গৌতম রায়
আরএসএস তাঁকে বলেছিল ‘দুর্গা’। কারণ বামপন্থীদের শায়েস্তা করার হাতিয়ার। আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলছেন, ‘আরএসএস এত খারাপ নয়।’ একবার নয় একাধিকবার।
‘এত খারাপ নয়’ যে আরএসএস, তারই প্রধান, মোহন ভাগবত কোনো রাখঢাক না রেখে সোজা হুমকি ছুঁড়েছেন, আদেশও দিয়েছেন। মুসলিমদের সহনাগরিক বলে ভাবতেই রাজি নন তিনি, নয় আরএসএস। জানা কথাই ফের ঘোষণা করেছেন। আঘাত তো কেবল মুসলিমদের নয়, সরাসরি আঘাত দেশের সংবিধানে। আঘাত সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পক্ষে থাকা প্রতিটি অংশকে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ২০২৫’এ শতবর্ষ পালন করবে। তার মানে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আঘাত করবে আরও জোরে। উগ্র বিভাজনের পথে হাঁটবে। এই আশঙ্কা ছিলই। স্পষ্ট হলো ‘সরসঙ্ঘচালক’ মোহন ভাগবতের সঙ্ঘের মুখপত্রে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে।
সঙ্ঘপ্রধান আর প্রচ্ছন্ন রাখেননি, একদম সরাসরি ভারতকে মুসলমান মুক্ত, রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে মেলে ধরতে তাঁদের যে কর্মসূচি, তাকেই স্পষ্ট করেছেন।
আমাদের মনে রাখা দরকার সঙ্ঘ প্রধানেরা চরম নাশকতামূলক কর্মসূচি অত্যন্ত গোপনে, অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর, তা নিয়ে মুখ খোলেন। ওই সাক্ষাৎকারে মুসলমানদের ‘আধিপত্যের ধারণা’ ছাড়তে বলেছেন ভাগবত। মুসলিমরা এভাবে ভাবেন, কোথায় ঠিক হলো? আসলে জানানো হলো যে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ ভারতের বুকে কায়েম করার পর্যায়ে নিজেদের উপস্থাপিত করছে আরএসএস। মুসলিমদের সহনাগরিক ভাবতে পারবেন না দেশের কেউ-ই। আসলে বলা হলো, ‘তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’।
আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার সেই লক্ষ্যেই এনআরসি, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ইত্যাদির ভেতর দিয়ে দেশের নাগরিকত্ব আইনকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে, যে সংবিধানে সংখ্যালঘুর ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেসব নস্যাৎ করা হচ্ছে।
ভাগবতই স্পষ্ট করেছেন, আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে ভারতের সংবিধানের মূল পরিকাঠামোকে আমূল বদলে দিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে রাজনৈতিক ‘হিন্দু ভারতে’ পরিণত করবার সমস্ত ধরনের জঘন্য ষড়যন্ত্র প্রায় পাকা করে ফেলেছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি যে হুমকির সুরে কথা বলতো, সেই সুরকে এখন তারা আরও শতগুণ উচ্চনাদে তুলে একদম আদেশের সুরে কথা বলতে শুরু করেছে।
আরএসএসের তাত্ত্বিক ভিত্তির অন্যতম নির্মাতা এম এস গোলওয়ালকর ভারতের স্বাধীনতার অব্যবাহিত পরেই ভারতের সহ নাগরিক মুসলমানদের কিভাবে রাজনৈতিক হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে এই ভারতে থাকতে হবে, তার একটা মডেল তৈরি করেছিলেন বহুনিন্দিত সংকীর্ণ 'সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ' তত্ত্বের দ্বারা। সেই তত্ত্বে খুব স্পষ্ট করে গোলওয়ালকার বলেছিলেন; স্বাধীন ভারতে, থুড়ি, সেটা পড়তে হবে, ‘হিন্দু ভারতে’, মুসলিম সম্প্রদায়কে সেটুকুই বরদাস্ত করা হবে, যেটুকু অধিকার রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমা ঘেন্না করে তাদের দিতে প্রস্তুত আছে।
এই রাজনৈতিক এবং সামাজিক হুমকিই হলো সংঘের ইংরেজি মুখপাত্র 'অর্গানাইজার'- কে দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রধান রাজনৈতিক তাৎপর্য । গোলওয়ালকার 'সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ' তত্ত্বের ভেতরে খুব পরিষ্কার করেই বলেছিলেন; ভারতে বসবাসকারী মুসলিমদের নাগরিক অধিকার থাকবে না। নাগরিক অধিকারহীন হয়ে তারা যদি ভারতে বসবাস করতে থাকে বা করতে চায়, তাহলে তাদের রাজনৈতিক হিন্দুদের অধীনস্থ, অর্থাৎ; জিম্মি হয়ে থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক হিন্দুদের দাসানুদাস হয়ে ভারতে মুসলমানদের থাকতে হবে।
গোটা হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী শিবির ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরএসএসের অনুগ্রহ প্রাপ্ত, বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তি, সামাজিক শক্তি এবং ধর্মের রাজনৈতিক কারবারিরা জোর কদমে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি যাতে কেন্দ্রে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য আত্মনিয়োগ করেছে।
মোহন ভাগবতকে কিন্তু এই অল্প কিছুদিন আগে, তাঁর পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে, প্রশাসনিক দুত পাঠিয়ে, ফল -মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে সম্মান জানিয়ে আপ্যায়িত করেছেন স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি কোষাগারের টাকা দিয়েই, মুখ্যমন্ত্রী আপ্যায়ন সারছেন।
বামপন্থীরা তো বটেই, এমনকি যে কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করে, নিজে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। সেই কংগ্রেস দলকেও এ রাজ্যে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা দেন। অথচ মমতা এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে, একটি বারের জন্যও আরএসএস প্রধান সহ ওই সংগঠনের প্রথম সারির নেতৃত্বের সম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক লাগাতার কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে, প্রশাসনিক বা শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হয়নি।
গুজরাট গণহত্যা কেবল নয়, স্বাধীন ভারতে, প্রায় প্রতি বছর, দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে, দাঙ্গার নামে, মুসলমানের জান মাল লুঠ করেছে, মুসলিমরা। মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে মুসলমানেরা যাদের হাতে। গোটা মুসলিম সমাজ অর্থনৈতিকভাবে গরিব থেকে গরিবতর অংশে পরিণত করবার জন্য যে আরএসএসের এবং তাদের সঙ্গী সাথীদের চেষ্টা ত্রুটি নেই। সেই আরএসএস সম্পর্কে কিন্তু আজ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটিও রাজনৈতিক আক্রমণাত্মক শব্দ উচ্চারণ করেননি।
যদি হাজার হাজার বছরের সমন্বয়ী ভারতকে আমরা বাঁচাতে চাই, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ভারতকে আমরা রক্ষা করতে চাই , জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ভিত্তিক আমাদের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, সব ধরনের রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, আরএসএসের এই ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতিকে প্রতিরোধ করা দরকার।
আরএসএস যে আজ কেবলমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়কেই ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে, রাজনৈতিক হিন্দুরাজ কায়েম করতে চাইছে, তা নয়। জন্মসূত্রে হিন্দু, এমন যে সমস্ত মানুষেরা ভারতের চির প্রবাহমান, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন, বহুত্ববাদে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন পর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতায়- সেই সব হিন্দুদেরও তারা আজ, নয়তো কাল, ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করছে।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে, যে বলপূর্বক তথাকথিত রাম মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে, সেটির যারা পরিচালক, সেই হনুমান গড়ি আখড়া, তারাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের কপিলমুনি আশ্রমে সমস্ত ধরনের পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছেন।
এই সংগঠনটি সাগর মেলা থেকে পাওয়অ বিপুল অর্থ নিয়ে চলে যায় অযোধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ওই হনুমান গাড়ি আখড়ার সাধুসন্তদের পাশে দাঁড়িয়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক কথাবার্তা বললেও, কেন বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপে উপর যে রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে সে প্রশ্ন একটি বাড়ির জন্য তোলেননি।
এমনকি ওই মেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থ, স্থানীয় মানুষদের কল্যাণে বা স্থানীয় অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ, তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য কেন ব্যবহার হচ্ছে না- এ কথা এ প্রশ্নও কিন্তু ওই হনুমান গড়ি আখড়ার সাধু-সন্তদের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা একটিবারও উচ্চারণ করেননি।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আরএসএস’র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা হনুমানগড়ি আখাড়ার লোকেরা একাধিকবার প্রকাশ্যে মমতাকে ঘিরে বহু রাজনৈতিক সম্ভাবনাময় বক্তব্যও রেখেছেন।
এই প্রক্রিয়ায়, সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যাঁরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন না, প্রকারান্তরে তাঁদেরও আরএসএস’র চরম মানবতা বিরোধী কর্মসূচির পক্ষে টানার চেষ্টা হচ্ছে।
Comments :0