SHASHTHIPADA CHATTOPADHAY

মন খারাপ করা দুপুর
আর ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

রাজ্য

SHASHTHIPADA CHATTOPADHAY

প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়

সেই সব দুপুরের কথা মনে পড়ে। তখন ছোটবেলা। মামাবাড়ির সেই গ্রাম। চারিদিকে মাঠ আর মাঠ, গ্রাম জুড়ে বড় বড় পুকুর। মামাদের বিশাল বাড়ি। মোট সদস্য সংখ্যা বাহান্ন। খুড়তুতো, জাঠতুতো মিলে দশ মামা, দশ মামী। তাঁদের ছেলেমেয়ে আর আমরা মাসতুতো ভাই বোনেরা। 

মামারা সবাই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। কড়া শাসন বাড়িতে। তাই সবাই জুটত মামারবাড়িতেই। একসঙ্গে মানুষ হওয়া, যৌথ পরিবারের মজাটাই আলাদা। যা এখন আর পাওয়া যায় না। 

মনে আছে সেই গ্রীষ্ম দুপুরের কথা। স্কুলের গরমের ছুটি। মামাদেরও ছুটি। পড়াশোনা আর বাড়ির চৌহদ্দিতে আটকে থাকা। মামা, মামীদের কড়া শাসন উপেক্ষা করার ক্ষমতা ছিল না। অথচ গ্রামীণ ঘন দুপুর আমাদের টানত। আম, জামের টান তো থাকতই তার সঙ্গে গ্রামের নিরালা দুপুরের আকর্ষণ কম ছিল না। বাড়ির সিংহ দুয়ার পার হলেই খাঁ-খাঁ রোদে পড়ে থাকা গ্রাম। নিস্তব্ধ রাস্তায় লোক চলাচল নেই। ওদিকে গাছপালা ভরা বাগানগুলোতে কত রকমের পাখিদের গুঞ্জন। অথবা ক্লান্ত দুপুরে কোনও কোনও পাখি চুপচাপ বসে প্রহর গুনত। কখন দুপুর পেরিয়ে আসবে বিকাল। পুকুরগুলোর শান্ত জলে জলপোকারা আঁকিবুকি কেটে যেত। সেই পুকুর আমাদের টানত। একবার বের হতে পারলেই খোলাম কুচি নিয়ে পুকুরের জলে ব্যাঙবাজির মজা। 

আমাদের মতিগতি বুঝে মামা ও মামীরা প্লান খাটালেন। দোতলার লাইব্রেরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো একদিন আমাদের। যাতে চোখের আড়াল দিয়ে বাইরে কেউ বের হতে না পারি। মামারবাড়ির বিশাল ঘরোয়া লাইব্রেরিটায় বইয়ের যেন শেষ ছিল না। মামীরা আমাদের বেছে বেছে হাতে বই তুলে দিতেন। হাতে সেই প্রথম পেয়েছিলাম পান্ডব গোয়েন্দার প্রথম খন্ড। পড়ার পরই মন মুগ্ধ হয়ে গেল। এক এক করে অনেকগুলো পড়ার পর চোখ আটকে গেল লেখকের নামে। তাঁর ছবিতে। সেই প্রথম বইয়ের মাধ্যমে আলাপ ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কোনওদিন চোখে দেখব ভাবিনি। 

লেখকের বই ভালো লাগলেই লেখককে নিয়ে স্বপ্ন আসে। গ্রামীণ দুপুরে যে মাদকতা আমাদের বাইরে চুম্বকের মতো টানত, সেই টান ক্রমে কমে এল। আমরা গ্রীষ্মের দুপুরে পান্ডব গোয়েন্দায় আটকে গেলাম। অতগুলো ভাইবোন সারা দুপুর কাটিয়ে দিতে লাগলাম একসঙ্গে। সবার হাতে আর বই নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের চেয়ে যে দাদা বড় ছিল, সেই পড়া আরম্ভ করল। সারাটা দুপুর বাবলু, বিলুদের সঙ্গে আমরাও মনে মনে অ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠলাম। গ্রাম্য দুপুরে বাইরে বের না হতে পারার মন খারাপটা পুষিয়ে দিয়েছিল পান্ডব গোয়েন্দার স্রষ্ঠা ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। তারপর কোথা দিয়ে ছোটবেলা হুট করে কেটে গিয়ে বড়বেলা এসে গেল।

একদিন সত্যিই লেখকের সঙ্গে পরিচয় হলো। দারুণ মানুষ, একেবারে অহঙ্কারহীন। কত কিছু জানতেন, জ্ঞানের পরধি ছিল বিশাল। অথচ কথাহীন হয়ে থাকতেন। যেন কিছুই জানেন না। গভীর ভাবে মিশতে মিশতে একদিন একেবারে আপনজন হয়ে যাওয়া। কেটে গেল বহু বছর।

ছোটবেলার দুপুরের সেই মনখারাপটা আবার এল, এই সেদিন, ২ মার্চ। এদিনই চলে গেলেন আমার ছোটবেলার প্রিয় লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। এদিন দুপুরটা অদ্ভূত ভাবে ডেকে নিয়ে এল ছোটবেলার মনখারাপটাকে। কড়া রোদে এই শহুরে জীবনে অনেক কিছুকেই ছাপিয়ে তাঁর মেলামেশার কথা মনে এল। 

সেই সব দিনে কাহিনিগুলো যে অনুভব এনেছিল সেই অনুভবই যেন ফিরিয়ে আনল। ওই তো রেলিংয়ের ওপর বসে রোদে পুড়তে পুড়তে কাকটা কা কা করে মারাত্মক বিষন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে দুপুরের পরিবেশে। শহর তাই প্রাণচঞ্চল। তা হলেও অদৃশ্য ভাবে শহুরে জীবনের মধ্যে নিরালা দুপুর তৈরি হলো যেন। কোথা থেকে একরাশ মনখারাপ করা দুপুরের বাতাস ঘিরে ধরল। হা হা এক শূন্যতা বুকের মাধ্যিখানে মোচড় তুললো। মানুষটা চলে গেলেন। হাজারো স্মৃতি নিঃশব্দে পড়ে রইল মনের একলা ঘরে। সেই ছেলেবেলার পাঁচ চরিত্র আর কানা পঞ্চু যেন ফিরে এল স্মৃতির দুয়ারে। ঠিক তখনই নিচে বারান্দায় যে কুকুরটা শুয়ে থাকে তার ভৌ ভৌ আওয়াজ ভেসে এল। অদ্ভূত এক মিলমিশ। মনটা ছিন্নভিন্ন করে দিল। 

যা হারায় তা ফেরে না। তবে মনের অন্দরে কোথায় যেন রয়ে গেল সোনালী ছেলেবেলা। আর সেই ছেলেবেলার সোনালী স্মৃতি এনে দিয়ে ছিলেন এই লেখকই তো!

Comments :0

Login to leave a comment