শিবানন্দ পাল
হিমালয়ের সৌন্দর্য এতোই মুগ্ধ করে, যে আমরা ভুলে যাই— জার্মান আবহাওয়াবিদ, ভূ-পদার্থবিদ এবং মেরু বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগন্যারের তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে ভূত্বকীয় পাতের নড়াচড়ায় ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান পাত ও ইউরিয়েশিয়ান পাতের সংঘর্ষের ফলে হিমালয়ের জন্ম হয়েছে। যে হিমালয় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে মধ্য এশিয়ার প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ থেকে রক্ষা করে নাতিশীতোষ্ণ আবহ নিয়ন্ত্রণ করে।
সংস্কৃত ভাষায় হিমালয় অর্থ "বরফের আবাস"। তিব্বত মালভূমির দক্ষিণ প্রান্তে উত্তল চেহারা নিয়ে, প্রায় ২৪০০ কিমি দীর্ঘ এবং ২৫০-৩০০ কিমি প্রস্থ বিশিষ্ট এই পর্বতমালা। সবচেয়ে উঁচু এবং এখনও ক্রমবর্ধমান এই পর্বতমালায় বিশ্বের ১০টি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে ন'টির অবস্থান, যার মধ্যে রয়েছে ৬ কোটি বছরের পুরানো সবচেয়ে উঁচু-শৃঙ্গ এভারেস্ট। এই পর্বতমালা থেকে বড় বড় কয়েকটি নদীর উৎপত্তি, যার মিষ্টি জল ব্যবহার করে উপকৃত হয় বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ। নদী বাহিত পলিতে হাজার হাজার বছর ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে উপমহাদেশের কৃষ্টি এবং সভ্যতা। এই হিমালয়কে যখন দেখি, তখন তার শিকড়ের গভীরে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কথা মাথায় আসে না, সেই রহস্য আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু সেই অনাবৃত অধ্যায় বিজ্ঞানীরা এবার প্রকাশ্যে আনতে চলেছেন।
ভূতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধান বলছে ভারতীয় উপমহাদেশে তিব্বতীয় ভূখণ্ড দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে। ১২ জানুয়ারি, ২০২৫ দি ব্রাইটার সাইড অব নিউজ পোর্টালের প্রতিবেদন সেরকম তথ্যই প্রকাশ করেছে। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন কনফারেন্সে হিমালয়ের গঠন এবং চরিত্র সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, হিমালয়ের তলদেশে ভারতীয় প্লেট দুটি ভাগে বিভক্ত হতে চলেছে।
হিমালয় অঞ্চলে প্রায়শই ভূমিকম্পের জন্য দায়ী ভারতীয় প্লেটের একটি বিশাল অংশ গরম ম্যান্টেল শিলার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। নিউজ পোর্টালের মহাকাশ, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত সংবাদ লেখক জোসেফ শাবিত ছবি এঁকে বোঝাতে চেয়েছেন, ভারতীয় প্লেটের একটি অংশ "ডিলামিনেটিং" হচ্ছে এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে চাপা পড়ছে। ডিলামিনেশন বলতে কোনও উপাদানের স্তর ভেঙে যাওয়া বোঝায়। ৮ অক্টোবর, ২০২৪ জোসেফ শাবিত লিখেছিলেন, হিমালয় দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় এবং ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে ধীর গতির ভূতাত্ত্বিক সংঘর্ষের মঞ্চ। প্লেটগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর ধরে একটি ধীর গতির রহস্যময় ভূতাত্ত্বিক সংঘর্ষ চলছে। জানুয়ারি ২০২৪, এক বছর আগেও তিনি এই সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন কনফারেন্সে ভূতাত্ত্বিকেরা প্রথম এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। লিন লিউ, ড্যানিয়ান শি এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো সাইমন এল ক্লেম্পেরার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা তিব্বতের পাহাড়ি ঝরনায় দীর্ঘদিন ধরে হিলিয়াম অনুসন্ধানের কাজ করছেন। তাঁরা ভারতীয় প্লেট বিশ্লেষণ করতে ৩ডি এস-ওয়েভ রিসিভার-ফাংশন প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তাঁদের ধার অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি প্রাচীন পৃথিবীর সংগঠন সম্পর্কেও কিছু তথ্য দিতে পারে।
বিজ্ঞানী ক্লেম্পেরারের গবেষণার প্রধান বিষয় তিব্বতের মালভূমি এবং হিমালয়। হিমালয় অঞ্চলের ভূ-সংগঠনের লিথোস্ফিয়ারিক কাঠামো এবং টেকটোনিক্স বিষয়ে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে ধীর গতির ভূতাত্ত্বিক সংঘর্ষের পরিণতি হিমালয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সোসাইটির মতে ভারতীয় প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের শুরু এবং হিমালয় পর্বতমালা ও তিব্বত মালভূমির গঠন ৫০ মিলিয়ন বছর আগে এবং সেই সংঘর্ষ আজও চলছে।
বিজ্ঞানীদের কথা ভূপৃষ্ঠের উপরে মহাসাগরীয় প্লেটগুলির তুলনায়, মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটগুলি পুরু এবং প্রাণবন্ত, যার ফলে সংঘর্ষের সময় পৃথিবীর আবরণে ধ্বংসলীলা চলে। ইউরেশিয়ার সাথে ভারতীয় প্লেটের চলমান আচরণ নিয়ে বর্তমান অনুসন্ধান বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে চেয়েছেন, তিব্বতের নিচে অনুভূমিকভাবে প্লেটের স্লাইডিং সাবডাকশন প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। সাবডাকশন এমন একটি ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যার ফলে ভারী প্লেট তুলনায় অন্য প্লেটের নিচে ডুবে যায় এবং ম্যান্টলে প্রবেশ করে। ম্যান্টল হলো পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে অবস্থিত একটি বিশেষ স্তর। যেখানে প্লেট টেকটোনিক্সের জন্য তাপ ও যান্ত্রিক শক্তির উৎপত্তি হয়। টেকটোনিক্স হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে পৃথিবীর ভূত্বকের গঠন, বৈশিষ্ট্যের বিবর্তন ঘটে, ক্রমপরিবর্তন হয়। যেখানে এই প্রক্রিয়া ঘটে, সেই জায়গাকে সাবডাকশন জোন বলা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে তিব্বতের এলাকাটি সম্পূর্ণভাবে সাবডাকশন জোন, ভূমিকম্পের উপযুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
আরেকটি ধারণা হলো ভারতীয় প্লেটের উপরের প্রাণবন্ত অংশ সংঘর্ষের প্রান্তে ভেঙে গিয়ে নিচের অংশটি ম্যান্টেলের মধ্যে প্রবেশ করছে। দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে উদ্ভূত সাবডাকশন প্রক্রিয়ায় ভারী প্লেটটি অন্য প্লেটের নিচে ম্যান্টলে চলে যাচ্ছে। যেখানে প্রক্রিয়াটি ঘটছে, সেই সাবডাকশন জোনে মহাসাগরীয় প্লেট ম্যান্টলে সম্পূর্ণরূপে ডুবে যাওয়ার প্রভাব সমুদ্র অববাহিকার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। বর্তমান সমীক্ষায় বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট করে বলেছেন, তিব্বতের তলদেশে ভূমিকম্পের একটি তরঙ্গ ঘোরাফেরা করার ফলে উদ্ভূত গ্যাসের উপস্থিতি অতীতের অনাবিষ্কৃত কিছু ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতেও পারে। তাঁদের ধারণা ভারতীয় প্লেটের একটি অংশ এই জায়গায় "ডিলামিনেটিং" হওয়ার কারণে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে স্লাইড করে উপরের অংশ সরে গেছে। ফলে প্লেটের বিচ্ছিন্ন অংশ, অবিচ্ছিন্ন প্রতিবেশীর সীমানায় উল্লম্ব ফাটলের সৃষ্টি করেছে— এটাই গভীর বিপদের কারণ।
নেদারল্যান্ডের উট্রেখ্ট ইউনিভার্সিটির প্রাচীন ভূতত্ত্বের ভূ-গতিবিদ্যা বিশারদ ডুয়ে ভ্যান হিন্সবার্গেনের মন্তব্য, "আমরা জানতাম না মহাদেশগুলো এরকম আচরণ করতে পারে। বিষয়টি পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জটিল এবং মৌলিক।" বিজ্ঞানীদের কাছে পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার ধারণাটি দীর্ঘস্থায়ী অনুমান। প্লেটগুলো এক একটি বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট কাঠামো নিয়ে গঠিত। ভূত্বকের গভীরে প্রাণোচ্ছল ম্যান্টেলের শিলা ঘন। ঘন শিলা যখন সঙ্কুচিত হয় বা আরও ঘনীভূত হবার অবস্থায় আসে, তখন একটি আরেকটি স্তরের উপরে চড়াও হয়ে পাশাপাশি স্তরগুলোর সঙ্গে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বর্তমান সমীক্ষা প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীদের পূর্বেকার সমস্ত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আগে বিষয়টি মহাদেশীয় প্লেটের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে দেখা হতো, সেভাবেই কম্পিউটারের মডেলগুলোর ছবি আঁকা হয়েছিল। হিমালয়ের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটের ছিঁড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা হিমালয়ের ২৫০০ কিলোমিটারব্যাপী দীর্ঘ অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতির একটি ক্ষেত্রের অস্তিত্ব পেয়েছেন। যেখানে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আগে এবং পরে ভারতীয় প্লেটের অবস্থানের তারতম্য চিত্রিত হয়েছে। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ পিটার ডিসেলস, ভূত্বকের প্রাচীন প্লেটটিকে একটি দৈত্যকায় মান্তা রশ্মির সাথে তুলনা করেছেন। মান্তা রশ্মি একটি সামুদ্রিক প্রাণী। যার চেহারা চ্যাপ্টা ধরনের, চওড়া মাংসল বিশাল ডানার মতো পাখনা আছে। সামুদ্রিক প্রাণী মান্তা রশ্মির সঙ্গে তুলনা করে পিটার ডিসেলস বলেছেন, ভূত্বকের গভীরে মহাদেশীয় প্লেটের কেন্দ্রীয় অংশে সাগরীয় ভূত্বকের পাতলা ডানা সহজেই ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে মহাদেশীয় ভূত্বকে প্রচণ্ড শক্তির সাথে সমগ্র ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া- ঘটনায় হিমালয় পর্বতের উদয়। সাবডাকশন গতির এই বৈষম্য ভারতীয় প্লেটকে একাধিক দিকনির্দেশক চাপের শিকার করছে যা অসংখ্য ভূমিকম্পের কারণ।
১৯৫০ থেকে এ পর্যন্ত হিমালয় অঞ্চলে ৬ কম্পাঙ্কের বেশি তীব্রতার ভূমিকম্পের নজির রয়েছে অন্তত ২১ বার। সর্বশেষ ঘটনা ৭ জানুয়ারি ২০২৫। হিমালয় অঞ্চলে এসব ভূকম্পনের ঘটনায় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই মতটি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হওয়ায় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভূ-পদার্থবিজ্ঞানী সাইমন এল ক্লেম্পেরার একে "কুটির শিল্প" বলে বর্ণনা করেছেন। ক্লেম্পেরার মতে উত্তর-পূর্ব ভারতে ভুটানের কাছাকাছি একটি জায়গা বারবার অশান্ত হয়ে ওঠে, কারণ সেখানে সাবডাকশন জোনটি বেঁকে গিয়েছে। ওই জায়গাই হিমালয়ে ভূমিকম্পের প্রধান উৎসস্থল।
ক্লেম্পেরার গবেষণার মধ্যে তিব্বতি ঝরনা থেকে হিলিয়ামের আইসোটোপ সংগ্রহের বিষয়টিও আছে। বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন নিষ্ক্রিয় হিলিয়াম গ্যাস হাইড্রোজেনের চেয়েও হালকা। মৌলিক পদার্থ হিসাবে এটি একমাত্র গ্যাসীয় অবস্থায় পাওয়া যায়। তিব্বতের ঝরনাগুলিতে হিলিয়ামের ব্যাপক উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এছাড়াও হিলিয়াম পৃথিবীর জন্মের সময়ের আদিম পরিচয় বহন করে। হিলিয়াম আইসোটোপ, ম্যান্টেল শিলার উপস্থিতি নির্দেশ করে, আবার ভূগর্ভস্থ গ্যাসের নির্গমনের সূচনা দেয়।
ইউরেশিয়ার সাথে ভারতীয় প্লেটের সংঘর্ষের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা দুটি প্রধান অনুমান নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা ঝর্নাগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করে একটি ম্যাপ অঙ্কন করে দেখতে পেয়েছেন- ম্যাপের আকারে অদ্ভুত আকর্ষণীয় একটি প্যাটার্ন তৈরি হয়। একটি নির্দিষ্ট রেখার দক্ষিণে, ঝর্নাগুলো আঙুলের মতো ক্রিস্টাল চেহারা তৈরি করে। রেখাটিকে তাঁরা তিব্বতের নিচে ভারতীয় প্লেটের দূরতম বিন্দু হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ভুটানের পূর্ব সীমান্তের কাছে এই রেখার দক্ষিণে একসাথে তিনটি ঝর্না ম্যান্টেলের যে বিশেষ চেহারা তৈরি করেছে, বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি একটি সম্ভাবনাময় ইঙ্গিত যা ভারতীয় প্লেটের বিচ্ছিন্ন অংশের ফাঁকটি গরম ম্যান্টেল শিলা দ্বারা পূরণ করতেও পারে।
ভূত্বক এবং ম্যান্টেল শিলার মধ্যেকার সীমানা অতিক্রমকারী ভূমিকম্প তরঙ্গের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা এইসব অনুমানের সমর্থন পেয়েছেন। অসংখ্য সিসমিক স্টেশনে যেখানে পৃথিবী পৃষ্ঠের বা ভূগর্ভস্থ কম্পনের তীব্রতা মাপা হয়— সেই তরঙ্গ রেকর্ড করে, গবেষকরা ভূপৃষ্ঠের কাঠামোর একটি ছবি তৈরি করেছেন। একটি চিত্রে দুটি স্বতন্ত্র ব্লকের প্রকাশ হওয়ায় বিজ্ঞানীদের অনুমান ভারতীয় প্লেটের নিচের অংশটি উপরের অংশ থেকে এই জায়গায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর একটি চিত্রে বিজ্ঞানীরা বিচ্ছিন্ন স্ল্যাবের পশ্চিম প্রান্তে একটি শূন্য প্রকোষ্ঠের অবস্থান দেখতে পেয়েছেন, যার শেষে ভারতীয় প্লেটের তলদেশ প্রায় ২০০ কিলোমিটার গভীরে অক্ষত বলে অনুমান এবং মনে করা হচ্ছে এখানে পূর্বের তুলনায় ম্যান্টেল শিলা প্রায় ১০০ কিলোমিটার গভীরে প্রবেশ করেছে।
লেহাই ইউনিভার্সিটির সিসমোলজিস্ট অ্যান মেল্টজার, এই ধরনের মহাদেশীয় সংঘর্ষের বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, অতীতে পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশের আয়তন এই ধরনের ঘটনায় আকৃতি পেয়েছে। এই পরীক্ষা আমাদের অতীতের বিকৃতিগুলোর ঠিকুজিকুলজির দিকনির্দেশে সহায়তা করতে পারে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি পুরানো প্রবাদ, এশিয়া বিশ্বের সমস্ত মহাদেশগুলোর জননী। বিজ্ঞানীরা বলেন প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আরব, মাদাগাস্কার, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ নিয়ে গন্ডোয়ানা ভূমি সম্পূর্ণরূপে একত্রিত ছিল। ভারত ছিল সুপারমহাদেশ গন্ডোয়ানার অংশ। জুরাসিক যুগে প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর আগে গন্ডোয়ানা ভেঙে যায় এবং ১২০ মিলিয়ন বছর আগে ভারত গন্ডোয়ানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তর আমেরিকা আর ইউরেশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে অন্য একটি সুপার মহাদেশ গঠন করে। ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ৫ সেন্টিমিটার ধীরে ধীরে সরছে, আর ইউরেশিয়ান প্লেট সরছে বছরে দুই সেমি করে। সেও উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ৮০ মিলিয়ন বছর আগে হঠাৎ তিনগুণ গতিতে ভারতীয় প্লেট সরতে শুরু করেছিল। ইউরেশিয়ান প্লেট ছিল ছ'হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে- ভারত ৩০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে ইউরেশিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিল এই দূরত্ব অতিক্রম করে। ৫০ মিলিয়ন বছর আগে, ভারত এবং ইউরেশিয়ার ভূখণ্ডের সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালার জন্ম। এসব ঘটনা নতুন করে বিজ্ঞানীদের পর্যালোচনা করতে হচ্ছে। কারণ, ৮০ মিলিয়ন বছর আগে ভারতের সেই আকস্মিক গতি বৃদ্ধির কোনও ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে পাননি।
বিজ্ঞানীদের বড় অংশ মনে করেন, সুদূর অতীতে মহাদেশীয় সংঘর্ষগুলো পৃথিবী পৃষ্ঠে এমন কিছু চিহ্ন রেখেছে, যেগুলো এতোদিন বিজ্ঞানীদের কাছে চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। পৃথিবীর বিলিয়ন বছরের পুরানো ইতিহাসের সেই চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোর কারণ খুঁজে পাওয়ার সুযোগ এবার এসেছে। বিলিয়ন একটি অতি বড় সংখ্যা, যার ১ এর পরে ৯ টি শূন্য থাকে। ক্লেম্পেরারের মতো বিজ্ঞানীরা সবাই ভীষণ উৎসাহী। তাঁরা মনে করছেন নতুন এই আবিষ্কারের ফলে সুদূর অতীতের পৃথিবীর আকৃতিগত পরিবর্তনগুলো ঠিক কিভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সেই সব জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর এবার সঠিকভাবে পাওয়া যাবে।
earthquake
হিমালয়ের তলদেশে নড়াচড়া চলছে

×
Comments :0