MOHAN BHAGWAT"S KOLKATA TRIP

কেন বাংলায় নজর আরএসএস প্রধানের

রাজ্য

গৌতম রায়

পড়ন্ত শীতের বেলায় কলকাতা মহানগরীতে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত এলেন। কয়েকদিন থাকলেন। সাংগঠনিক গোপন সভা করলেন। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এবং হুগলি জেলায় প্রকাশ্য সভা করলেন। 

সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতা মহানগরীর বুকে মোহন ভাগবতের শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের অকুস্থল থেকে প্রায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই সুভাষচন্দ্রের প্রতি সরকারিভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আরএসএস প্রধান বা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা, কেউ - ই পরস্পর পরস্পর সম্বন্ধে সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে তো দূরের কথা , গত কয়েকদিনে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না।

সুভাষচন্দ্রের অনুষ্ঠান ছাড়াও আরএসএসের বিভিন্ন সংগঠনিক সভায় আরএসএস প্রধান অংশগ্রহণ করেছেন, সেই সভাগুলিতে কলকাতা সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গের প্রায় প্রথম সারির আরএসএসের নেতাকর্মীরা সমবেত হয়েছিল।  হুগলি জেলাতেও আরএসএস প্রধান সাংগঠনিক সভা করেছেন। সেই সভাতেও হুগলি, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, দুই চব্বিশ পরগনার শীর্ষস্তরের বাছাই করা কর্মী, সমর্থক এবং নেতারা অংশগ্রহণ করেছে। 

মোহন ভাগবতের বক্তব্যের প্রেক্ষিত , বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষিত, তার দিকে আমাদের একটু নজর দেওয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি , মোহন ভাগবত উত্তরবঙ্গে সফর করার সময়েই, সেখানে তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সফর করেছেন। এই দুই ব্যক্তিত্বের প্রায় একই জায়গায় সফরকালে আমরা দেখেছি ,মোহন ভাগবতের প্রতি আতিথ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদম অ-কৃপণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তাঁর প্রশাসনিক আধিকারিকদের মাধ্যমে মোহন ভাগবতের কাছে ফুল মিষ্টি ইত্যাদি পাঠিয়েছেন। 

মমতা নিজের রাজনৈতিক চিন্তার তথাকথিত পরিবর্তনের কথা বলে , নিজেকে বিজেপি বিরোধী অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সংখ্যালঘুর অধিকার সচেতন ভাবে রক্ষা করায় সচেষ্ট ইত্যাদি যতই তকমাতে আলোকিত করবার চেষ্টা করুন না কেন, বিজেপির মূল মস্তিষ্কের কাছে, নিজের রাজনৈতিক সাফল্যের চাবি বন্ধক রেখেছেন তিনি। 

ত্রিপুরা, মেঘালয়ের বিধানসভা ভোটের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিভাবে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’কে প্রশাসনিক স্তরের একেবারে ভূমি পর্যায়ে আরো নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করতে পারা যায়, যার দরুণ পরবর্তীকালে, ধীরে ধীরে প্রশাসনের অন্যান্য স্তর গুলিতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি , নিজেদের মতাদর্শগত প্রচার-প্রসার এবং রাজনৈতিক অভিপ্রায় সিদ্ধ করবার জন্য শক্তি অর্জন করতে পারে, তার দিক নির্দেশিকা ওই সভা গুলির ভেতর থেকে মোহন ভাগবত দিয়েছেন। 

আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির পাখির চোখ নির্দিষ্ট করে, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটকে কিভাবে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির কাজে লাগাবে, বস্তুত তার দিক নির্দেশিকা দেওয়াটাই ছিল আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরের প্রথম এবং প্রধান কারণ। 

বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ত্রিপুরায় কিভাবে জাতিবিদ্বেষের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে, বর্ণহিন্দুর আধিপত্যের আবেগটিকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে ,সেদিকে সঙ্ঘকর্মীরা কিভাবে নিজেদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে,  তার পথনির্দেশিকা দেওয়ার কাজ মোহন ভাগবত কলকাতা এবং হুগলিতে সংঘ কর্মীদের যে গোপন সভা গুলি করেছেন, সেখানে সে সম্পর্কে দিক-নির্দেশিকা ও জারি করেছেন।

বিভাজনের রাজনীতিকে আরও বিস্তৃত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গুলি, সেগুলি কতটা সফলভাবে আরএসএস এবং বিজেপি কর্মীরা, পশ্চিমবঙ্গে তাদের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহার করে, তার সুফল পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে আগামী লোকসভা নির্বাচনের সময়কালে হিন্দুত্ববাদীদের ঝুলি ভরাট করতে পারে, সেদিকেও খুব গভীরভাবে যে বিজেপির এবং আরএসএসের শীর্ষ স্তরের তাত্ত্বিক ব্যক্তিদের নজর রয়েছে। 

মমতা যখন প্রকাশ্যে আরএসএস এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সঙ্গে প্রায় সাড়ে ছয় বছর কেন্দ্রীয় সরকারে অবস্থান করেছিলেন, সেই সময়েও বিজেপি সহ গোটা হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে' জয় শ্রীরাম ' শব্দটির বহুল প্রচলন ছিল। বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে বিজেপির এই রাজনৈতিক স্লোগান 'জয় শ্রীরাম'  ঘিরে মমতা একটিবারও কোন আপত্তি সূচক শব্দ উচ্চারণ করেননি। কিন্তু গত ২০১৯  সালের লোকসভা নির্বাচনে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির আঠারোটি আসন জয়লাভের পর  ওই রাজনৈতিক স্লোগানকে ঘিরে প্রকাশ্য রাস্তায় এমন কিছু ব্যক্তি আচরণ দেখাতে শুরু করলেন মমতা, যার দ্বারা বিজেপির রাজনৈতিক বিরোধিতার বদলে, ভাষাবিদ্বেষ -জাতিবিদ্বেষ, এগুলোকেই উসকে দেওয়া হতে থাকল ।

আমরা দেখলাম;' বন্দে ভারত ' নামক বিলাসবহুল ট্রেনটির উদ্বোধনের সময়কালে, বিজেপির এই রাজনৈতিক স্লোগান ঘিরে হাওড়া স্টেশনে একটা নাটকীয় পরিবেশ মমতার দ্বারা সংগঠিত হলো, অথচ মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক কলকাতা সফরের সময় বা তার অব্যবহিত পরে কলকাতা বা শহরতলীতে আরএসএস-এর বিভিন্ন শাখা সংগঠন গুলির পক্ষ থেকে যেসব গঙ্গা আরতির আয়োজন করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই আরএসএসের এই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারীর স্লোগান 'জয় শ্রী রাম ' ব্যবহৃত হয়েছে। সেই স্লোগানগুলি ব্যবহার ঘিরে মমতার প্রশাসন কিন্তু একটাও আপত্তিজনক অবস্থান গ্রহণ করেনি বা এই গঙ্গারতীর আয়োজনের আড়ালে আরএসএস এর অবস্থান এবং সেখানে 'জয় শ্রীরাম'  স্লোগান দেওয়া ঘিরে মমতা ও কিন্তু আজ পর্যন্ত একটাও বিবৃতি পর্যন্ত দেননি।

আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, সামাজিক বিভাজন রেখাকে তীব্র করে তুলতে ,  হিন্দু মুসলমানের ভিতরে সামাজিক সংঘাতের পরিবেশকে, বিশেষ করে ঘৃণার পরিবেশকে, একটা অত্যুচ্চ জায়গায় পৌঁছে দিতে, এই সমস্ত কর্মসূচি গুলিকে জোরদার ভাবে পালন করতে শুরু করেছে। 

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সামান্য কিছুদিন আগে ১৯৯১ সাল থেকে আরএসএস , তাদের একটি শাখা সংগঠন' গঙ্গা সেবা সমিতি' র পক্ষ থেকে বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটে এই গঙ্গা আরতির প্রচলন শুরু করেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গঙ্গারতির পদ্ধতির মধ্যে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার সংক্রমণ তারা ঘটাতে শুরু করে। আরএসএস যেভাবে তাদের সামাজিক কর্মসূচির আড়ালে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রচার প্রসার এবং প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে, বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটে এই' গঙ্গাসেবা সমিতি' র পক্ষ থেকে গঙ্গা আরতির গোটা কার্যক্রমের ভেতরেও সেই একই পদ্ধতির প্রয়োগ তারা ঘটিয়েছিল। 

জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে স্বাধীনতার সময়কালে যে সাম্প্রদায়িক ধারা প্রবাহিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ ধারার পাশাপাশি ,তারই অন্যতম প্রতিভু মদনমোহন মালব্য ১৯১৬ সালে 'শ্রী গঙ্গা সভা ' নামক একটি সংগঠন তৈরি করে, একটা সময়ে গঙ্গারতির প্রচলন করেছিলেন। সম্ভবত হরিদ্বারের হারকিপেয়ারি নামক প্রসিদ্ধ গঙ্গার ঘাটে যে গঙ্গা আরতিতে হয় ,সেটি মদন মোহন মালবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গঙ্গা আরতির ই ধারাবাহিকতা ।  

১৯১৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ হরিদ্বারে গঙ্গার উপরে একটি বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে ,গঙ্গাকে অবরুদ্ধ করা হচ্ছে তার পবিত্রতা ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে-- এরকম একটি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী কর্মসূচিকে সামনে এনে, ব্রিটিশের সেই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিরোধিতা করে, হরিদ্বারের স্থানীয় কিছু পুরোহিত ,কিছু তথাকথিত মোহান্ত, সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মোহন মালব্য দিয়েছিলেন।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার অল্প কিছুদিন আগে থেকেই ,সেই গঙ্গা আরতির পর ,'গঙ্গা সেবা সমিতি'র পক্ষ থেকে আরএসএসের রাজনৈতিক স্লোগান ,'গোহত্যা বন্ধ করো' সেটা বেনারসের গঙ্গায় ,আরতির পর দেয়া হতে থাকে। 

এই 'গঙ্গা সেবা সমিতি' র পক্ষ থেকেই কিন্তু সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়, গঙ্গার ঘাট গুলিতে ,গঙ্গা আরতির আয়োজন করা হচ্ছে এবং সেখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই আরএসএস-এর রাজনৈতিক স্লোগান 'জয় শ্রীরাম'  থেকে শুরু করে গোহত্যা বন্ধ করো ইত্যাদি শব্দগুলি উচ্চারিত হচ্ছে। 

Comments :0

Login to leave a comment