রিদ্ধি ঋত
বিশ্বকাপের পর সবথেকে চর্চিত ফুটবলের উৎসব বললে অধিকাংশ মানুষ ইউরো কাপের নামই বলবেন। কোপা আমেরিকা নিঃসন্দেহে ফুটবল দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ও নান্দিক টুর্নামেন্ট হলেও ইউরো’র ক্ষেত্রে দলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতাও অনেক বেশি। তার সঙ্গে ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলোর রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক কারণের বিভিন্ন ঘটনা ও তার বিভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে গ্যালারি জুড়ে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। ১৬০১ থেকে ১৭০০-এর মধ্যে স্পেনের সঙ্গে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের সঙ্গে স্পেন, ইংরেজ বনাম ডাচ— এ রকম বেশ কিছু যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। সেই সপ্তদশ শতকে ইউরোপ জুড়ে যা হয়েছিল, সেটা এবার দেখা গেছে ফুটবল মাঠে। যদিও, বইয়ের পাতা সেই সব যুদ্ধের সঙ্গে এখনকার ইউরোর লড়াইয়ের অবশ্য অনেক ফারাক।
প্রত্যেক ইউরোই কিছু না কিছু ছাপ রেখে যায়। ২০২৪ সালের প্রতিযোগিতাও তার চিহ্ন রেখে গেল। লামিনে জামাল, আদার গুলেরদের মতো যেমন নতুন তারকা চিহ্নিত হলো, তেমনই এই ইউরোই সম্ভবত শেষ ইউরো হয়ে থাকল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুস, থমাস মুলারদের। ফুটবলারদের উত্থান পতনের মঞ্চ হয়ে যেমন ধরা দেয় এই ইউরো তেমনই তাদের জীবন এসবের সঙ্গে বিভিন্ন সময় উঠে আসে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। সিআরসেভেন এর বড় হবে ওঠার ইতিহাসে ধরা পড়ে জীবনধারণের নানা লড়াইয়ের চিত্র। পর্তুগাল অবশ্য এর আগেও এই রকম আরও এক ফুটবলারের জন্য বিশ্বমঞ্চে সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর নাম ইউসোবিও। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত মাত করে রেখেছিলেন ফুটবল দুনিয়া। তথাকথিত সাদা চামড়ার ইউরোপকে যিনি নত হতে বাধ্য করেছিলেন। কয়েকশো বছর ধরে এশিয়া , আফ্রিকার যে সমস্ত দেশ শাসন করেছিল এই সমস্ত ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী, তাদের ওপর নিজেকে মেলে ধরার এক পথিকৃৎ তিনিও।
এইভাবে অত্যাচারের পর তাঁদের দিয়ে নিজেদের দেশের নাম উজ্জ্বলের কথা উঠলে ইংল্যান্ডের নাম আসে প্রথমেই। বর্তমান দলের সাকা বা বেলিংহাম কেউই সাদা চামড়ার ব্রিটিশ নন। শুধু অন্য দেশের থেকে অতীতের দাস প্রথায় আনা নয় ইংল্যান্ডের অন্যতম সমস্যা স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড। তাদের স্বতন্ত্রতাও জন্ম দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের। পুলিৎজার-জয়ী লেখক অ্যান অ্যাপলবাম সম্প্রতি লিখেছেন যে একটির পরিবর্তে চারটি আন্তর্জাতিক ফুটবল দল থাকা ‘স্কটিশ এবং ওয়েলশ বিচ্ছিন্নতাবাদের সাম্প্রতিক পুনরুজ্জীবনে অবদান রাখতে পারে।’
ক্রোয়েশিয়ার মদ্রিচের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে বাস্তুহারার গল্প। এক সময় যুগোস্লাভিয়া ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘরোয়া লিগগুলির মধ্যে একটির অধিকারী ছিল। ১৯৬০ এবং ১৯৬৮ সালে ইউরোয় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা এই দেশ দুটি বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল এবং তিনটি কোয়ার্টার ফাইনালে অংশ নিয়েছিল। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের সময় ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি থেকে যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে শুরু হয় অন্তর্যুদ্ধ। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, ম্যাসেডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া– যে সাত জাতি এক হয়ে যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক গঠন করেছিল, তারাই আলাদা হয়ে গেল। পরবর্তী সময় অবশ্য যুগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলিও অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছিল। ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপে ১৯৯৮ সালে তৃতীয় স্থান, ২০১৮ সালে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। যদিও, সেই সময় দেশ ভাঙার কারণে অন্ধকার নেমে এল সেখানকার সাধারণ মানুষদের ওপর। দলে দলে রিফিউজি এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি জমালো। সেইরকম এক পরিবারেই জন্মান মদ্রিচ। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে এক রিফিউজি ক্যাম্পে। ইউরোপের ‘এলএমটেন’ নিজেও বলেছেন, ছোট বেলায় খেলার সময় প্রায়শই বোমা পড়ার শব্দে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়তেন।
বাস্তুহারা ফুটবলারদের খেলার সেরা অবস্থাতেই সরে যাওয়ার উদাহরণও আছে। মেসুত ওজিল সেখান সব থেকে বড় নাম। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জার্মানি জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত সেই দেশ ছেড়ে তাঁকে পাড়ি জমাতে হয়েছিল তুরস্কে। কারণ তিনি মূলত একজন তুরস্কের মানুষ। তাই শেষ পর্যন্ত অভিবাসী হওয়ার কারণেই তাঁকে সরে যেতে হয় জার্মানির দল থেকে। জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্যকে বলতে হয়েছিল, ‘আমি জার্মান জাতীয় দলের সাফল্যে খুব খুশি হবো। কিন্তু সে দেশের হয়ে আর কখনও খেলব না।’
এইরকম অভিবাসী ফুটবলারের কথা বলতে গেলেই সামনে এসে পরে ফ্রান্সের নাম। ফ্রান্স- যাঁরা নিজেদের জাতিসত্তার নিরিখে বিশ্বের সেরা বলে গণ্য করেন, তাঁদের দেশের জাতীয় ফুটবলে সেরা ফুটবলারদের তালিকায় প্রথম দুটো নাম বলতে গেলেই বলতে হয় জিনেদিন জিদান ও কিলিয়ান এমবাপের নাম। যাঁরা প্রকৃত অর্থে কেউই ফরাসি নন। জিদান একাধিকবার তাঁর দেশের অধিনায়ক দেশঁ’র কাছে অপদস্ত হলেও, তিনি যে শ্রেষ্ঠ তা মেনে নিতে হয়েছিল ১৯৯৮ সালের গোটা বিশ্বকে। আর এখনকার ফুটবলের অন্যতম নায়ক এমবাপে চলতি ইউরোতে একাধিকবার সরাসরি রাজনীতিতে সরব। এবারের প্রতিযোগিতায় মাঠে নামার আগে সাংবাদিক সম্মেলনে অতি দক্ষিণপন্থী লি পেনকে রুখে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ফ্রান্সের অধিনায়ক। এমবাপে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আরজি জানিয়েছিলেন, ‘আমি কিলিয়ান এমবাপে যে কোনও চরম মতের বিরোধী। যারা মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে, সেই ভাবনারও বিরোধী।’ এই বার্তার পরও ফ্রান্সের নির্বাচনের প্রথম দফায় অতি দক্ষিণপন্থীদের এগিয়ে থাকার ঘটনাকে ‘বিপর্যয়’ বলে চিহ্নিত করতে দু’বার ভাবেননি তিনি। ফের মুখ খুলে দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে এমবাপে বলেছিলেন, ‘দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থার ছায়া দেখা দিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই এই অবস্থাকে সমর্থন করতে পারি না। দেশকে এই সঙ্কটের মুখে তুলে দেওয়ার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। আশাকরি আগামী পর্বেও প্রত্যেকে ভোট দেবেন। এই ফলাফল দেশের ভবিষ্যৎ গড়বে।’ শেষ পর্যন্ত তাঁর আবেদনে সারা দেয় দেশের মানুষ। অতি দক্ষিণপন্থীরা নেমে আসে তৃতীয় স্থানে, প্রায় একশো বছর পর ‘ফরাসি বিপ্লবের’ দেশে সাফল্য আসে বামপন্থী জোটের।
একদিকে যখন এমবাপে বার বার দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে নিজের স্বর তুলে ধরছেন, তখন উলটো চিত্র ধরা পড়েছে তুরস্ক শিবিরের ফুটবলারদের মধ্যে। চ্যাম্পিয়নশিপের প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে অস্ট্রিয়া এবং তুরস্কের মধ্যেকার খেলায় তুরস্কের হয়ে জোড়া গোল করে দলকে জিতিয়ে ছিলেন তুরস্কের রক্ষণভাগের ফুটবলার মেরিহ দেমিরাল। তারপরই উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের চিহ্ন দেখিয়ে মাঠের মধ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তিনি। দেমিরালের দেখানো হাতের চিহ্নটি উগ্র-জাতীয়তাবাদী সংগঠন উলকু ওকাক্লারির কুখ্যাত ‘গ্রে উলভস চিহ্ন’ নামে বেশি পরিচিত। এর ফলস্বরূপ ‘অনুচিত আচরণ’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন দেমিরাল। শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতার কার্যকর্তারা দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তুরস্কের ডিফেন্ডারকে। প্রসঙ্গত, ‘গ্রে উলভস গ্রুপ’কে ফ্রান্সে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। অস্ট্রিয়া ‘গ্রে উলফ স্যালুট’ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে, যা তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। এই উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনের আদর্শ হলো, তুর্কি জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার, ইহুদি বিরোধিতা এবং কুর্দ, আলেভি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা সঞ্চার করা।
এবারে আসা যাক স্পেনের বিষয়ে। বাইরে থেকে দেখলে বিশ্বকাপ জয়ী এই দলে কাতালোনিয়ান, ক্যাস্টিলিয়ান, বাস্ক, গ্যালিসিয়ান এবং আন্দালুসিয়ানরা সারা বছরের নিজেদের সমস্ত বিভাজন ভুলে একত্রিত হয়েই মাঠে নামে জয়ের লক্ষ্যে। কিন্তু, মানুষদের ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুন সহজে নিভে যায় না। তাই স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ী ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকের মতো ফুটবলারও কাতালানদের স্বাধীনতার বিক্ষোভে জড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পিকে কাতালানদের স্বাধীনতার জন্য তার সমর্থন লুকিয়ে রাখেননি। কাতালোনিয়া নিজেদের ভাষা নিয়ে নিজেকে একটি জাতি বলে মনে করে। গত বছরের নভেম্বরে একটি গণভোটের কথা ছিল কিন্তু স্পেন সরকার তা বাতিল করে দেয়। আর এটা শুধু কাতালোনিয়া নয়। বাস্কদের নিজস্ব ভাষা আছে এবং তারাও নিজেদেরকে আলাদা জাতি বলে মনে করে। দ্য ব্লিজার্ড-এ, বিখ্যাত ফুটবল লেখক সাইমন কুপার বিলবাওতে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, যেখানে লোকেরা প্রাথমিকভাবে নিজেদেরকে বাস্ক হিসেবে চিহ্নিত করে, স্প্যানিয়ার্ড হিসাবে নয়। স্পেন যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল, তখন তিনি লিখেছিলেন যে ‘শহরের আরও বাস্ক-জাতীয়তাবাদী মধ্যযুগীয় কোয়ার্টারে লোকেরা লাল স্পেনের শার্ট পরে রাস্তায় দৌড়ানোর ঝুঁকি নেয়নি।’
তবে, এইরকম নানা ঘটনার পরম্পরা ধরা পড়লেও ফুটবল থেকে গিয়েছে ফুটবলেই। তাই বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় ফুটবল অবশ্যই আপামর বাঙালিরও, কারন বাঙালিরও সংগ্রামের, রাজনীতির ইতিহাস বহুদিনের।
Comments :0