মধুসূদন চ্যাটার্জি
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শবর সম্প্রদায়ের মানুষজন কি বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চোখে মৃত? বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের গ্রামগুলি থেকে আজ এই প্রশ্ন উঠে আসছে। কিন্তু কাকে এঁরা বলবেন? কোন পঞ্চায়েত সদস্যই এঁদের গ্রামে যান না। কী অবস্থায় এই মানুষগুলো দিন কাটাচ্ছেন তার খবর কি প্রশাসনের কাছে আছে?
টুকরো কিছু খবর তাঁদের কানে গেলেও তার কোন গুরুত্ব দিতে রাজি নয় প্রশাসন ও দুই শাসকদল। কারণ একটাই, এঁরা তো সংখ্যায় নগন্য। আর সবটাই তো ভোটের দিকে তাকিয়ে ভাবা হয়, তাই এঁরা মরলেন কী আধপেটা খেয়ে কোন রকমে কয়েকদিন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে বিদায় নিলেন তাতে কার কী আসে যায়?
আদিম আদিবাসী বলতে আমরা যা বোঝাই তাতে শবরদের স্থান ওপরের দিকেই। না, তাঁদের নিয়ে আলোচনা দেখা যায় না। ঘটনা হলো প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় যে বাড়ি দেওয়া হচ্ছে সেখানে শবর জনগোষ্ঠীর মানুষজন কোথাও ছিঁটেফোটা পাচ্ছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হচ্ছে না।
শবর জনগোষ্ঠীর মানুষজন সাধারণ জঙ্গলঘেরা পাহাড় এলাকার একেবারে ওপরে বাস করেন। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে বেশিরভাগ এলাকাতেই ঐ জঙ্গল ভেদ করে রাস্তা করা হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা আবাসনের বাড়ি। সেগুলির একটা বড় অংশ এখন সংস্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু এঁরা করবেন কী করে? সরকারি চাকরির মুখ এঁরা দেখেননি। ছিটকে দু’একজন হয়ত পেয়েছেন, তাও বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। তাঁরা আবার পুরোনো জায়গায় থাকেন না। যাঁরা আছেন তাঁদের কাজের সম্বল বলতে ছিল রেগার কাজ। সেটাও দু’বছর ধরে বন্ধ। যে রাস্তা হয়েছিল তাও ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। নতুন করে কোন সংস্কার হয়নি। জানান, মুকুটমনিপুর বরদা শবর পাড়ার বাসিন্দা শম্ভু শবর, কুল্যাম গ্রামের পঞ্চমী শবর, লদ্দার কৃষ্ণ শবররা।
তাঁরা বলছেন, আমরা কয়েকবার পঞ্চায়েতের লোকজনকে বলেছিলাম। কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। আবার রানিবাঁধের লদ্দা গ্রামের বাসিন্দা সরস্বতী শবর জানান, ‘‘অম্বিকানগর পঞ্চায়েতে কয়েকবার গেছি। প্রধানের ঘরের ভেতরেই আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জোড় হাত করে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। এখন আর যাই না।’’
এই গ্রামে ১৬টি পরিবারের বাস। একটি পরিবারের জন্যও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি আসেনি। একই দৃশ্য খাতড়া থানার জলহরি গ্রামেরও। খাতড়া থেকে প্রায় ৮কিমি দুরে এই জলহরি গ্রামে ৩৫টি শবর পরিবারের বাস। না, এখানেও ভুল করে একটি ঘর দেয়নি সরকার। এখানকার বাসিন্দা নাথু শবর জানান, ‘‘রাস্তাটা হয়েছে। সেটা তো বাম জমানাতেই হয়েছিল। এখন খালি একটু প্রলেপ পড়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ঘরই ভাঙা ফুটো। খাবার জলেরও ঠিকমতো ব্যবস্থা নেই। গ্রীষ্মের সময় বহুদুর যেতে হয় স্নান করতে। গ্রামে যে একটি ডোবা আছে তার জল মরে যায়। ছেলেদের কোনও কাজ নেই।’’
জঙ্গল থেকে খেজুর পাতা তুলে নিয়ে এসে চাটাই করে এঁরা বিক্রি করেন। সেটা আর কত রোজগার হবে? যন্ত্রণাকাতর মুখে কথাগুলো শোনালেন মালতি শবর। রানীবাঁধ অঞ্চলের বড়ডাঙ্গা গ্রামে ৮টি শবর পরিবারের বাস। এখানেও সরকারি ঘরের সংখ্যা শূন্য। আলো ঝলমলে মুকুটমনিপুরের গা ঘেষে আছে বরদা শবরপাড়া। এখানে ৪৪টি পরিবার বাস করেন। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এঁদের একটু আনন্দের মধ্যে দিন কাটে। সেই সময় মুকুটমনিপুরের পিকনিক করতে আসেন প্রচুর মানুষ। পিকনিকের শেষে রান্নার বাসন পত্র এই শবরপল্লীর মা বোনেরাই পরিষ্কার করেন। উচ্ছিষ্ট খাবার তখন তাঁদের হাতে কিছুটা আসে। ভালো, সুগন্ধী খাবার তো এঁদের জোটে না।
এখানকার যুবকরাই মুকুটমণিপুর জলাশয়ে নৌকা চালিয়ে পর্যটকদের ওপারে নিয়ে যান। সারা বছর কাজ মেলে না। তখন নীরবে এশিয়ার বৃহত্তম মাটির বাঁধের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। গ্রামে যে পানীয় জলের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল সেই পানীয় জলের সাবমার্শিব্যালটি পাশের অন্য গ্রামে চলে যায়। এখানকার মানুষজনকে বহু দুর থেকে পানীয় জল নিয়ে আসতে হয়।
এখানে তিনটি বাড়ি দেওয়া হয়েছে। বাকি গুলো কি হবে? কোন উত্তর নেই। বেশ কিছু শবর মহিলা এই গ্রাম থেকে প্রতিদিন বাইরে ভিক্ষা করতে যান। অথচ এই এলাকার বিধায়ক রাজ্যের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী জ্যোৎস্না মান্ডি। এখানেই শেষ নয়, রানীবাঁধের মৌলা গ্রামে এখন ২৮টি শবর পরিবার বাস করেন। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি এসেছে মাত্র ২টি পরিবারের ঘরে। বাকি প্রায় সকলেই ভাঙা বাড়িতেই থাকেন। সেদিক থেকে বলা যায় রুদঢ়া অঞ্চলের জভি গ্রাম উপরের দিকে। এখানে ৩০টি পরিবার বাস করেন। এখানে ৭জন বাড়ি পাবেন বলে জানানো হয়েছে। পু্ড্ডি অঞ্চলের ঘোলকুড়িতে ১৪টি পরিবার থাকেন। ঘর পাবেন ৩টি পরিবার। বাকিদের কি হবে? কোন উত্তর নেই।
রানীবাঁধের সারেশডাঙ্গায় ২৯টি পরিবারের মধ্যে বাড়ি পেয়েছেন ৬টি পরিবার। বাকিগুলি সব বড়লোকের দলে! একই চিত্র সুতান, রাইপুরের শ্যামসুন্দরপুর, সোনাগাড়া, হিড়বাঁধের মশিয়াড়া অঞ্চলে বাস করা শবর জনগোষ্টির মানুষজনের। এঁদের বেশিরভাগেরই পৈত্রিক কোন জমি নেই। যা পাট্টার জমি কয়েকজন পেয়েছেন তা বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই। নতুন করে কোন পাট্টার জমি এঁরা পেলেন না।
তবে এই মানুষ সম্প্রতি একটি ঘটনায় খানিকটা লড়ায়ের রসদ পেয়েছেন। বামফ্রন্টের মেয়াদে বিপিএল তালিকা ভুক্ত হওয়ার কারণে বিনা খরচে বিভিন্ন শবরপল্লীতে বিদ্যুতের সংযোগ দেওবা হয়েছিল। তৃণমূলের সরকার আসার পরই সেই সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। বলা হয় বিদ্যুতের বিলের টাকা বাকি পড়ে আছে। এঁরা জানান, ‘আমরা তো বিনা খরচেই আলো পেতাম। সরকার পরিবর্তন হয়ে গেল আমাদের আলো কেড়ে নেওয়া হল?’ কোনও উত্তর ছিল না বিদ্যুৎ দপ্তরের।
সিপিআই(এম) কর্মীদের উদ্যোগেই গ্রামে গ্রামে মানুষজনকে সংগঠিত করে রানীবাঁধে বিদ্যুতের দাবিতে মিছিল করে ডেপুটেশন দেওয়া হয় গতবছর ৪ মার্চ। এর ফলে বিদ্যুৎ দপ্তর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফের বিদ্যুতের সংযোগ দিতে বাধ্য হয়। রানীবাঁধে ৫৬৭টি শবর পরিবার আছেন। সেদিন সব বাড়ি থেকে মানুষজন এসেছিলেন। এই আন্দোলনের জয়ে আজ উৎসাহিত তাঁরা। সরকারি বাড়ির দাবিতে ফের আন্দোলনে নামতে চলেছেন।
Comments :0