বিশ্বনাথ সিংহ
গ্রামে অভাব নিত্যসঙ্গী।
সতের বছরের ছেলে সোয়েব আক্তারের রোজগারের চলে সংসার। সোমবার দিল্লিতে পাঁচ তলার ছাদ থেকে ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন একই গ্রামের চার পরিযায়ী শ্রমিক। ওঁরা সবাই দিল্লিতে নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন। ঈদ উৎসবে বাড়ি ফেরার টিকিট হয়ে গেছে। ঈদে বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত সোয়েব আক্তার, আনিসুল সেখ, আবেদ আলি, ওসমান আলিদের।
উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ ব্লকের বাহিন গ্রাম পঞ্চায়েতের ভুলকাই গ্রামের বাসিন্দা এই শ্রমিকরা। দিল্লি থেকে সোমবার বিকেলে গ্রামে খবর পৌঁছাতেই দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পরেছে শ্রমিকদের পরিবারে।
একশো দিনের কাজ অমিল। অন্যদিকে কৃষকের ফসলের দাম নেই। বিড়ি শ্রমিকের মজুরিও তথৈবচ। চোপড়া ইসলামপুর এলাকায় চা বাগানের দালালির দাপটে মারাত্মক অচলাবস্থা চলছে। জলের অভাবে উচ্চফলনশীল ধান লাগানোর কাজ আটকে পড়েছে। এই অবস্থায় সংসার বাঁচাতে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে গ্রামের হাজার হাজার যুবক। উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে দলে দলে ঠিকাদারের হাত ধরে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
সতের বছরের ছেলে সোয়েব আক্তারের বাবা সাহিদ হক ছেলের দুর্ঘটনার খবর নিজেই জানালেন। তিনি বলেন, ‘‘কী করব? গ্রামের মানুষ বড্ড অসহায়। নিজের এক ছটাক জমি জায়গা নেই। তিন ছেলে ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে। ছেলেদের উপার্জনের টাকাতেই সংসার চালাতে হচ্ছে। গ্রামে কাজ থাকলে আর কেউ কি শখ করে ভিন রাজ্যে পাঠাচ্ছে ছেলেদের?’’
সাহিদ হক জানাচ্ছেন,‘‘পঞ্চায়েত সদস্যের কাছে কয়েকবার দরবার করেও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘরের তালিকায় নাম উঠেনি। অথচ সদস্যের কাকা আত্মীয়দের নাম আছে টাকাও পেয়েছে।’’
উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ ব্লকের বাহারাইল, মালোন, জগদীশপুর, ভিটি, পাড়ের গ্রামে রাজস্থান-হরিয়ানার বড় বাস সপ্তাহে তিনদিন যাতায়াত করছে। বাসের মালিকানা কেউ জানে না। তবে গ্রামে গ্রামে এজেন্ট আছে। টিকিট কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিদিনের খাওয়া দাওয়া হাত খরচের টাকা দিয়েই গ্রামের জওয়ানদের অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদের কেউ রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগানদারের কাজে, আবার কেউ মার্বেলের কাজে, কেউ আবার সোনার দোকানে, আবার কেউ আছে রাজস্থানে জরি শিল্পের কাজে। এভাবেই গ্রাম থেকে একে একে সবাই পাড়ি দিচ্ছে অন্য রাজ্যে।
গবাদিপশুর সঙ্গে একটি ঘরে কোনো রকমে কাটাচ্ছেন দুর্ঘটনায় আহত আবেদ আলির পরিবার। আহত আবেদ আলির স্ত্রী আনোয়ারা বেগম স্বামীর দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রাত থেকে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। ঈদে স্বামীর বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত। হাত পা ভেঙে দিল্লির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ছোট্ট ছোট্ট তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবেন জানেন না।
ওসমান আলির স্ত্রী বেলি খাতুন ডুকড়ে ডুকড়ে কাঁদছেন। দু’মাস হলো বাড়ি থেকে কাজে গেছেন স্বামী। রাজমিস্ত্রীর জোগানদারের কাজে আছেন। দৈনিক ৬০০ টাকা হাজিরাতে দিল্লিতে বড় ইমারতের কাজ করতে গিয়ে মাচা ভেঙে পড়ে। দিল্লির হাসপাতালে ঠিকাদার ভর্তি করে দিয়েছে। কেমন আছেন স্বামী জানা নেই বেলি খাতুনের। দু’মাস বাড়ির জন্যে খরচাপাতি কিছুই পাঠাতে পারেননি ওসমান আলি। কথা ছিলো ঈদে আসবেন। অনিশ্চিত উৎসবে বাড়ি ফেরা। নিজের সামান্য গয়না বন্ধক রাখলেন। তা দিয়ে যে কটা দিন কাটে। স্ত্রীর নিজের শরীর খারাপ কেমন করে নিজের চিকিৎসা চলবে তা নিয়েই প্রহর কাটছে ওসমান আলির স্ত্রী বেলি খাতুনের।
রায়গঞ্জ, চোপড়া, ইটাহার ইসলামপুর ব্লক প্রশাসনের কাছে এসব কোনো তথ্য নেই। এমনকী জেলার লেবার কমিশনার অফিসে কেউ জানে না উত্তর দিনাজপুর জেলা থেকে কোথায় কোথায় কত যুবক ভিন রাজ্যে আছে। বিভিন্ন গ্রামপঞ্চায়েত সূত্রে জানা গেছে, একশো দিনের কাজ কয়েক মাস ধরে বন্ধ। টাকা নেই। অন্য কোনো স্কিমের টাকাও আপাতত নেই। দু’একজন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান, মেম্বাররাও জানাচ্ছেন, এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের কাজ করানোর পরেও জব কার্ড হোল্ডারদের বকেয়া মজুরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পঞ্চায়েতের কাজ করার পর সেই বকেয়া টাকার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে অনেকেই। পানিশালা, বাহিন, সুরুন, বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় লক্ষ লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে। বরুয়ার সহদেব দাস জানান, গ্রামগঞ্জে মানুষের হাতে কোনো রোজগারের পথ নেই। স্বাভাবিকভাবে বউ বাচ্চাকে বাঁচাতে যে করে হোক উপার্জনের পথ খুঁজতে এখন ভিন রাজ্যে প্রতিদিন ছুটছে গ্রামের ছেলেরা। গ্রাম ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাওয়া আসা এখন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছাতেই শুনতে পাওয়া যায়, ভবিষ্যতে পুরুষ শূন্য গ্রাম হয়ে যেতে পারে ভিটিয়ার, বিষাহার, নমনিয়া, সরিয়াবাদ, খারিসরিয়াবাদ গ্রাম। রায়গঞ্জ জেলা সদর শহর থেকে গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। নাগর নদীর পশ্চিমে অবস্থিত গ্রাম। নদীর ওপারে বিহার রাজ্যের বারসোই সড়ক ধরে বিস্তীর্ণ এলাকা। এক কথায় জেলার ছিটমহল গ্রাম নামেই পরিচিত। দুপুরের রোদে গাছের নিচে মাচা অথবা চায়ের দোকানের টুলে বসে গল্প গুজবেই জানা যায়, গ্রাম ঢাকা পড়ছে অন্ধকারে।
বিষাহার গ্রামে ৩৪২টি এবং ছোটো ভিটিয়ার গ্রামে ১৪৭টি পরিবারের বসবাস। অধিকাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এছাড়াও তপশিলি জাতিভুক্ত মানুষও রয়েছেন। ৪/৫টি গ্রামের যুবকদের সংখ্যা মাত্র ৭/৮ বছরে কমে গেছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
বিভিন্ন গ্রামে একই ছবি। কাজ নেই। আবাদি ফসলের সঠিক দাম নেই। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। প্রায় ৮/১০টি গ্রামের মানুষের অভিযোগ, ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর প্রকৃত গরিব একটি পরিবারেও মেলেনি। আবাস যোজনার কথা শুরু হতেই গ্রামের মহিলারাও রে রে করে ওঠেন। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি মুলিবাঁশের ঘেরা অথবা টিনের ছাউনি। একজন পরিবারের মুখেও জানা যায়নি আবাস যোজনার উপভোক্তার নাম।
গ্রাফিক্স: মনীষ দেব
Comments :0