আবার নভেম্বর। অবধারিতভাবেই লেনিন। আর প্রতিদিনকার সমকালীন পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ। আর প্রতি মুহূর্তে স্পষ্টতর হয় লেনিনের অমোঘ বিশ্লেষণের বাস্তবতা। এ সেই মায়াকভস্কির কবিতার মতো, যতই খোদাই করে জেলখানার দেওয়াল থেকে লেনিনকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, অক্ষরগুলো আবার উজ্জ্বলতর হয়ে ফুটে ওঠা।
সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা
লেনিনই বুঝিয়েছিলেন। দৃশ্যমান বাস্তবতা (ফটোগ্রাফিক রিয়েলিজম)’র সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তফাত। চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তাই বাস্তবতা নয়। বরং বাস্তবতার মধ্যে প্রোথিত দ্বন্দ্বের সমাধানের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের অভিমুখ। লেনিন ব্যাখ্যা করেছিলেন, দ্বন্দ্বতত্ত্বের সংজ্ঞা। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ।
এটাই ছিল নভেম্বর বিপ্লবের তাত্ত্বিক চাবিকাঠি। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল যে সমাজতন্ত্রের প্রথম আগমনধ্বনি শোনা যাবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে। এর পিছনে যুক্তিগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সমাজতন্ত্রের ভগীরথ শ্রমিকশ্রেণী। উন্নত পুঁজিবাদী সমাজগুলোতে শ্রমিকশ্রেণীর সংখ্যাবাহুল্য। স্বভাবতই সেখানেই তো সমাজতন্ত্র প্রথম পা ফেলবে।
কিন্তু লেনিন দেখালেন অন্যরকম। পুঁজির চরিত্র বিশ্লেষণে মার্কস অপরাজেয়। তিনি দেখিয়েছিলেন পুঁজির চরিত্রই হচ্ছে প্রচণ্ড গতিতে ঘনীভূত হওয়া, কেন্দ্রীভূত হওয়া। লেনিন মার্কসের এই মৌলিক বিশ্লেষণকে মৌলিকভাবেই সম্প্রসারিত করলেন। পুঁজির বিকাশ একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব নয়। তার অনিবার্য গতি ভৌগোলিক সীমানা ভেঙ্গে তাকে বিশ্বজনীন চরিত্র দেবে। এটাই সাম্রাজ্যবাদের বাস্তব ভিত্তি। সুতরাং দৃশ্যমান বাস্তবতায় যা প্রতিভাত হচ্ছে পুঁজির বিস্তারে, সম্প্রসারণে তাই সৃষ্টি করছে পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়। কারণ সাম্রাজ্যবাদ শুধুমাত্র আপন দেশের শ্রমিকদের শোষণের ভিত্তিতেই নয়; বরং বিস্তারের রাস্তায় গঠিত হওয়া উপনিবেশগুলির শোষণ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ। সুতরাং সংঘাত অনিবার্য। এবং সাম্রাজ্যবাদের স্থায়িত্বের সামনে স্পষ্ট হল চ্যালেঞ্জ।
এখান থেকেই লেনিন এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে বিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদ আসলে নতুন সাম্রাজ্যবাদের যুগের সূচনা করেছে। সুতরাং শোষণহীন সমাজের – সমাজতন্ত্রের লড়াই সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত না করে সফল হতে পারে না। ফলে সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিকে আঘাত করলেই বিপ্লব সমাগত হবে। ফলে রাশিয়া। জার শাসিত স্বৈরতান্ত্রিক পশ্চাদ্পদ রাশিয়া। তারপর তো যা ঘটল তা ইতিহাস। নভেম্বর বিপ্লবের বজ্রনির্ঘোষ। শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকদের ক্ষমতা দখল। সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আরো গূঢ় বিশ্লেষণ পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরে আরোহণের পাশাপাশি আরো গূঢ় সত্য লেনিনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে সমৃদ্ধ করেছিল। প্রসঙ্গটা ছিল পুঁজির চরিত্র। লেনিন দেখালেন যে পুঁজির সম্প্রসারণে কেবলমাত্র শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে পণ্য উৎপাদন করলেই পুঁজির যে দ্রুত গতি ভৌগোলিক সীমানা ভাঙার জন্য প্রয়োজন তা একত্রিত করা সম্ভব নয়। পুঞ্জীভূত করা সম্ভব নয়। অতএব পুঁজির নতুন রূপ লগ্নি পুঁজি। শিল্প পুঁজি আর ব্যাঙ্কিং পুঁজির সংমিশ্রণ। মানুষের সঞ্চয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে পুঁজির মালিকদের স্বার্থে কেন্দ্রীভূত করা। এটাই লগ্নিপুঁজির শক্তি এবং ক্ষমতাকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা। দেশে-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ার গতিবেগ অর্জন করা।
লেনিন আরো এগিয়ে গিয়ে লগ্নি পুঁজির ভবিষ্যত সম্ভাবনার গতিপথও নির্ধারণ করে দিলেন। পুঁজির সমস্ত রূপের মধ্যে লগ্নি পুঁজি শুধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণই নয়, লগ্নি পুঁজি সমস্ত ধরনের পুঁজির নেতা। সমন্বয়কারী। দিকনির্দেশক। স্বভাবতই এই লগ্নি পুঁজির কার্যকলাপ জাতীয় গণ্ডির বাইরে – আন্তর্জাতিক।
বিশ্বায়নের যুগে, লগ্নি পুঁজি এবং লেনিন
বিশ্বায়নকে তার সামগ্রিকতাতেই বুঝতে হবে। পুঁজির গতিময়তার প্রথম ব্যাখ্যাকার মার্কস। আর লেনিন তাকে সম্প্রসারিত করেছেন সাম্রাজ্যবাদের যুগে। বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদের যুগের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই আমাদের সমকালীন পৃথিবীর বোঝাপড়ার চাবিকাঠি। বিশ্বায়ন, লগ্নি পুঁজির যা ইতিমধ্যেই জাতীয় সীমার উর্ধে একটি আন্তর্জাতিক রূপ এবং চরিত্র অর্জন করেছে তার অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ। এই আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির নিরবিচ্ছিন্ন অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করতে গেলে জাতি – রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিপ্লব – বিশেষ করে যোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে লগ্নি পুঁজির গতিকে লক্ষ লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বভাবতই এই জাতি-রাষ্ট্রের বাধাকে গুঁড়িয়ে দিতে শুধুমাত্র অর্থনীতির ক্ষেত্রেই রণাঙ্গন সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দরকার। আর আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাই বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের বিরোধিতাকে পর্যুদস্ত করতে পারে। কাজেই আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্যকে নিয়ে সর্বসম্মতি প্রতিষ্ঠিত করতে পুঁজিবাজারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিশ্চিত করতে হবে। তার অনিবার্য পরিণতি পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এই গতিপথের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধের মাত্রার ওপরে নির্ভর করে, একেকটি দেশের নির্দিষ্ট নয়া উদারবাদী কাঠামো এবং নীতি। লগ্নি পুঁজিই স্থির করে দেবে সরকারি নীতি। পুরনো ধাঁচের নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধ জনকল্যাণের রাস্তা নয়, লগ্নি পুঁজির তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী চাহিদায় ঘটবে সরকারি নীতির রূপান্তর। অভিমুখ।
বিশ্বায়নের যুগে পরিচিতি সত্তার নতুন রাজনীতি
স্পষ্টতই বিশ্বায়নের যুগ এবং আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির মুনাফাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার মরিয়া প্রয়াসের অনিবার্য পরিণতি তীক্ষ্ণ আর্থিক বৈষম্য। শোষণের তীব্রতা বৃদ্ধি । বেকারি, দারিদ্র, ক্ষুধা। সমকালীন অর্থনীতিতে এই প্রবণতাগুলো প্রবলভাবে দৃশ্যমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলির অপসারণ লগ্নি পুঁজির অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য শর্ত। ফলে বিশ্বায়নের সূত্রপাত সত্তর দশকের শুরুতে হলেও তা সাইক্লোনের গতি পেয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। শ্রমিক এবং শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক দুর্বল হয়ে পড়া এর অনিবার্য প্রেক্ষাপট।
কিন্তু, যা আপাত দৃষ্টিতে শক্তির আস্ফালন তা আদতে নতুন দ্বন্দ্ব আর নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির করছে। ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে যে বিশ্বায়ন আর নব উদারবাদের রাস্তা অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজির সংকট সমাধানে ব্যর্থ। এই সর্বব্যাপী সংকটের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষকেই।
একেবার সদ্য পাওয়া পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে ৩ অক্টোবর রাষ্ট্রসঙ্ঘ সতর্কতা জারি করে দাবি করছে যে অভূতপূর্ব মন্দা সমাসন্ন। কোভিড মহামারীর সময় যে মন্দা দেখা গিয়েছিল, এটা হবে তার থেকেও ভয়ঙ্কর। তার মূল কারণ ধনী দেশগুলোর আচরণ। ওইসিডি একই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। তাদের বিশ্লেষণে বিশ্বের আর্থিক বৃদ্ধি ২.৮ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়াবে ২.২ শতাংশ। সামগ্রিক ভাবে পৃথিবীর মোট উৎপাদন কমবে ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার।
মুদ্রাস্ফীতির ফলশ্রুতিতে মানুষের বিপন্নতার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলিকে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হতে হচ্ছে। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও পৃথিবীর মুদ্রাস্ফীতির হারের অনুমান ২০২১ সালের ৪.৭ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৮.৮ শতাংশ।
অনিবার্য পরিণতি বৈষম্য, বেকারি, বুভুক্ষার তীক্ষ্ণ ঊর্ধ্বগতি। এর অনিবার্য পরিণতিতেই আসছে মানুষের প্রতিরোধ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা রাস্তায়। অভূতপূর্ব বিক্ষোভ হচ্ছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি বা মলদোভাতে। স্পষ্টতই মানুষের জীবনযন্ত্রণার সমাধান নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নে নেই।
কিন্তু বিপদ অন্য জায়গায়। বিশ্বায়নের প্রধান উদ্বেগ বাজারের সর্বোচ্চ মুনাফায়। জীবনজীবিকার যে সংকট বিশ্বায়ন সৃষ্টি করছে, তার জন্য উদ্বেগ অমিল। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দেখা গেল ব্রিটেনে। সেখানে তথাকথিত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনকের প্রধানমন্ত্রী হবার মধ্যে আমাদের দেশের হিন্দুত্ববাদীদের মুখর উল্লাস সত্ত্বেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে সুনক আসলে লগ্নি পুঁজির পছন্দ। গোল্ডম্যান স্যাক্সের প্রাক্তন কর্মী, হেজ ফান্ডের পরিচালক। ব্রিটেনের ইতিহাসে বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক লগ্নির পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার চললেও সরাসরি হেজ ফান্ডের ম্যানেজার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে এর কোনো সমান্তরাল উদাহরণ নেই। ব্রিটেনের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও দক্ষিণপন্থী। কিন্তু তা সত্ত্বেও লগ্নি পুঁজির মুনাফার স্বার্থে যে ট্যাক্স নীতি দাবি করছিল তা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় সুনককে আনা হল প্রধানমন্ত্রিত্ব সামলাতে।
আরেকটা জিনিসও স্পষ্ট হল। বিশ্বায়নের হাত ধরেই শক্তিশালী হয়েছে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি। মানুষের ঐক্য নয়, বাজারের আধিপত্যই বিশ্বায়নের অভীষ্ট। ফলে লগ্নি পুঁজির আগ্রাসনে বিক্ষুব্ধ মানুষ বিশ্বায়ন বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হবে, মুখর হবে সেটাই স্বাভাবিক। ফলে বাজারের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়ে মানুষের ঐক্য চিড় খেলে, ভঙ্গুর হয়ে পড়লে তো সোনায় সোহাগা!
আবার লেনিন। আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন। লেনিনের রাজনীতি, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতি ছিল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ যে রিপাবলিকগুলি সেগুলি বৈচিত্রে সমৃদ্ধ। কিন্তু সেই সমস্ত রিপাবলিকগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করেই সোভিয়েত ইউনিয়ন। শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকদের ঐক্যের সঙ্ঘবদ্ধ রূপ।
কাজেই এখনো লেনিন পথ দেখাচ্ছেন। সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা নয়া উদারবাদী বিশ্বায়নের বীভৎস প্রভাবের বিরুদ্ধে। কারণ এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে বিশ্বায়নের রাস্তা পুঁজি আর কর্পোরেট মুনাফার সর্বোচ্চ মাত্রা সুনিশ্চিত করবার। আর লেনিন আর নভেম্বর শ্রমজীবী মানুষের জীবনজীবিকার, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই সংঘাত চলবেই। আর নভেম্বর ফিরে ফিরে আসবে সমকালীন পৃথিবীতে খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা জোগাতে।
Comments :0