‘বিশেষ বন্ধু’ মোদীর মতোই মঙ্গলবার রাতের এক বক্তৃতায় হোয়াইট হাউসে তাঁর ফিরে আসাকে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ বলে দাবি করেছেন আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। একবার হেরে গিয়ে আবার ভোটে জিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার নজির আমেরিকার গত ১৩২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম। মঙ্গলবারের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন সমীক্ষায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস মিললেও, বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই পাকাপক্ত ভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীর অন্তত চার শতাংশ হারে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাতের মধ্যেই মোট প্রাপ্ত ভোট সহ ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে মার্কিন মুলুকের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প।
এবছর শুধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনই নয়, সেনেটের ৩৪টি আসন, ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’-র ৪৩৫টি আসন ও ১৩টি প্রদেশে গভর্নর নির্বাচন হবে। মোট ভোট পড়েছে প্রায় ১৫ কোটি। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন ট্রাম্প। এদিকে ৪৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং মহিলা রাষ্ট্রপতি হতে ব্যর্থ হলেন কমলা হ্যারিস। শুধু রাষ্ট্রপতি ভোটেই নয়, সেনেট ও ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’-এও ডেমোক্র্যাটদের হারিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে রিপাবলিকানরা। এছাড়াও সব কটি সুইং স্টেটেই জিতেছেন ট্রাম্প।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, হোয়াইট হাউস দখলের লড়াইয়ে অর্থনীতিই সহ আরও কিছু ঘরোয়া সমস্যাই ছিল এবারের মূল ইস্যু। খাদ্যপণ্যের দামে ব্যাপক বৃদ্ধি, বেকারির সঙ্কট, বাড়ি ভাড়ায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং গড় আয়ে মারাত্মক হ্রাসের ঘটনায় মূল সরকার বিরোধী ভোটের হয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের বড় অংশ। ট্রাম্প এই সমস্ত সমস্যা মেটাতে পারবেন, এই ভেবে যে মানুষ ভোট দিয়েছেন তা নয়। বরং বাইডেন-হ্যারিসের শাসনকালে এই সমস্ত সমস্যা বাড়ায় বিদায়ী উপরাষ্ট্রপতিকে আর ভরসা করছেন না সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এসবের মধ্যেই ট্রাম্পের বিদ্বেষ ছড়ানো ভাষণ, বেকারি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য সরাসরি অভিবাসীদের দায়ী করে তাদের দেশছাড়া করার প্রতিশ্রুতি, কিংবা ‘পুরানো গৌরব’ ফিরিয়ে আনার মতো প্রতিশ্রুতি সাধারণ ভোটারদের বড় অংশকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।
প্রার্থী হওয়ার প্রাক্কালেই কোটি কোটি ডলার দুর্নীতি, হিংসায় উসকানি সহ ২৬টি যৌন হেনস্তার মামলায় অভিযুক্ত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে সমস্ত বিষয় নিয়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে ইতিমধ্যে মামলা চলছে। মঙ্গলবারের আগেই, ‘হেরে গেলেও ছাড়বো না’ বলে জোর গলায় হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। তাসত্ত্বেও ভোটে এমন ফলাফল আদতে এমন সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে ‘প্রতিপত্তির রাজনীতির’ পক্ষে ভোটদান হিসাবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। নিউ ইয়র্ক টাইমস’র সাংবাদিক লিসা লেরার বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকায় তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণের সম্ভাবনা বাড়বে, যা প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
দেশের দক্ষিণ সীমান্ত বন্ধ করে অভিবাসীদের ‘দেশছাড়া’ করা, জিনিসপত্রের দাম কমাতে খুচরো ব্যবসায়ীদের উপর শুল্ক বাড়ানো, শিল্পে কর কমিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো, গর্ভপাত রোধে আইন প্রণয়ন সহ আরও একাধিক জনবিরোধী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘প্রোজেক্ট ২০২৫’ নামের এক প্রস্তাবনামা তৈরি করেন ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা। মন্দার বিপরীতে বিভাজনকেই হাতিয়ার করেন তারা। মূল্যবৃদ্ধির প্রতি কড়া পদক্ষেপ এবং বেকারি কমানোর মতো প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হয়ে মন্দায় বিপর্যস্ত এবং ছাঁটাইয়ের মুখোমুখি শ্রমিকদের বড় অংশই ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছেন।
তবে মন্দা পরিস্থিতি মেটাতে ‘শিল্পপতিদের প্রার্থী’ ট্রাম্পের এমন দাবি একেবারেই যুক্তিহীন বলে মনে করছেন অনেকে। এবারের নির্বাচনে বিশ্বের দেড়শোটি ধনীতম পরিবার প্রায় ১৯০ কোটি ডলার খরচ করেছেন বলে জানা গেছে। এর সিংহভাগ অংশই ট্রাম্পের ঝুলিতে গেছে। টিমোথি মেলন, মিরিয়াম অ্যান্ডার্সন ও এলন মাস্ক ট্রাম্পের প্রচার অভিযানে কোটি কোটি ডলার দিয়ে অর্থ সাহায্য করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত শিল্পপতিদের স্বার্থে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ট্রাম্প ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়া, কর্পোরেট কর কমানো, বেলাগাম ছাঁটাইয়ের মতো একাধিক শ্রমিক বিরোধী নীতি বাস্তবায়িত করবেন বলে মনে করছেন ‘পিপলস ওয়ার্ল্ড’ সংবাদপত্রের সাংবাদিক সি জে অ্যাটকিন্স।
আমেরিকার বিধ্বংসী বিদেশনীতি নিয়ে হতাশ দেশের তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করতে ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ কমাবার প্রতিশ্রুতিও শোনা যায় ট্রাম্পের প্রচারে। এদিকে এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ‘লকহিড মার্টিন’, ‘বোয়িং’, ‘নরথ্রপ গ্রামান’, জেনারেল মটরস ও ডেল্টা এয়ারলাইন্সের মতো যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে এমন বেশ কয়েকটি বড় সংস্থা ট্রাম্পের প্রচার অভিযানে লক্ষ লক্ষ ডলার অর্থ সাহায্য করেছে। পাশাপাশি, ইজরায়েলের সুপরিচিত প্রতিরক্ষা বিষয়ক ‘লবি গ্রুপ’ আমেরিকা ইজরায়েল পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (এআইপিএসি)-ও ট্রাম্পের প্রচার অভিযানে বিপুল অর্থ সাহায্য করেছে। রাষ্ট্রপতি হিসাবে ট্রাম্প যে এই সমস্ত যুদ্ধবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণেই থাকবেন, এ নিয়ে তেমন কোনও সন্দেহ নেই। অর্থাৎ তার শাসনকালে আমেরিকার আগ্রাসী বিদেশনীতিতে তেমন বদল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, অর্থনৈতিক সঙ্কট ছাড়াও ইজরায়েলের গণহত্যায় প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে অনেকটাই সমর্থন হারিয়েছেন কমলা হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাটরা। মিশিগানের মতো আরও বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে আরব বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি, গাজা যুদ্ধের প্রশ্নে সমর্থন হারিয়েছেন হ্যারিস। এই সমস্ত প্রদেশে নজিরবিহীনভাবে ভালো ভোট পেয়েছেন ‘বামপন্থী’ প্রার্থী জিল স্টাইন। জর্জিয়া, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনের মতো কিছু ‘সুইং স্টেট’-এ মোটে ১ থেকে ২ শতাংশের হারে হ্যারিসের থেকে এগিয়ে ট্রাম্প। এই সমস্ত প্রদেশেই স্টাইনের পক্ষে যে ভোট পড়েছে তা হ্যারিসের পক্ষে পড়লে ট্রাম্প জিততে পারতেন না। সমীক্ষকদের মতে ৭টি সুইং স্টেটের মধ্যে এই ৪টিতে হ্যারিস জিতলে ট্রাম্পের পক্ষে রাষ্ট্রপতি হওয়া অসম্ভব হয়ে যেত।
Comments :0