আকাশ বিশ্বাস
১
সে-দিনটা ছিল আটষট্টি সাল। বিদেশ থেকে ফিরে শঙ্খ ঘোষ পুজোর ক’দিনের জন্য গেছেন জলপাইগুড়ি।
সে-দিনটাও ছিল লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন। আবহাওয়া ভালো নয়, সারাদিন বৃষ্টি, গমকে গমকে বাতাস। বেশ রাতের দিকে শব্দ তুলে ভেঙে পড়ল একটা গাছ। রান্নার ঠাকুর বলে উঠলেন: এ একেবারে বানডাক। শঙ্খ ঘোষের মনে হ’লো, ঘুম হবে ভালো। কিন্তু রাত তিনটের দিকে সোরগোলে ভেঙে গেল ঘুম। জল ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। সবাই মিলে উঠতে হলো দোতলায়। চল্লিশ জন মানুষ আর একটা গোরু।
অবশেষে জল ওঠা থামল দোতলা থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে। কিন্তু যাদের দোতলা বাড়ি নেই, কীভাবে থাকল তারা? সন্ধ্যায় সবাই বেতার যন্ত্রটি ধরে থাকেন কানে। সাহায্যের কোনও খবর এসে পৌঁছবে নিশ্চয়ই! সময় মেনেই স্থানীয় সংবাদও শুরু হয় আকাশবাণীর। কিন্তু না, উদ্ধারের খবর আসে না কোনও।
আরও একটা দিন কাটিয়ে ঘর থেকে বেরোবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় কোনোরকমে। ঘরের মধ্যে একহাঁটু পলিমাটি। বাইরে করলার ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার দুঃসংবাদ। এখানে-ওখানে মৃত শরীর— পশুর, মানুষেরও। শুনতে পাওয়া যায়— এক লহমায় মিলিয়ে গেছে হাজার হাজার লোক।
আরও জানা যায়, সতর্কবার্তা নাকি আগে থেকেই ছিল! সন্ধের মধ্যেই নাকি জানা গিয়েছিল এই বিপর্যয়ের সম্ভাবনা! মানুষকে নাকি সেটা ইচ্ছে করেই জানানো হয়নি, কেবল ত্রাস ছড়ানোর ভয়ে।
দিন পনেরো পর শঙ্খ ঘোষ ফেরত আসেন কলকাতায়। সে দিনটাও আবার ছিল লক্ষ্মীপুজোর দিন। দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো আর দেওয়ালি। যেমন হয় প্রতিবছর। কলকাতা শহর উৎসবে আর আলোর গমকে উথালপাথাল। বৌবাজারের পথে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার আকাশে ফুলঝুরির মস্ত বাহার দেখতে একাকী কবির চেতনায় ভেসে উঠছিল সদ্য দেখে আসা শকুনে-খাওয়া এক মৃত মহিষের শরীর।
প্রশ্ন জাগছিল— দেশের এ-প্রান্তের সঙ্গে ও-প্রান্তের কি ন্যূনতম মর্মের যোগ আছে কোনও? কুরে কুরে খাচ্ছিল অসহায় আত্মজিজ্ঞাসা— কীভাবে তবে বাঁচব আমরা? কোথায় আমাদের ভুল? তাঁকে চিরে দিচ্ছিল একটা শাঁখের করাত; একদিকে উৎসবোন্মত্ত এক শহরের আনন্দবিলাস আর একদিকে তিস্তার ভাঙা বাঁধের বীভৎস প্রেতচ্ছবি। কবে তবে এমন করে ভেঙে গেল আমাদের বাঁধ! নড়ে গেল আমাদের সংস্কৃতি, পুরাণ, অভিজ্ঞতার সমস্ত যুগসঞ্চিত সেতু? প্রতিরোধ নেই কোথাও? এতোই আমাদের অসহায়তা? এই আত্মদংশন তাঁকে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল আরুণি উদ্দালকের গল্প। যে নিজের শরীরকে বিছিয়ে দিয়েছিল বিক্ষুব্ধ জলরাশির খরস্রোতে। গুরুবাক্য রক্ষা করতে নিজের শরীরকেই করে তুলেছিল সঙ্কল্পের সেতু। প্রশ্ন করেছিলেন কবি— এখনো কি নেই কোনও আরুণি?
‘আরুণি উদ্দালক’ নামের সুবিখ্যাত কবিতায় ব্যাকুল আহ্বানে ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর আঁৎকে ওঠা দেখা— কেমন করে ‘ঘরে ঘরে সকলেই নিঃসঙ্গ প্রস্তুত করে লক্ষ্মী-উপাসন’! কেমন করে, ‘যে যার আপন সুখে চলে যায় পূর্ণিমার দিকে’! তাঁর মনে প্রশ্ন জাগছিল এই কি তবে দেশের মূর্তি? নাকি স্বাধীনতার প্রাপ্তির দু’দশক না পেরোতেই ‘...দেশের মূর্তি দেশের ভিতরে নেই আর !/গড়ে তুলবার দিকে মন দেওয়া হয়নি আর কী/সহজেই বাঁধ ভেঙে যায়/চেতাবনী ছিল ঠিক, তুমি-আমি লক্ষ্যই করিনি/কার ছিল কতখানি দায়/আমরা সময় বুঝে ঝোপে ঝোপে সরে গেছি শৃগালের মতো/আত্মপতনের বীজ লক্ষ্যই করিনি’। হৃদয়হীন এক মহানগরের প্রতি সুতীব্র ধিক্কারে সেদিন বলে উঠেছিলেন শঙ্খ ঘোষ— ‘আর তুমি/শোকের আতসগড়া তুমি কী সুন্দর মজ্জাহীন/ রাত্রিগুলি ওড়াও আকাশে/ বণিকের মানদণ্ড মেরুদণ্ড বানাও শরীরে/ ...হে নগর, দীপান্বিতা ভাস্বতী নগরী/ আকণ্ঠ নাগরী/ মহিষের ধ্বস্ত দেহে যত লক্ষ রক্তবিন্দু জ্বালায় শকুন/ তোমার রাত্রির গায়ে তার চেয়ে বেশি ফুলঝুরি/ পোহালে শর্বরী/ তোমারই প্রভাতফেরী মেতে ওঠে ত্রাণমহোৎসবে।/… লোকে ভুলে যেতে চায়, সহজেই ভোলে।’
২
শঙ্খ ঘোষ ভাগ্যবান। মৃত্যুর মহতী পরিত্রাণ ২০২৬ দেখার নরক যন্ত্রণা থেকে তাঁকে চিরমুক্তি দিয়েছে। না হলে তাঁকে দেখতে হতো— মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বসবাসের শহর নগর কলকাতা কেমন অতুলনীয় নির্লজ্জ বেহায়া হয়ে গেছে রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায়। না পূর্ববর্তী কোনও উদাহরণেই এই বেহায়াপনার তুলনা পাওয়া যাবে না। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বারো জন সহনাগরিককে দু’-তিন দিনের মধ্যে পরপর মরে যেতে দেখলেও যার হেলদোল হয় না কোনও। এই শহরের অধিবাসী তথা রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রধান তারপরেও দিব্যি সপার্ষদ বেরিয়ে পড়তে পারেন পুজো উদ্বোধনে। লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন সরকারি হিসেব মতে উত্তরবঙ্গে এক রাতের বৃষ্টি আর ভূমিধসে চলে গেলে ২৭টি প্রাণ, বন্ধ হলো না পুজো কার্নিভালের মতো মোচ্ছব। এমনকী কার্নিভাল বন্ধ না করলেও রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে সেই মহার্ঘ মোচ্ছাবে অংশগ্রহণ করা একজন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে কতোখানি অসংবেদনশীলতার পরিচয়, তা ভেবে দেখবার প্রয়োজনও পড়ে না এখন আর। পনেরো বছর একাদিক্রমে পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতায় থাকার পর সেই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী থেকে সর্বনিম্ন পদাধিকারীটির পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অমোঘ সত্য যে, ‘Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely’।
মহানগরের মন থাকে কিনা অনেক পুরানো প্রশ্ন। গণস্মৃতিও চিরকালই স্বল্পায়ু। কিন্তু ’৬৮ সালের পশ্চিমবঙ্গে যা ছিল না এবং ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গে যা আছে তা হলো ফুর্তি উন্মত্ত রাজন্যবর্গের পরোয়াহীন অরাজকতা।
গোটা দেশটার অবস্থাটাও একই। কী বিপুলভাবে আমরা ভুলে যেতে শিখে গেলাম মোদীভাই-দিদিভাইয়ের রাজত্বকালে! কী অনন্য ক্ষমাসুন্দরতার পঙ্কে গলা পর্যন্ত ডুবে গেলাম নিজেদের অজান্তেই! গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নামক ত্রাণবাহী জাহাজগুলোতে কোথাও থাকবে না ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা অথবা ভারত থেকে পাঠানো এক দানা চাল, গম; সত্যিই ভাবা সম্ভব ছিল না আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগেও।
১৯৯২সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর মানবতার শত্রু আমেরিকান শাসকবর্গের নিষেধাজ্ঞায় যখন তীব্র খাদ্য সঙ্কট কিউবায়, তখন ভারতবর্ষ বিশ্বের সেই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম; যারা প্রথম আমেরিকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে খাদ্যশস্য পৌঁছে দিয়েছিল কিউবায়।
সেদিন কিউবায় ত্রাণ প্রেরণের প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সিপিআই(এম)। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল একাধিক রাজনৈতিক দল। দূরে থাকেনি তৎকালীন শাসকদল কংগ্রেস। আবেগঘন ভাষায় ভারতের পাঠানো ত্রাণ গ্রহণ করেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। ভারতের বন্ধুত্ব, সাহায্য, সহানুভূতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন সমগ্র কিউবাবাসীর পক্ষ থেকে। মোদীবাবুর দল থেকেই তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী থেকে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির একজন মুখিয়াও কখনো ইজরায়েল প্রীতি দেখিয়ে প্যালেস্তাইনের পক্ষে না দাঁড়ানোর মতো ঘৃণ্য অবস্থান গ্রহণ করেননি।
মোদী জামানায় গোদি মিডিয়ার মাধ্যমে আকাশে-বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে মগজ ধোলাইয়ের মন্ত্র। প্যালেস্তাইনে মানুষ মরছে, তাতে আমাদের কী? প্যালেস্তাইনের মানুষ আমাদের কে হয় যে, তাদের জন্য আমাদের সোচ্চার হতে হবে?
আমরা বুঝিনি বানের জল বাইরে থেকেই ঘরের ভিতরে ঢোকে। প্যালেস্তাইন প্রশ্নে উদাসীন নাগরিক-মন কখন যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট সহনাগরিকের মৃত্যুতেও উদাসীন হতে শিখে গেছে, কখন যে সে আর বিন্দুমাত্র ভাবিত না হতে শিখে গেছে— তাই রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলে এত জীবন জলের তোড়ে ভেসে গেলেও, অভয়ারণ্যের অসহায় পশুগুলো মরে গেলেও বানের জলে খাবি খেতে খেতে! আমরা যেন সত্যিই বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারছি না; আমাদের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! আত্মধ্বংসের, আত্মবিস্মৃতির শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা!
ভরসা এই যে, সব মানুষ ভুলে যান না বা ভুলে যেতে পারেন না বা ভুলে যেতে দেন না। কেউ কেউ জেগে থাকেন। জেগে থাকা, জাগিয়ে রাখাটাই যাদের কাছে ধর্ম। আশার আলো, রাতের অন্ধকারেই নেমে পড়েছে বহু ছাত্র-যুব রেড ভলান্টিয়ার। চলছে রান্না করা খাবার পোঁছে দেওয়া, কিছু ওষুধ নিয়ে পাশে দাঁড়ানো। দুর্গত এলাকায় পৌঁছে গেছে তারা। শুধু তারাই নয়, অনেক ক্লাব সামাজিক সংস্থাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেখা নেই শুধু সরকারের। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই অনুশীলনও চলছে— এটাই আশার আলো। শঙ্খ ঘোষের কথায়— "যখন তোমায় বকি, আমার দুচোখ বেয়ে কান্না নামার চিহ্ন তুমি দেখতে পাও না ঠিকই বুঝবে তবু সামনে এসে তোমার জন্য কী আয়েসে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখি কী কী ! মনের ভিতর আলো আসার পথ খুলে যায় ভালোবাসার দশদিগন্ত হয়েছে জমকালো"
Comments :0