Supreme Court Child Marriages

বাল্যবিবাহ বন্ধে কড়া নির্দেশিকা সুপ্রিম কোর্টের

জাতীয়

বাল্যবিবাহকে ‘‘সামাজিক শত্রু’’ আখ্যা দিয়ে দেশজুড়ে এই প্রবণতা রুখতে কঠোর অবস্থান নিলো সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত এক মামলায় রায় দিতে গিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকায় অসন্তোষ গোপন করেনি শীর্ষ আদালত। আরও কার্যকরীভাবে বাল্যবিবাহ নির্মূলের কাজ চালাতে এদিন কেন্দ্র, রাজ্য এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে একগুচ্ছ নির্দেশিকাও জারি করেছেন বিচারপতিরা। সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জেলাপর্যায়ে চাইল্ড ম্যারেজ প্রহিবিশন অফিসার (সিএমপিও) নিয়োগ ছাড়াও জনসচেতনতা বাড়ানো, কাউন্সেলিং ইত্যাদির নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
বাল্যবিবাহ বেড়ে চললেও রাজ্যগুলিতে ২০০৬ সালের বাল্যবিবাহ নিষেধ আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না বলে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থের আবেদন পেশ করেছিলো একটি অ-সরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে এদিন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চ বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় রীতিমতো অসন্তোষ প্রকাশ করে। ১৪১ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারপতিরা বলেন, ‘‘বাল্যবিবাহ সামাজিক শত্রু। আইন অনুযায়ী সাবালক হওয়ার আগে বিয়ে দেওয়া হলে তা ফৌজদারি অপরাধ। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে প্রায়-সর্বজনগ্রাহ্য বোঝাপড়া থাকলেও, এই ঘটনা বেড়েই চলেছে।’’
আরেকটি বিতর্কিত প্রসঙ্গের অবতারণা করে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিন স্পষ্ট বলেছে, কোন ব্যক্তিগত আইনের কথা তুলে ২০০৬ সালের বাল্যবিবাহ নিষেধ আইনকে খাটো করা চলবে না। এব্যাপারে বিভিন্ন হাইকোর্ট পরষ্পরবিরোধী রায় দিয়েছে বলে দাবি করলেও তা নিয়ে কোন নথি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, মন্তব্য করেন বিচারপতিরা। 
চলতি আইনের সীমাবদ্ধতায় ইঙ্গিত করে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, বাল্যবিবাহ নিষেধ আইনের সংশোধন করতে চেয়ে ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর সংসদে একটি বিল পেশ করেছিলো কেন্দ্র। কিন্তু সেই বিল শিক্ষা, মহিলা, শিশু, যুব, ক্রীড়া দপ্তরের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যায়। সেই সংশোধনী বিলে বাল্যবিবাহ নিষেধ আইনকে বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইনের ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া হয়েছে। বিলটি এখনও সংসদের বিবেচনাধীন, আক্ষেপ বিচারপতিদের।
সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিচারপতিরা এদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন, কম বয়সে অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকশিত হওয়ার আগেই কাউকে বিয়ে দেওয়া হলে, তার কাছ থেকে আসলে জীবনসঙ্গী বাছার অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়। বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যথোচিত বোধ, বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গী  অথবা দায়বদ্ধতা থাকেনা একজন নাবালক বা নাবালিকার। তাই এই ধরনের বিবাহে প্রায়শই সংশ্লিষ্ট নাবালক বা নাবালিকার বুদ্ধিগত, সামাজিক এবং মানসিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়; এমনকি জীবনের ঝুঁকিও তৈরি হয়।
অত্যন্ত বিপজ্জনক এই বাল্যবিবাহ সমাজ থেকে নির্মূল করতে একগুচ্ছ নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে এদিনের রায়ে। বলা হয়েছে, লিঙ্গ, জাত, সম্প্রদায়, আর্থ-সামাজিক ও ভৌগলিক অবস্থার মতো নানান বিষয় বাল্যবিবাহের আশঙ্কা বাড়ায়। তাই দারিদ্র্য, লিঙ্গ অসাম্য, শিক্ষার অভাব, সংস্কার ইত্যাদির মতো মূল কারণগুলিকে চিহ্নিত করে জনগোষ্ঠীভিত্তিক পৃথক পৃথক কৌশল নিতে হবে। বাল্যবিবাহ নির্মূলের কর্মসূচি নেওয়ার সময় পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী বিশেষত প্রান্তিক সম্প্রদায়ের নাবালিকা মেয়েদের দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে।
বিচারপতিরা বলেছেন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যে আইন রয়েছে সেসম্পর্কে সব সম্প্রদায়, সব জনগোষ্ঠীর কাছে প্রচার নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিংয়ের কাজ চালাতে হবে ধারাবাহিকভাবে। প্রশাসনিক আধিকারিকদের জন্যও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজ এবং জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে সচেতন করা গেলে বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়া যাবে, উল্লেখ করেছে শীর্ষ আদালত।
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সতর্ক করে রায়ে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে বাল্যবিবাহ আটকানো সম্ভব হবে না। সবার আগে এই ধরনের অপরাধের বিপদ এবং কঠোর শাস্তির বিধান সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে হবে। এই বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি যাতে উদ্ভব না হয় তা দেখতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। শাস্তির কথা উঠবে সবার শেষে।
বাল্যবিবাহ নির্মূলের কাজে যথোচিত গুরুত্ব আনতে সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে জেলা পর্যায়ে চাইল্ড ম্যারেজ প্রহিবিশন অফিসার (সিএমপিও) নিয়োগ করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। এদিনের রায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সিএমপিও’র ঘাড়ে আর কোন সরকারি কাজ চাপানো চলবে না। ভারতজুড়ে এই অফিসারদের একমাত্র বাল্যবিবাহ নির্মূলের কাজই গুরুত্ব দিয়ে করার সুযোগ দিতে হবে। বলা হয়েছে, রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মহিলা ও শিশু কল্যাণ দপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নিয়মিতভাবে সিএমপিও এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজকর্ম খতিয়ে দেখবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পুলিশকর্মীদের একটি পৃথক টিম তৈরির নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এই অভিযানের দায়িত্বে গাফিলতি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিককে কড়া শাস্তির বিধানও দিয়েছে শীর্ষ আদালত। 

Comments :0

Login to leave a comment