প্রবীর দাস
বাহাত্তর ঘন্টা হতে চলল। এখনও পর্যন্ত কোন চিকিৎসা পরিষেবাই পায়নি সৈকত মণ্ডল। কুড়ি বছরের সদ্য যুবক সৈকত সুন্দরবন লাগোয়া হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের যোগেশগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের পাটঘরার বাসিন্দা। রবিবার সকালে তাঁকে পাওয়া গেল হেমনগর কোস্টাল থানার কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামে মামার বাড়িতে।
যশবন্তপুর-হাওড়া ট্রেনে ছিলেন সৈকত। আর করমণ্ডলে ছিলেন হাসনাবাদের আতাউর মোল্লা। তিনিও এখন বাড়িতে ফিরেছেন আহত অবস্থায়। আর রবিবারই হিঙ্গলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকদের রওনা হতে দেখা গেল তামিলনাডুর উদ্দেশে। কেন না, গ্রামে কাজ নেই। পরিবারে টাকা দিতে হবে।
সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা সৈকতের। মাথার ডানদিকে কানের উপরে, বুকের ডানদিকে, পিঠে, হাতে, পায়ে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। ভালো করে কথা বলতে পারছে না। আতঙ্ক চোখে মুখে স্পষ্ট। তাঁর কথায়, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, সে বেঁচে আছে। রাতে ঘুমানোর সময় চোখ বুজলেই বিভীষিকাময়, শুক্রবার রাতের ঘটনায় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। মনে পড়ছে আচমকা বিকট শব্দে বোমা ফাটার মতো আওয়াজ। চোখে ভাসছে চারিদিকে লাশ আর শুধু লাশ।
সৈকত মামার বাড়িতে ফেরে শনিবার। অসম্ভব মনের জোর নিয়ে হাসনাবাদ স্টেশন পর্যন্ত সে একাই আসে। সেখান থেকে মামা অপূর্ব মণ্ডলের সাথে দুপুর ১টা নাগাদ কাঁঠালবেড়িয়া গ্রামে মামার বাড়িতে আসে। মা উমা মণ্ডল, গ্রামে তৃণমূল কর্মী, কাজের সুবাদে আন্দামানে থাকেন। রবিবার তিনি আন্দামান নিকোবর থেকে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে আকাশপথে রওনা দিয়ে রাতে ফিরে আসেন কাঁঠালবেড়িয়ায়। হেমনগর কোস্টাল থানার ওসি সহ অন্যান্য পুলিশ কর্মীও সৈকতকে দেখতে আসেন।
এতকিছুর পরেও সৈকতের চিকিৎসা এখানে শুরু করা যায়নি। রবিবার সকালে সিপিআই(এম) নেতা রবি বিশ্বাসের সঙ্গে পার্টি নেতৃবৃন্দ সৈকতকে দেখতে কাঁঠালবেড়িয়া যান। সৈকত সংবাদমাধ্যমকে জানায়, মাথায় বুকে পায়ে পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা রয়েছে।
শুক্রবার রাতে তিন তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনা। বিভিন্ন মহল থেকে দুর্ঘটনার বিভিন্ন কারণ দর্শানো হচ্ছে। এমতবস্থায় সৈকতের যুক্তি অদ্ভূত। সৈকত বলছে, ‘‘আমাদের ট্রেনটি অর্থাৎ যশবন্তপুর সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসটি বেঙ্গালুরু থেকে যদি ছাড়তে দেরি না করতো এবং মাঝ পথে ফের দেরি না করত তাহলে আমরা দুর্ঘটনায় পড়তাম না। সৈকত বৃহস্পতিবার অসংরক্ষিত যাত্রী কামরায় চাপে। দু’ঘন্টা দেরি করে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ট্রেনটি ছেড়েছিল।
বিশাখাপত্তনমে এসে ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে সাড়ে ৩ ঘন্টা দেরি করে। এরপর প্রচণ্ড গতিতে চলতে শুরু করে। গোদাবরী সেতু পার হতে সময় নেয় সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিনিট। ৫মিনিটে পার হয়ে গেল এবং বিকট শব্দে।
দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা জানিয়ে সৈকত বলছে, ‘‘আচমকা বিকট শব্দ। তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন শরীর রক্তে ভেজা। চতুর্দিকে লাশ আর লাশ। পোষাকের ব্যাগ, ২১ হাজার টাকা দামের মোবাইল, নগদ ৫-৭ হাজার টাকা নেই। কোথায় সে জানে না। কাছে ছিল ১ হাজার টাকা ও ট্রেনের টিকিটটি।’’
স্থানীয় পুলিশ সৈকতের মতো যাত্রীদের বলে হাইরোডে চলে যেতে। সেখানে বাস আছে। ভাড়া লাগবে না। ২০০-৩০০ জন যাত্রী হাইরোডে উঠে বাসে চড়ে কিছুদূর যাওয়ার পর বাস থেকে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে কনডাক্টর জানিয়ে দেয় কলকাতায় পৌঁছাতে ১০০০ টাকা লাগবে মাথা পিছু। কিছু আহত মানুষ থেকে যায়। সৈকত সহ ঝাড়খণ্ড, বিহার এই রাজ্যের নিউ কোচবিহার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বকখালি, নামখানা, কাকদ্বীপের বাসিন্দারা বাসে চড়ে কলকাতার বাবুঘাটে এসে নামেন। এরপর অন্য একটি বাসে উঠে বাসের কনডাক্টরকে ঘটনার কথা বলতেই বিনাভাড়ায় শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে দেন। জিআরপিকে মায়ের মোবাইল নম্বর জানালে তাঁরা যোগাযোগ করে। সেখান থেকেই খবর যায় মামার বাড়িতে। জিআরপি'র কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে হাসনাবাদ লোকাল ধরে ফিরে আসে মামার বাড়িতে।
সৈকতের কলেজে পড়াশোনা করার কথা। কিন্তু নবম শ্রেণিতে উঠে পড়াশোনা ছেড়ে বেঙ্গালুরুতে জিএসএস প্যাকেজিং কোম্পানিতে কাজ করতে চলে যায়।
অন্যদিকে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় এ যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেলেন হাসনাবাদ থানার হাবাসপুরের বাসিন্দা আতাউর মোল্লা (২৫)। বাবা সিরাজুল মোল্লা। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ থানার মাখালগাছা গ্রাম পঞ্চায়েতের হাবাসপুর গ্রামে। কেরালায় যাচ্ছিলেন তিনি। রবিবার তাঁর বাড়িতে গেলে দেখা যায় মাথায় ব্যান্ডেজ। দিনমজুরের পরিবার। আতাউররা তিন ভাই। আতাউর মেজ। বড়ভাই সরিফুল ও ছোট ভাই রেজাউল ইটভাটা শ্রমিক। বাবা সিরাজুল মোল্লা পেশায় ভ্যানচালক। আতাউর জানান যে কেরালার যে মসজিদে তার ইমামতি করার কথা ছিল তারাই খবর পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
আতাউর স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়াতেন সামান্য বেতনে। ঘরে প্রচণ্ড অভাব। খাওয়া থাকার খরচ বাদে মাসিক ১৫ হাজার টাকার বেতনের কাজে কেরালার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। এরপরের অভিজ্ঞতা বিভীষিকাময়। রবিবার দুপুরে অসুস্থ শরীরে জানালেন নিজে বেঁচে ফিরে আসা এবং অন্যান্য ট্রেন যাত্রীদের উদ্ধারে হাত লাগানোর কথা। রবিবার ভোরে তিনি তমলুক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফেরেন।
একদিকে থেমে নেই মৃত্যু মিছিল। চারিদিকে হাহাকার। আবার রবিরাই সকালে ব্যাগপত্র নিয়ে তামিলনাড়ুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দেখা গেল হিঙ্গলগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্তের পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি দলকে। এদিন সকালে হিঙ্গলগঞ্জের নেবুখালি বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা শ্রমিকরা বললেন, ‘‘গ্রামে থেকে না খেয়ে মরব?’’
আতাউড়ের বাড়িতে গিয়েছিল যুবনেতা আবুল কালাম মোল্লা ও হারুন অল রসিদ। পেট চালাতে কাজটাই বড় তাঁদের কাছে। মৃত্যু সেখানে তুচ্ছ। প্রশ্ন থেকে যায় জীবন আগে না জীবিকা আগে? সুন্দরবনের লোনা মাটির ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে উত্তর -জীবিকা আগে, জীবন পরে।
Comments :0