সৃজন ভট্টাচার্য
স্বচ্ছ ছাত্রসংসদ নির্বাচন চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ির চাকার তলায় ছাত্র। প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে রাজ্য। প্রতিবাদীদের উপর যত পুলিশ-গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে আক্রমণ বাড়াচ্ছে তৃণমূল, তত ভিড় বাড়ছে, তেজ বাড়ছে লড়াইয়ের। যাদবপুরের নজিরবিহীন নৃশংস ঘটনার দায় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। ইচ্ছাকৃত গাড়ি চাপার দেওয়ার দায়ে শিক্ষা মন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেপ্তারি চাই। ষড়যন্ত্রে শামিল সকল বহিরাগতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা চাই। আক্রান্ত ছাত্রদের পাশে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দাঁড়াতে হবে। এবং, অবিলম্বে যাদবপুর সহ রাজ্যজুড়ে ছাত্রভোট করতে হবে।
এই দাবিগুলি নিয়ে যখন রাজ্যের ছাত্র সমাজ উত্তাল হচ্ছে, তৃণমূল বারবার একটি ভাইরাল হয়ে যাওয়া ছবিকে কেন্দ্র করে যাবতীয় বিতর্ককে কানাগলিতে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই এসএফআই একাধিক প্রশ্ন ও দাবিদাওয়া রেখেছে এবং ওদের সমস্ত অপপ্রচারের উত্তরও দিয়েছে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতেই লেখা।
১) তৃণমূল বলেছে, ঘটনার দিন যাদবপুরে দু'একজন বাদে বহিরাগতরা ছিল না। আমরা ইতিমধ্যেই সাংবাদিক বৈঠক করে নাম ও ছবি দিয়ে অন্তত ৫ জন টিএমসিপি কর্মীর পরিচয় প্রকাশ করেছি। আরও আছে। এরা কেউ যাদবপুরের প্রাক্তনী নয়, অধ্যাপকও নয়। এরকমও টিএমসিপি নেতা আছে যে দৌরাত্ম্য করে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই ঢুকতে পারে না আদালতের নির্দেশে। শনিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের অধ্যাপক সংগঠনের সভায় এরা কী করছিল? এদের অনেককেই শিক্ষা মন্ত্রীর ঘাড়ের কাছে গিয়ে ছবি তুলতে দেখা গেছে। এই বহিরাগতদের আগমনকে শিক্ষামন্ত্রীর নিরাপত্তাভঙ্গের কারণ হিসাবে কেন ধরা হবে না? তৃণমূলের মুখে কুলুপ।
২) তৃণমূল বলেছে, এসএফআই সেদিন শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দিয়েছিল, তা সত্ত্বেও নাকি বলছে, শিক্ষা মন্ত্রী সময় দেননি। সর্বৈব অসত্য অভিযোগ। এসএফআই একবারও বলেনি শিক্ষা মন্ত্রী সেদিন তাদের ডেপুটেশন নেননি। বলেছে, তিনি যাদবপুরের কিছু ছাত্রের ডেপুটেশন নিলেন, বাকিদের নিলেন না, তারা যখন কথা বলতে এল, তখন গাড়ি চালিয়ে দিলেন কেন? এমনকী ইন্দ্রানুজের সাথেও শিক্ষা মন্ত্রীকে কথা বলতে দেখা গেছে। যার সাথে একটু আগে কথা বললেন, তার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলেন, এত পাশবিক! শিক্ষা মন্ত্রী নাকি মিডিয়াকে বলেছেন, তিনি বিকাশ ভবনে এসএফআই-কে সময় দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা যায়নি। বিগত ২৭ জানুয়ারি এসএফআই নেতা-কর্মীরা রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে যখন বিকাশ ভবনে গিয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী সেখানেই ছিলেন কিন্তু দেখা করেননি, উলটে পুলিশ লেলিয়ে মারধর করেছিলেন এসএফআই নেতাদের।
৩) ইন্দ্রানুজ গাড়ির তলায় পড়ে আছে, এই ছবি ভাইরাল হয়েছে, গণশক্তিতেও ছাপা হয়েছে। অন্য কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমেও দেখানো হয়েছে। তৃণমূলের আবদার, যে ভিডিও থেকে ওই 'স্ন্যাপ'টি নেওয়া হয়েছে, সেটা চলবে না। সব ভিডিও ফুটেজেই স্পষ্ট দেখা গেলেও শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়িতে ইন্দ্রানুজই ধাক্কা খেয়েছে, ওরা মানবে না। ওরা প্রথমে অন্য একটি ছেলেকে ইন্দ্রানুজ বলে চালিয়ে বোঝাতে গিয়েছিল যে শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ির চাকার তলায় কেউ চাপা পড়েনি। আমরা সাংবাদিক বৈঠকে ভিডিও দেখিয়ে তৃণমূলের সেই মিথ্যাচারকে বেআবরু করেছিলাম। তারপর ওরা আর সেগুলো বলছে না, এখন অন্য কথায় চলে গেছে। এরমধ্যে অন্য একটি ভিডিওতে আমরা দেখিয়েছি, প্রকাশিত ছবিটির চরিত্রগুলো, তাদের অবস্থান, সবকিছুই প্রমাণ করে, গাড়ির সামনে পড়ে থাকা ছাত্রটি ইন্দ্রানুজই। পিছন থেকে তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ির সামনে ইন্দ্রানুজ চলে আসার পর গাড়িটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা 'বাম্প' খেল। অথচ ওখানে কোনও বাম্পার নেই। তারপরই দেখা গেল ইন্দ্রানুজ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। আমাদের প্রশ্ন, এই 'বাম্প'টা কীসের ছিল তাহলে? তৃণমূল নির্বাক।
কিচ্ছু ঘটেনি, তৃণমূলের দাবি। তাহলে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই ইন্দ্রানুজের বাবাকে ফোন করে এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন কেন? ব্রাত্য বসু কিন্তু বলছেন না যে তাঁর গাড়ির তলায় ছাত্রের চাপা পড়ার ঘটনা বা ঐ ছবি, অসত্য। কিন্তু, তৃণমূলের বাকিরা এই মিথ্যাচার লাগাতার করে চলেছে। অবশ্য তৃণমূলের এক কাউন্সিলর নেত্রী সন্দেশখালির ঘটনার পর বলেছিলেন, ধর্ষণ যে হয়েছে তার ভিডিও ফুটেজ কোথায়? যারা ধর্ষণের ভিডিও চাইতে পারে, তারা 'হিট অ্যান্ড রান'-এর ক্ষেত্রেও একই কাজ করবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
৪) গাড়ির চাকা যদি চলে গিয়ে থাকে মাথার ওপর দিয়ে, তাহলে ওটুকু আঘাত কেন, তৃণমূলী প্রশ্ন! গাড়ির চাকা চোখ ছুঁয়ে পাশ দিয়েও যেতে পারে, গাড়ির অন্য অংশেও লাগতে পারে। প্রশ্নটা চাকা কোথা দিয়ে গেল, তা নয়। আসল কথা হলো, এই ছেলেটিকে আহত করেই শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ি চলে গিয়েছিল। আরও অনেক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ব্যান্ডেজ খোলার পর ইন্দ্রানুজের চোখের পাশে অজস্র সেলাই, এ ছবি ইতিমধ্যেই দেখেছেন সকলে। কেউ যদি প্রশ্ন করে, মাত্র এটুকু কেন, আরও কেন রক্ত নেই, মাথা থেঁতলানোর ভিডিও নেই কেন, তাকে বিকৃতমনস্ক ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।
৫) ইন্দ্রানুজের মাওবাদী পরিচয়। যাদবপুরের ভিতরে এসএফআই বিরোধী ইন্দ্রানুজ এক বাদানুবাদের পরিবেশে বলেছিল, এসএফআই-এর 'লাশ ফেলে দেব', এই ভিডিও দেখিয়েছে তৃণমূল। রূঢ় বাস্তবটা হলো, এসএফআইকে কেউ মৌখিকভাবে কিছু বলেছে কিনা জানি না, কিন্তু সত্যি সত্যি লাশটা ফেলে দেওয়ার জায়গায় চলে গিয়েছিলেন যিনি, তিনি আর কেউ নয় তৃণমূলের শিক্ষা মন্ত্রী।
ইন্দ্রানুজের সাথেই অভিনব বা অনুজ্ঞা বা রাসেল ইত্যাদি ছাত্ররা আহত হয়েছে সেদিন। এরা অনেকেই এসএফআই, কেউ তো স্বঘোষিত মাওবাদী নয়, তাহলে এরা মার খেল কেন? তার মানে, যারা মারতে এসেছিল, তারা প্রতিবাদীদের মধ্যে কে এসএফআই, কে অন্য কোনও সংগঠনের - এসব বাছবিচার করে মারতে আসেনি। ইন্দ্রানুজের সাথে অবশ্যই এসএফআই কর্মীদের রাজনৈতিক বিতর্ক পরেও হবে, কিন্তু এক্ষেত্রে কে কোন সংগঠন করে তা গৌণ। কারণ যাদবপুরের সব ছাত্র সংগঠনগুলির দাবি ছিল এক ও অভিন্ন - গণতান্ত্রিক ছাত্রভোটের দাবি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য নেই, স্থায়ী সহউপাচার্য নেই, স্থায়ী ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল নেই, স্থায়ী ডিনেরা নেই, ছাত্র ইউনিয়নগুলিও অকেজো। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত স্বচ্ছ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবি করতে গিয়ে ছাত্ররা শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে, এই মোদ্দা কথাটা ভুলিয়ে দিতে এখন ইন্দ্রানুজের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে একসুরে নেমে পড়েছে তৃণমূল বিজেপি। আমদের কথা, যদি কোনও টিএমসিপি সমর্থকও স্বচ্ছ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবি করতে গিয়ে তৃণমূলের শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ির চাকার তলায় চলে যেত, তার হয়েও প্রতিবাদে আমরা নামতাম।
এর সাথে আনুষঙ্গিক কিছু অভিযোগ তৃণমূল করেছে, যেমন, সিসিটিভি। যাদবপুরে সিসিটিভি আছে একগুচ্ছ। কেউ কোনোদিন ভাঙেনি। বরং, মাত্র একবছর আগেই র্যারগিংকাণ্ডের সময়ে দেখা গেছে, টিএমসিপি যাদবপুরে সিসিটিভি চাইছে, আর স্বরূপনগরে শহীদ নুরুল ইসলাম কলেজে সিসিটিভি ভাঙছে। এই দ্বিচারিতা তাদের, এসএফআই’র নয়।
শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে এসএফআই’র প্রশ্ন —
এক, ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না কেন রাজ্যে? আর জি কর আন্দোলনের সময়ে স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ছাত্রভোটের দাবি তো জুনিয়র ডাক্তাররাও করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তারপর কী হলো? পশ্চিমবঙ্গে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি ও রবীন্দ্রভারতীতে শেষ ছাত্র ভোট হয়েছে ৫ বছর আগে (রবীন্দ্রভারতী লুট হয়েছিল, বাকি দু’টোয় এসএফআই ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী শক্তিরা জিতেছিল)। রাজ্যের বাকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ৮ বছর আগে শেষবার ভোট হয়েছে। ছাত্রভোট বন্ধ কেন, কার স্বার্থে? কবে হবে?
দুই, ছাত্র ইউনিয়ন নেই, কিন্তু বছরের পর বছর রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে সেমিস্টার প্রতি একেকজন ছাত্রের থেকে বিপুল পরিমাণে 'ইউনিয়ন ফি' নেওয়া চলছে। এসএফআই উদাহরণস্বরূপ মিডিয়ার কাছে বেশ কয়েকটি কলেজের নাম উল্লেখ করেছে অর্থ সংগ্রহের রসিদ সহ। কলকাতায় এমনও কলেজ আছে, যেখানে ৭৫০ টাকা অবধি ইউনিয়ন ফি নেওয়া হচ্ছে। এই 'ইউনিয়ন ফি' কোথায় যাচ্ছে? তৃণমূলের পকেটে? এটা কি এক ব্যাপক বড় দুর্নীতির নয়? এই টাকার হিসাব দেবে কে? সবকটি কলেজে টিএমসিপি’র মৌরসিপাট্টা। টিএমসিপি সহ জবাব দেবে কি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলি?
তিন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় পুলিশ ইন্দ্রানুজ সহ ছাত্রদের বয়ান নিতে গড়িমসি করেছে কেন? কেন হাইকোর্টকে ধমক দিয়ে বলতে হলো ইন্দ্রানুজের বয়ানের ভিত্তিতে এফআইআর করার কথা? কী ঢাকতে চাইছে পুলিশ? যাদবপুরের এক প্রাক্তনী ঘটনার পরের রাতেই গ্রেপ্তার হয়ে গেল, কিন্তু যাদবপুরের সাথে ন্যূনতম সংশ্রব না থাকা তৃণমূলী বহিরাগতরা গ্রেপ্তার হলো না কেন?
চার, রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদীদের উপর পুলিশ-তৃণমূল যৌথ গুন্ডামির ঘটনা ঘটছে কেন? মেদিনীপুরে এসএফআই সহ বিভিন্ন প্রতিবাদী সংগঠনের মেয়েদের উপর পুলিশের অকথ্য অত্যাচার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে! একের পর এক জায়গায় বামপন্থীদের দলীয় দপ্তরে হামলা করছে তৃণমূল। আর এই ঘটনায়, তাদের বি-টিম হিসাবে কাজ করছে আরএসএস এবিভিপি। দুই ফুলের একই সুর, বুঝিয়ে গেল যাদবপুর। যদি যুক্তির জোরই থাকে, তবে এত হুমকি আর পুলিশি নির্যাতনের প্রয়োজন পড়ছে কেন? শিক্ষা মন্ত্রী বলবেন কিছু!
আমাদের কোথাও কারো সাথে কোনও মুখোমুখি আলোচনায় বসতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের প্রশ্নের উত্তর চাই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে যে পরিমাণ দায়িত্বজ্ঞানহীন কুৎসা ও ঘৃণাবর্ষণ করছে বিজেপি-তৃণমূল, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী সহ যে কারোর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রী, হয় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি দিন, নয় এই মিথ্যাচার বন্ধ করতে বলুন আপনার সাঙ্গোপাঙ্গদের।
Comments :0