COLD BLOODED ANIMALS

বাড়তি তাপমাত্রার জেরে
অস্তিত্ব-সঙ্কটে শীতল রক্তের প্রাণীরা

আন্তর্জাতিক

COLD BLOODED ANIMALS

অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়

জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা এবার সরাসরি নেমে আসছে শীতল রক্তের প্রাণীদের ওপর। অস্তিত্ব সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকা ওই প্রাণীদের ভবিষ্যত নিয়ে দারুণ চিন্তিত বিজ্ঞানীরা। 

জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় বিশেষত শীতল রক্তের প্রাণীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জপত্রিকায়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে দেহের ভিতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী প্রাণীদের বাড়তি শক্তি চাহিদা তাদের অবলুপ্তির পথে ঠেলে দেবে।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই জগতের প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন শক্তি। খাদ্যের মাধ্যমে সংগৃহীত ওই শক্তি দিয়েই প্রাণীদের আবশ্যিক কিছু শারীবৃত্তীয় কাজ করতে হয়। শ্বাসপ্রশ্বাস চালানো, রক্ত সঞ্চালন করা, খাদ্যকে হজমের পাশাপাশি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাফেরারটা এর মধ্যে পড়ছে। কমবয়সী প্রাণীরা শক্তিকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের পরবর্তী বৃদ্ধির কাজটি করে। পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে শক্তির একটা অংশ ব্যবহৃত হয় প্রজননে। 

পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়লে সব প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রা বাড়ে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আর দুই তাপমাত্রার সমতা করতে গিয়ে দেহের প্রয়োজন পড়ে বাড়তি শক্তির। গরম রক্তের প্রাণীদের পরিবেশের বাড়তি তাপমাত্রা নিয়ে তেমন সমস্যায় না পড়তে হলেও শীতল রক্তের প্রাণীদের ক্ষেত্রে বাইরের তাপমাত্রা বদলে মারাত্মক সমস্যা ঘটে। এর কারণ শীতল রক্তের প্রাণীরা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাইরের তাপমাত্রার পরিবর্তনে তাদের আভ্যন্তরীণ দেহ তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়।

বিপাক, বাড়তি শক্তি

আর এখান থেকে সমস্যার শুরু। পরিবেশের তাপমাত্রার বাইরেও শীতল রক্তের প্রাণীদের ভবিষ্যতের শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনটা আরো বেশি থাকে। এর কারণ রক্ত শীতল থাকায় ওই সব প্রাণীদের দেহের ভিতরের বিপাকীয় কাজকে সুসম্পন্ন করতে বাড়তি শক্তির প্রয়োজন পড়ে। বিপাকীয় হার অন্য বিষয়ের ওপরেও নির্ভর করে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাণীদের  শরীরের মাপ এবং তাঁদের কাজ কারবার। বড় দেহের প্রাণীদের আকারের জন্য বিপাকীয় হার বেশি হয় ছোটো দেহের প্রাণীর তুলনায়। এর পাশাপাশি সক্রিয় প্রাণীদের বিপাকীয় হার শ্লথ গতির প্রাণীদের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে। 

বিপাকীয় হারের যে কোনও ঘাটতি ওই সব প্রাণীদের দেহের স্বাভাবিক জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়। দেখা গেছে, যদি প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রা বাড়ে, তবে তাদের বিপাকীয় হার বাড়তে শুরু করে। আর সেটিকে সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার পরে বাড়তি শক্তির। জানতে অবাক হতে হয়, এই জীবজগতের বেশিরভাগ প্রাণীই শীতল রক্তের। বিজ্ঞানের ভাষায় এদের এক্টোথার্মসবলে। কীটপতঙ্গ, কৃমি, মাছ, খোলশযুক্ত প্রাণী, উভচয়, সরীসৃপ এই শ্রেণিতে পড়ে। সাধারণত স্তন্যপায়ী আর পক্ষী শ্রেণিরা ‘এন্ডোথার্মস’। 

পরিবেশের তাপমাত্রার ওপরে তাদের রক্তের তাপমাত্রা তেমন নির্ভর করে না। লাগাতার বিশ্বের তাপমান বাড়তে থাকায়, শীতল রক্তের প্রাণীরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে নিজেদের রক্তের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে চলেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ডাঙায় থাকা শীতল রক্তের প্রাণীরা ইতিমধ্যে তাদের দেহের তাপমাত্রাকে ৩.৫ থেকে ১২ শতাংশ বাড়িয়ে নিয়েছে। এতে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এর জেরেই দরকার পড়ছে বাড়তি শক্তি। নিয়মিত সেই শক্তির জোগান দিতে দরকার পড়ছে প্রচুর খাদ্যের। সকল প্রজাতি সেই খাদ্যের সংস্থান না করতে পেরে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। তাপমাত্রা মাত্রারিক্ত বাড়তে থাকলে গরম রক্তের প্রাণীদেরও বিপাকীয় হার বাড়াতে হবে।

কিভাবে কমতে পারে বংশবিস্তার

হিসাব কষে দেখা গেছে, বাইরের আরো বাড়তে থাকলে ডাঙার গরম রক্তের প্রাণীদের বিপাকীয় হার ২০৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে। বাড়তি বিপাকীয় কাজ করতে তাদেরও অন্য প্রাণীদের মতো বাড়তি খাবার খেতে হবে। আর তা সংগ্রহ করতে না পারলে ভুখা থাকতে হবে। শক্তি জোগান কমে গেলে ওই সব প্রাণীর প্রজননে সরাসরি প্রভাব পড়বে। বংশবৃদ্ধি কমে গেলে প্রজাতির সংখ্যা আরো কমতে থাকবে। গরম রক্তের প্রাণীদের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আগেও গবেষণা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে তা সবই পরীক্ষাগারে করা গবেষণা। 

ল্যাবরেটরিতে চালানো ওই পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রকৃতির বাড়তি তাপমাত্রা কতটা বিপাকীয় কাজে প্রভাব ফেলে। কিন্তু পরিবেশে থাকার সময় ওই সব প্রাণীদের আরো অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। আর তার জেরে কী ধরণের বিপাকীয় হার বদলে যায় তা নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। এযাত্রায় সেটা করেছে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা। ফলের মাছির ওপর বিস্তারিত গবেষণা চালানো হয়েছে। ওই সব ফলের মাছিরা পচতে থাকা উদ্ভিজ্জ উপাদানের ওপর ডিম পাড়ে। কিছুদিনের মধ্যে ডিম থেকে বের হওয়া লার্ভারা ওই  উদ্ভিজ্জ উপাদানকেই খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। 

বিভিন্ন পরিবেশের নানান তাপমাত্রার ওপরে ওই সব মাছিদের পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গেছে, গরম পরিবেশে মাছির দুই প্রজাতির লার্ভাকে খাবারের জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে। সময় পার হওয়ার পর এক প্রজাতির লার্ভা পূর্ণবয়স্কের মতোই সক্রিয় থাকলেও পূর্ণবয়স্ক মাছিরা প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে শক্তি হারাতে থাকে। এখন যেহারে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে তাতে শুধুমাত্র কীটপতঙ্গকে নিজেদের বিপাকীয় হার ঠিক রাখতে ভবিষ্যত শক্তি চাহিদাকে ভবিষ্যত শক্তি চাহিদা ৩ থেকে ১৬ শতাংশ বাড়াতে হবে। আর সেটা করতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন তা মেলা দায়। কীটপতঙ্গের বর্তমান বাড়বাড়ন্ত সেই দিককে নির্দেশ করছে। খাদ্যের বাড়তি সন্ধান করতে গিয়ে মানুষের তৈরি ফসলে হাত পড়বে বলেই এখন আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের। গরমে খাদ্যের জন্য মশার বেপরোয়া হয়ে ওঠাটাও তাই।

Comments :0

Login to leave a comment