতে।
ঘণ্টা খানেক পর একজন আমার নাম ধরে ডাকল, ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে বলল। শওয়িশ ভদ্রলোকটি আমাকে সতর্ক করে দিল। ওরা জিজ্ঞাসাবাদ করবে, মারধরও করবে হয়তো ফের। ‘মনে জোর রেখো, আর মিথ্যে কথা ব'লো না।’ একটু ভয় করছিল।
আরও এক ঘণ্টা পর কয়েকটা সেপাই এল। একজনের হাতে আমার পরিচিতিপত্রটা, আরেকজনের হাতে এক জোড়া চপ্পল। সেগুলো ফেলে দিয়ে পরতে বলল। বলল হাঁটতে। ওদেরই একজন বলল,‘রিলিজ’!
এতটাই আপ্লুত হলাম যে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। স্ত্রী, সন্তানদের কথা মনে পড়ল আমার। বাবা, মা, ভাই, বোনেরা– আশা করি– বেঁচে আছে।
যেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, হিব্রু গান বাজছিল একটা, আন্দাজ প্রায় দু’ ঘণ্টা মতো ছিলাম সেখানে। কিছু খাবার আর জল দেওয়া হয়েছিল আমাকে। তবে আমার পরিবারের পাসপোর্টটা সেনারা খুঁজে পেল না। একটা জিপে চ'ড়ে বসলাম। সেপাইরা ঘিরে ছিল আমাকে। ঘণ্টা দু’য়েক পরে– চোখে তখনও ফেটি বাঁধা, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম– গাড়িটা গাজার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে ইতিমধ্যেই।
...........
হাতকড়া খুলে দেওয়া হলো, সরিয়ে নেওয়া হলো চোখের ফেট্টিটা। যেখানে কাপড়চোপড় খুলে ফেলতে হয়েছিল আমাকে, সে জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে আছি, দেখলাম। নতুন বন্দিদের যখন অপেক্ষা করতে দেখলাম সেখানেই, মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল।
দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলাম। চেকপয়েন্টের কাছে– যেখানে বন্দিরা নিজেদের জিনিসপত্র জমা রেখে যায়– সেই স্তূপের ভেতর আমার হাত-ব্যাগটা খুঁজে পেলাম। তবে য়াজানের পিঠের ব্যাগটা, যাতে পুচকেগুলোর শীতের জামাকাপড় ছিল, সেটা পাওয়া গেল না। একটা সেপাই হম্বিতম্বি করল আমার উপর। ‘আমি সবে মুক্তি পেয়েছি’, জানালাম।
সালাহ আল-দিন রোডে ফিরে, দেখি, অনেকে সেখানে অপেক্ষা করছে। কাঁদতে কাঁদতে এক মা জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, ছেলেকে তার আমি দেখতে পেয়েছি কি-না! ‘সোমবার অপহরণ করা হয়েছে ওকে’, বৃদ্ধা বললেন। এটা মঙ্গলবারের ঘটনা। আমি ওঁর ছেলেকে দেখিনি।
কোনও টাকা ছিল না আমার কাছে। ফোনও ছিল না। তবে এক সহৃদয় ড্রাইভার দক্ষিণের শহর দেইর আল-বালাহ অব্দি আমাকে পৌঁছে দিতে রাজি হলেন। আমার স্ত্রীর আত্মীয়রা ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে, জানতাম। মারামও, সম্ভবত, ওঁদের কাছেই গেছে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। ভদ্রলোক গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর আমি তাঁর থেকে জানতে চাইছিলাম, এখন কোথায় আছি, এই জায়গাটার নাম কী ইত্যাদি। আল-নুসেইরত, আল-বুরেইজ, আল-মাঘআজি– গড়গড় করে একটার পর একটা রিফিউজি ক্যাম্পের নাম বলে যাচ্ছিলেন তিনি।
দেইর আল-বালাহ-য় একটি ব্যাঙ্কের বাইরে কয়েকটি যুবক দাঁড়িয়েছিল। ব্যাঙ্কের ওয়াই-ফাই ব্যবহার করবে ব'লে। আমাদের শহরের কাউকে তারা চেনে কি-না, জানতে চাইলাম। ওঁদেরই একজন আমাকে একটা স্কুলবাড়ি দেখালো।
চপ্পল খুলে দৌঁড় লাগালাম তৎক্ষণাৎ। আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছিল, আমি পাত্তা দিইনি। সহসা নজর পড়ল মাহদির উপর। আমার পুরানো বন্ধু। এককালে আমাদের ফুটবল টিমের গোলকিপার ছিল। ‘মাহদি আমি হারিয়ে গেছি– ভাই সাহায্য করো!’
‘মোসাব!’ কোলাকুলি করলাম আমরা।
‘তোমার বউ বাচ্চারা কলেজের পাশের স্কুলটায় আছে’, সে-ই জানালো। ‘বাঁদিকে ঘুরেই দুশো মিটার মতন হাঁটলেই পেয়ে যাবে।’
আমি দৌড় লাগালাম, আমি কেঁদে ফেললাম। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, এই কথা মনে হ'তে না হ'তেই যাফ্ফা-র গলা কানে এল। ‘বাবা!’ আমার পাজলের প্রথম টুকরোটা ছিল ও-ই। মেয়েটাকে সুস্থ দেখাচ্ছিল। একটা কমলা-লেবু খাচ্ছিল। যখন শুধোলাম, বাড়ির বাকিরা কোথায়, মেয়েটা আমার হাত ধ'রে টানতে টানতে এমনভাবে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল, আমি একটা বাচ্চাই যেন।
মারামের কাকা, সারি, মারামকে খুঁজতে ছুটে যান। মারামকে বললেন, রাতের খাবার খেতে এসেছেন। আমি যে ফিরে এসেছি সেটা জানালেন না। হঠাৎ আমাকে দেখে মারাম তো অবাক, যেন এক্ষুনি মূর্ছা যাবে। এক ছুটে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0