শমীক লাহিড়ী
টমাস ফ্রীডম্যানের সাড়া জাগানো বই 'দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট' (২০০৫) অনুযায়ী, ‘বিশ্ব এখন সমতল’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বার্লিন প্রাচীরের পতনের মতো ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মূল স্রোতে যুক্ত হয়েছে। তাঁর মতে, বিশ্ব এখন একটি সমান প্রতিযোগিতার ময়দান। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় উন্নয়নশীল দেশগুলির সামনে এক বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে। এই ব্যবস্থায়, হয় নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে, নতুবা পিছিয়ে পড়তে হবে। এই সমতল পৃথিবীতে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি হবে সকলের জন্য। এককথায়, একমেরুর বিশ্বই আলো ঝলমল এক নতুন সকাল আনবে নতুন এই বিশ্ব ব্যবস্থায়।
সমতল পৃথিবীতে কী হলো?
এরপর কেটে গেছে সাড়ে তিন দশক, বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ। একমেরুর আলোয় আলোকিত পৃথিবীতে মার্কিন-ন্যাটো জোটের বোমায় ঝলসে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলো – ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া সহ অনেক দেশ। একমেরুর বিশ্বের ঝাপটায় প্যালেস্তাইন দেখেছে ৬৪ হাজার লাশের গণকবর গত দু’বছরেই।
সমাজতন্ত্রের পতনের পর সৃষ্ট একমেরুর বিশ্বে, আফ্রিকা মহাদেশের বহু দেশ আভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত ও গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত হচ্ছে। ২০২৫ সালেও কয়েকটি দেশে গুরুতর সংঘাত চলছে। সুদানে সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর মধ্যে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাপক আকারের গৃহযুদ্ধ চলছে, যা বর্তমানে মহাদেশের অন্যতম ভয়াবহ সংঘাত। কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে কিভু অঞ্চলে এম-২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠী সহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যকলাপের কারণে দীর্ঘদিন ধরে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। সোমালিয়ায় সরকার এবং জঙ্গি গোষ্ঠী আল-শাবাব-এর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সংঘাত চলছে।
পশ্চিম আফ্রিকার মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশগুলিতে জিহাদি গোষ্ঠীগুলির (আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকারগুলির বড় আকারের সামরিক অভিযান চলছে, যা প্রায় গৃহযুদ্ধ। ইথিওপিয়ার তিগ্রে ছাড়াও আমহারা, ওরোমিয়া সহ বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক বিদ্রোহীরা সক্রিয়। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রেও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সরকারি বাহিনীর মধ্যে মাঝেমাঝেই বড় সংঘাত দেখা যায়। দক্ষিণ সুদানে এখনও উপজাতীয় সংঘাত এবং স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ব্যাপক হিংসা চলছে।
আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ঘেঁষা নাজিবুল্লাহর সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল ১৯৯২ সালে প্রত্যক্ষ মার্কিনী সেনার মদতে। কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী তালিবানদের হাতে ১৯৯৬ সালে মার্কিনী সরকারই ওই দেশটি পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়। আবার মার্কিন সরকারের পেটোয়া দুই সরকারকে ২০ বছর ক্ষমতায় রেখে, আবার সেই তালিবানদের হাতেই দেশকে তুলে দিয়েছে তারা। এই হলো একমেরুর সমতল পৃথিবী’র আলোয় ঝলমল করা আফগানিস্তানকে মৌলবাদী অন্ধকারের নিমজ্জিত করার তিন দশকের ইতিহাস।
পূর্ব ইউরোপের অভিজ্ঞতা
বার্লিন প্রাচীরের পতনের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের চেহারাটা কী? ১৯৯০ সালের পর গৃহযুদ্ধে ভাঙে সমাজতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় যুগোস্লাভিয়া। ১৯৯১-২০০১ সালে মারাত্মক জাতিগত সংঘাতের ফলে ছয়টি দেশে বিভক্ত হয়ে যায় – স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া ও হার্জেগোভিনা। এই দেশটিতেই সবচেয়ে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। যুগোস্লাভ রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ছিল ১,৩০,০০০ থেকে ১,৪০,০০০। বসনিয়ান যুদ্ধে (Bosnian War) মৃতের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১,০০,০০০ জনেরও বেশি। এই নিহতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ছিল বসনিয়াক মুসলিম সাধারণ নাগরিক।
১৯৯৫ সালে স্রেব্রেনিৎসায় ৮,০০০ এরও বেশি বসনিয়াক পুরুষ ও কিশোরকে হত্যা করা হয়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়াও ক্রোয়েশিয়ান ‘স্বাধীনতা’ যুদ্ধে (১৯৯১-১৯৯৫) প্রায় ২০,০০০ মানুষ নিহত হয়। কসোভোর গৃহযুদ্ধে (১৯৯৮-১৯৯৯) ১৩,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হয়। পরে সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে কসোভো আংশিকভাবে স্বীকৃত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হয়, যদিও সার্বিয়া এটিকে এখনো নিজেদের অংশ বলে দাবি করে।
গৃহযুদ্ধ ছাড়াও কিছু দেশ ভেঙে গিয়েছিল, যেমন চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে হলো চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রে ভেঙে গেল।
এই ছিল ‘একমেরুর সমতল পৃথিবী’ তৈরি হওয়ার পর পূর্ব ইউরোপের মানুষের পরিণতি।
ইতিহাসের সমাপ্তি
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার 'দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান' আরেকটি সাড়া জাগানো বই। এর মূল বক্তব্য হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর মানব ইতিহাসের আদর্শগত বিবর্তন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। উদার গণতন্ত্র এখন সরকার পরিচালনার চূড়ান্ত এবং সেরা ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী জয়লাভ করেছে। রাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ এবং বিশেষ করে সাম্যবাদ-এর মতো অন্যান্য আদর্শ ব্যর্থ হওয়ায়, উদার গণতন্ত্রই একমাত্র ব্যবস্থা যা মানুষের মৌলিক চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম।
এই সেরা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৃথিবী কেমন সেরা হয়েছে দেখা যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলিতে ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে আয়ের বৈষম্য তীব্রভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী পরিবার দেশের মোট সম্পদের (Net Worth) প্রায় ৩০ শতাংশের মালিক, যা ১৯৯০ সালে ছিল ২২.৮ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন দেশের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ পরিবারের হাতে।
২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোজোনের (ইউরো মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশগুলি) শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী পরিবার মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশের মালিক। অন্যদিকে, জনসংখ্যার নিম্ন ৫০ শতাংশের হাতে ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। বৃহত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সম্পদের বৈষম্য অনেক বেশি। ২০২০ সালে ইউরোপের ধনীতম ১ শতাংশ মানুষ ছিল মোট সম্পদের প্রায় ১৯ শতাংশের মালিক। তবে, কিছু দেশে এই শতাংশ অনেক বেশি, যেমন রাশিয়ায় দেশের মোট সম্পদের ৫৬.৪ শতাংশ (ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ), তুরস্কে প্রায় ৩৯.৫ শতাংশ। চেক প্রজাতন্ত্রে প্রায় ৩৭.৮ শতাংশ, সুইডেনে প্রায় ৩৫.৮ শতাংশ সম্পদের মালিকানা গেছে অতি ধনীদের হাতে।
(তথ্যসূত্রঃ ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং SUERF দ্বারা প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন। ‘New insights into inequality and wealth in the euro area’-এর গবেষণাপত্র, ডিস্ট্রিবিউশন অফ নেট ওয়েলথ। এই রিপোর্টগুলি সাধারণত ইউরোজোনের দেশগুলোর ২০২০ সালের তথ্য এবং Credit Suisse-এর গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট, Landgeist রিপোর্ট।)
ভারতের অবস্থা কী?
১৯৯০-এর দশকের পর ভারতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে ভারত সরকার অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করেছিল, যা দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করলেও সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে ক্রমবর্দ্ধমান আয় শীর্ষ ১% ব্যক্তির ২০২২-২৩ সালে জাতীয় আয়ের ২২.৬%-এ পৌঁছে যায়, যা ১৯২২ সালে তথ্য সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ এবং ঔপনিবেশিক আমলের রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেছে। একইভাবে, শীর্ষ ১% ব্যক্তির হাতে ২০২২-২৩ সালে দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪০.১% কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ১৯৯১ সালে ভারতে বিলিয়নিয়ার (১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি) ছিলেন মাত্র ১ জন, যা দ্রুত বেড়ে ২০২২ সালে ১৬২ হয়েছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার নিচের দিকের ৫০% মানুষের আয়ের অংশ ক্রমশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি পরিচালিত গবেষণা কেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান (জাতীয় আয়, ট্যাক্স রেকর্ড এবং জরিপ) এবং সেগুলিকে একত্রিত করে আয়-ভিত্তিক গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট গণনা করেছে। এই তথ্যগুলি ধনীদের হাতে আয়ের চরম কেন্দ্রীকরণকে বর্ণনা করে বৈষম্যের তীব্র বৃদ্ধি দেখিয়েছে। ১৯৯০ সালে দেশে আয়-ভিত্তিক গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট ছিল ০.৪৫/৪৫%, যা ২০২৩ সালে চূড়ান্ত বৃদ্ধির ফলে হয়েছে ০.৬১/৬১%। আয়-ভিত্তিক গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে ১৯৯০ সালের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে ভারতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। গিনি কোয়েফিসিয়েন্টের এই উচ্চ মান ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৈষম্যপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে স্থান দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, আয়-ভিত্তিক গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট হলো আয়ের বৈষম্য পরিমাপের একটি পরিসংখ্যানগত মানদণ্ড। এটি দেখায় যে একটি দেশ বা গোষ্ঠীর মোট আয় তার নাগরিকদের মধ্যে কতটা সমানভাবে বা বৈষম্যপূর্ণভাবে বণ্টিত হয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট ‘সমতল একমেরুর উদার গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের দারিদ্র আর ধনীর সম্পদ বাড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ লাগিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইচ্ছেমতো বোমা মেরে দেশ ধ্বংস করা হয়েছে। এরা আগামী পৃথিবীকে আরও নিঃস্ব করবে, এই বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না।
বিকল্প মেরু গঠন
এই অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে অন্য আর এক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তলার উদ্যোগ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
ব্রিকস প্লাস এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন উভয়ই বিশ্ব মঞ্চে বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে দ্রুত পরিবর্তিত এই পৃথিবীতে। এই উদ্যোগ মার্কিন-ন্যাটো পরিচালিত একমেরুর বিশ্ব ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে গড়ে উঠেছে যা বিভিন্ন আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করছে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস মূলত একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট। এদের দেখে উৎসাহিত হয়ে উন্নয়নশীল বহু দেশ নতুন করে এই জোটে সামিল হচ্ছে। ফলে তৈরি হয়েছে ব্রিকস প্লাস। ব্রিকসের মূল সদস্য দেশগুলির সাথে আরও কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ যেমন, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ইত্যাদিরা সামিল হয়েছে এই উদ্যোগে।
নতুন সদস্য দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে ব্রিকস বিশ্বের বৃহত্তম কয়েকটি অর্থনীতিকে একত্রিত করেছে। এই বিশাল অর্থনৈতিক ব্লক জি-৭-এর অর্থনৈতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম, যার সদস্য দেশ কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
এদের সম্মিলিত নমিনাল জিডিপি-এর (২০২৫ সালের পূর্বাভাস) পরিমাণ প্রায় ৫১.১৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের মোট জিডিপি-এর প্রায় ৪৪-৪৫ শতাংশ। আর পিপিপি জিডিপি (Purchasing Power Parity GDP) প্রায় ৪৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ২৮-২৯ শতাংশ।
অপরদিকে, ব্রিকস প্লাস-এর অন্তর্ভুক্ত ১০টি সদস্যভুক্ত দেশের নমিনাল জিডিপি (Nominal GDP) প্রায় ২৭-২৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ২৩-২৫ শতাংশ। আর পিপিপি জিডিপি-এর পরিমাণ প্রায় ৪৫-৫০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ৪০-৪১ শতাংশ। ব্রিকস প্লাস দেশগুলির পিপিপি জিডিপি বর্তমানে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির থেকে বেশি। এটা বিশ্বের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র গ্লোবাল সাউথের দিকে স্থানান্তরিত হওয়ার ইঙ্গিত। এই জোটের সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের অর্ধেকের বেশি হওয়ায় পিপিপি-এর পরিমাপে তাদের অর্থনৈতিক শক্তি অনেক বেশি।
প্রসঙ্গত, নমিনাল জিডিপি হলো সবচেয়ে সরল পরিমাপ। এটি একটি দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উৎপাদিত সকল পণ্য ও পরিসেবার মোট আর্থিক মূল্য, যা গণনা করা হয় দেশের বর্তমান বাজার মূল্যে। আর, পিপিপি জিডিপি হলো, যদি একটি দেশ তার সমস্ত পণ্য ও সেবা যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে, তবে তার মোট আর্থিক মূল্য কত হবে, তার পরিসংখ্যান। উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে জীবনধারণের ব্যয় কম হওয়ায়, তাদের নমিনাল জিডিপি এর তুলনায় পিপিপি জিডিপি অনেক বেশি হয়।
বিকল্প আর্থিক কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (NDB) তৈরি এবং সদস্য দেশগুলির মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য ও লেনদেন বৃদ্ধির মাধ্যমে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে এই দেশগুলি। এটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার বহুমুখীকরণকে ত্বরান্বিত করবে। মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা (South-South Cooperation) বাড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়েই এগচ্ছে এরা। ব্রিকস প্লাস উন্নত বিশ্বের চাপ ছাড়াই উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থে কণ্ঠস্বর তুলে ধরার এক বিরাট সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। এই দেশগুলি আন্তর্জাতিক মঞ্চ, যেমন রাষ্ট্রসঙ্ঘে নিজেদের মধ্যে নীতিগত সমন্বয় করে কোনও একক রাষ্ট্রের এজেন্ডা বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে ঠেকাতে পারবে আগামী দিনে।
সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) হলো মূলত মধ্য এশিয়া এবং এর আশেপাশের দেশগুলির একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা, যার মূল লক্ষ্য নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা। এসসিও সদস্য দেশগুলির মধ্যে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা করার উদ্যোগ নেওয়ায় এই অঞ্চলে পশ্চিমী শক্তির সামরিক বা নিরাপত্তা হস্তক্ষেপের সুযোগকে কমাবে নিঃসন্দেহে।
এশিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্লক, যা রাশিয়া, চীন, ভারত এবং পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলিকে এক ছাতার নিচে আসার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি ইউরেশীয় মহাদেশে একটি স্বতন্ত্র ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি করতে পারে, যা ইউরোপ-কেন্দ্রিক বা উত্তর আমেরিকা-কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বাইরে। এসসিও সদস্য দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সংযোগ বাড়াতে বিশেষত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রকল্প এই অঞ্চলের অর্থনীতিগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। এসসিও একটি মঞ্চ হিসেবেও কাজ করতে পারে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি (যেমন ভারত ও পাকিস্তান) নিয়মিতভাবে আলোচনা ও সমন্বয়ের সুযোগ পাবে, ফলে মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
ব্রিকস প্লাস এবং এসসিও একত্রে বহুমুখী বিশ্ব গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে। এই দুই জোটের সহযোগিতা বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলির সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। এদের সম্মিলিত পদক্ষেপ পশ্চিমী দেশগুলির উপর নির্ভরতা কমিয়ে সার্বভৌমত্ব এবং স্বায়ত্তশাসিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগকে প্রসারিত করতে পারে।
এই দুই জোট গঠনের ফলে বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কেবল ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলস-এ সীমাবদ্ধ না থেকে দিল্লি, বেইজিং এবং মস্কোর মতো অন্যান্য কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হবে আগামী বিশ্বে।
Comments :0