May day

পয়লা মে- সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আন্তর্জাতিক

পয়লা মে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়; যা 'মে দিবস' হিসাবেও পরিচিত। ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও আত্মাহুতির ঘটনাকে এই দিনটিতে যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' এই স্লোগানকে সামনে রেখে ওই বছর বিশ্বের সব শ্রেণির শ্রমিক একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে এ দুর্বার আন্দোলনের সামনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের কিছু মৌলিক দাবি ও অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৮৮৯ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় 'আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন'-এর সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে সমগ্র দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণি একই পতাকাতলে সমবেত হয়ে ১৮৯০ সাল থেকে মে দিবসকে শ্রমিক শ্রেণির 'আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস' পালন করে আসছে। সে সময় থেকে 'মে দিবস' দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণিকে কেবল তাদের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির মধ্যেই নয়, শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্তির অভিন্ন লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্নততর চেতনায় সমৃদ্ধ করেছে।
মে দিবসের পটভূমি
উনিশ শতকের গোড়ার দিককার কথা। সংগ্রামের মাধ্যমেই এক সময় পৃথিবী থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও পরে শ্রমিকদের কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময় দেওয়া ছিল না। ফলে শ্রমিকরা তখনো ছিল শোষিত। কল-কারখানায় চাকরি টিকিয়ে রাখতে হলে সপ্তাহে ৬ দিন গড়ে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো। বিনিময়ে মিলত সামান্য কিছু মজুরি। আর নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে রোগ-ব্যাধি, আঘাত আর মৃত্যুই ছিল তাদের জীবনের নির্মম অনুষঙ্গ। কিন্তু একটা সময় এসে ঘুরে দাঁড়ালো তারা। দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি উত্থাপন করল শ্রমিকরা। ১৮৮০ সালে আমেরিকায় প্রথম এ দাবি উত্থাপিত হয়। ১৮৮৪ সালে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organised Trades and Labor Unions of the United States and Canada, পরবর্তীতে অবশ্য ১৮৮৬ সালে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে Federation of Labor রাখা হয়।
এই সঙ্ঘের মাধ্যমেই শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু মালিকরা শ্রমিকদের এই দাবি উপেক্ষা করায় ঢালাই শ্রমিক সিলভিসের নেতৃত্বে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকায় ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। আর এই ধর্মঘটের প্রধান কেন্দ্র ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর।
শ্রমিক আন্দোলন শুরু যেভাবে
বর্তমান শ্রমিক সংগ্রাম থেকে 'মে দিবসে'র সংগ্রাম ছিল অনেকটাই ভিন্ন। ১৭৬০ থেকে ১৮৩২ সাল ছিল ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের মূল পর্যায়। আর এই শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমেই যান্ত্রিক যুগের সূচনা হয়। সে সময় শ্রমিকরা মনে করত, কল-কারখানাই তাদের দুঃখকষ্টের কারণ। তাই ১৭৬০ সালে লেডউড নামক এক সুতাকল শ্রমিকের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের সুতাকল শ্রমিকরা ‘কলভাঙা আন্দোলন’ শুরু করে। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলনে শ্রমিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করলে ১৭৫৮ সালের পর তারা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করে এবং নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। কিন্তু ১৮০০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করে এবং ১৮৪৭ পর্যন্ত নানা ধরনের আইন করে অকেজো করে রাখার চেষ্টা করা হয়।
চূড়ান্ত আন্দোলন
১৮৮৪ সালে American Federation of Labor আট ঘণ্টা দৈনিক মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব পাস করে এবং মালিক ও বণিক শ্রেণিকে এই প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। এই সময়ের মধ্যে সব শ্রমিক সংগঠনকে এই প্রস্তাব আদায়ে সংগঠিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। কিন্তু বণিক-মালিক শ্রেণির কোনও ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদী ও প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে থাকে। এ সময় 'অ্যালার্ম' নামের একটি পত্রিকায় 'একজন শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘণ্টাই করুক- সে দাস বলেই বিবেচিত' এ রকম বিষয়বস্তুর একটি কলাম ছাপা হওয়ার পর জ্বলন্ত আগুনে যেন ঘি পড়ে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলগুলোও যোগ দেয়। ১ মে'কে ঘিরে আয়োজিত হতে থাকে বিভিন্ন প্রতিরোধ আর প্রতিবাদ সভা। কিন্তু মালিক-বণিক শ্রেণি অবধারিতভাবে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। ১ মে দিনটির মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পুলিশ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র ও জনবল সংগ্রহে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি ধর্মঘট আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য শিকাগোর বাণিজ্যিক ক্লাব 'ইলিনয়' প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ভারী মেশিনগান কেনার অর্থ দেয়। এতসব বাধার মুখেও ১৮৮৬ সালের ১ মে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে এদিন রাস্তায় নেমে আসে। শিকাগোতে আগে থেকেই শ্রমিক ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। জ্বালাময়ী বক্তৃতা, মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি - সব কিছু মিলে ১ মে উত্তাল হয়ে ওঠে। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পিজ, লুই লিং সহ অনেকেই শ্রমিকদের মাঝে এই আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। আন্দোলনে বাড়তে শুরু করে শ্রমিকদের সংখ্যা। পরবর্তীতে ৪ মে আন্দোলন চলাকালে সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর 'হে' মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশে জড়ো হয়। মিছিল শুরুর আগে শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পিজ জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। এ সময় হঠাৎ করেই দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এই হামলায় এক পুলিশ সহ ৬ জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়। বোমা বিস্ফোরণের পরপরই পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে, যা সঙ্গে সঙ্গেই সংঘর্ষের রূপ নেয়। এই সংঘর্ষে প্রাণ হারান ১১ জন শ্রমিক। এদিকে পুলিশ হত্যা মামলায় শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পিজ সহ ৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলার প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে স্পিজ সহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।  স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেলস, পারসনসকে ফাঁসির দঁড়িতে ঝোলানো হল। ল্যুই লিঙগ আত্মহত্যা করেন আগের রাতে। মাইকেল সোয়াবকে ১০ই নভেম্বরই ফাঁসি দেওয়া হয় এবং নীবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত ৮ জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তবে অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় আর কখনোই প্রকাশ পায়নি। এভাবেই শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের 'দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি' যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং পয়লা মে বা মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(তথ্য সংকলন: প্রদোষকুমার বাগচী)

Comments :0

Login to leave a comment