দিল্লি থেকে গরিবকে তাড়িয়ে, গরিবী লুকিয়ে মধ্য প্রদেশের ভোটপ্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘গরিবের বেটা’ হয়ে গেলেন। নয়াদিল্লিতে জি ২০-র আয়োজনের জন্য মোদীর পুলিশ গরিব ফুটপাতবাসীদের উচ্ছেদ করেছে। পুলিশ দিনরাত গরিবদের তাড়া করেছে যাতে তাদের দেখে না ফেলে মোদীর প্রিয় বিদেশি অতিথিরা। দারিদ্র আড়ালে একের পর এক বস্তি, ঝুপড়ি ঢেকে দেওয়া হয়েছে বিশাল বিশাল কাপড় লাগিয়ে, যার উপরে সেঁটে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সহাস্য ছবি। দুনিয়াজুড়ে সমালোচনা চলছে এই নিষ্ঠুরতার। কিন্তু ভোটমুখী মধ্য প্রদেশের গরিব বুন্দেলখণ্ডের সমাবেশে দাঁড়িয়ে মোদী বললেন, জি ২০-তে যে বিদেশি মেহমানরা এসেছিলেন, তাঁরা বলছেন এমন আয়োজন আর কোথাও দেখেনি!
মধ্য প্রদেশের সাগর জেলায় এদিন এক ঘণ্টার বেশি বক্তৃতা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তৃতার অধিকাংশ সময় তিনি কেন্দ্রের সরকারের এবং মধ্য প্রদেশ সরকারের সাফল্য বর্ণনা করতে কাটিয়েছেন। এরমধ্যে জি ২০’র ‘সাফল্য’ নিয়েও অনেকখানি সময় ব্যয় করেছেন। তারপর বলেছেন, আমি গরিবের বেটা, গরিবের ঘরের রেশনের যাতে চিন্তা করতে না হয়, গরিবের মায়ের যাতে চিন্তা করতে না হয় সেই কাজ করে যাচ্ছি। মোদীর এই বক্তব্যর পরে বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলেছেন, জি ২০ উপলক্ষে দিল্লি থেকে গরিব তাড়িয়ে রাতারাতি এখন গরিবের ছেলে হয়ে গেলেন? সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই এদিন কার্যত নির্বাচনী সমাবেশ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে সামনের দিকে আলাদা আলাদা সোফায় সরকারি আধিকারিক, দলীয় নেতা এবং গণ্যমান্যদের বসার ব্যবস্থা ছিল। যেখানে কুলারও লাগানো হয়েছিল। আর তার পিছনে খাঁচার মতো ব্যারিকেড করে ‘জনতা জনার্দন’র বসার ব্যবস্থা ছিল। গরমে ঘামতে ঘামতে কাগজ, রুমাল ইত্যাদি হাতে নেড়ে হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করে ভাষণ শুনছিলেন তাঁরা।
মোদী যদিও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বুন্দেলখণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে হতদরিদ্র নারী-পুরুষের সামনে জি ২০-র বিপুল সাফল্যের ঢাক বাজালেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, দেশের গ্রামে গ্রামে বাচ্চাদের মুখে মুখে এখন জি ২০! এখন আত্মবিশ্বাসের সুর শোনা যাচ্ছে! এরপরেই উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, জি ২০ আপনাদের গর্ব- হ্যাঁ কি না? জি ২০ খায় না মাথায় দেয় বুঝতে না পারা প্রান্তিক জনতা নিশ্চুপ হয়ে রইলেন, পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করছেন। মোদী ফের বললেন, হাত তুলে বলুন জি ২০-তে দেশের গর্ব হয়েছে— হ্যাঁ কি না? আপনাদের মাথা উঁচু হয়েছে— হ্যাঁ কি না? দু’হাত প্রসারিত করে বুক ফুলিয়ে বললেন, আপনাদের সিনা চওড়া হয়েছে— হ্যাঁ কি না? এসব কথার উত্তর হ্যাঁ-তেই দিতে হয়, অন্তত প্রধানমন্ত্রীর সভায়। হাত তুলে জনতা সম্মতিতে মাথা নাড়লো। মোদী বলে চললেন, বিদেশি মেহমানরা ভারতে এসেছে, তারাও বলেছে এমন আয়োজন এর আগে তারা কখনও দেখেনি। যারা মধ্য প্রদেশে এসেছিলেন, তারা ফিরে গিয়ে আপনাদের গুনগান করেছেন। মোদী বিলক্ষণ জানেন, কাদের সামনে জি ২০বলছেন।
এদিনের সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের ঐক্যমঞ্চকেও আক্রমণ করেন। যথারীতি বিরোধের ঘমন্ডিয়া গঠবন্ধন বলেন। বিরোধীদের ইন্ডিয়া নামকে ইন্ডি বলে সম্বোধন করে বলেন, এদের গোপন কর্মসূচি আছে। সেটা হলো ভারতের সংস্কৃতির উপর হামলা করা, ভারতীয়দের আস্থার উপর হামলা করা। উদয়নিধির নাম না করে সনাতন ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, গান্ধীজী ভগবান শ্রীরামের থেকে জীবনভর প্রেরণা নিয়েছেন। এমনকি গান্ধীজী শেষ শব্দও ‘হায় রাম’ বলেছেন। ১৯২৮ সালে ৩০ মার্চ রামনবমীর দিন সবরমতী আশ্রমে এক বক্তৃতায় গান্ধীজী নিজেই বলেছিলেন, তার রাম বাল্মিকীর বা তুলসীদাসের রাম নয়। বালিকে গোপনে বা রাবনকে হত্যা করা রামও তার রাম নয়। কিন্তু মোদী বলেছেন। আবার গান্ধীর শেষ শব্দ বললেও কোন মতাদর্শের বুলেট তাঁর বুকে বেঁধার পরে তিনি ‘হায় রাম’ বলেছিলেন, সে কথা উল্লেখ করেননি। যেমন মোদী এদিন সনাতন ধর্মের সঙ্গে জুড়েছেন বাল্মিকী, রবিদাস এবং শবরীকেও; অথচ সেই সনাতন ধর্ম নিয়ে চিৎকার করার সময়ে উল্লেখ করেননি শম্বুকের কথা, নাম ভুলে গেছেন একলব্যের নাম। উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মের জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করে এই প্রসঙ্গই তুলেছিলেন উদয়নিধি স্ট্যালিন।
প্রধানমন্ত্রী এদিন বিরোধীদের ফের ঘমন্ডিয়া (অহংকারী) জোট বলে আক্রমণ করায় কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ পালটা বলেন, কে অহংকারী বলছেন একবার দেখুন! যিনি সরকারি অনুষ্ঠান থেকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করছেন। রমেশ বলেন, উনি বিরোধীদের জোটকে ঘমন্ডিয়া বলছেন, ওনাদের জোটকে যে কেউ গৌতম আদানির এনডিএ বলবে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এদিনও আদানির দুর্নীতি নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবি করা হয়েছে। এদিকে হিন্দি দিবস উপলক্ষে অমিত শাহের বক্তব্যেরও এদিন বিরোধিতা করেছেন উদয়নিধি স্ট্যালিন। অমিত শাহ বলেছিলেন, হিন্দু মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং স্থানীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এর পালটা সোশাল মিডিয়ায় উদয়নিধি বলেন, তামিলনাডুতে তামিল, প্রতিবেশী কেরালায় মালয়ালম। কিভাবে হিন্দি এই দুই রাজ্যকে জুড়বে? কিভাবে শক্তিশালী করবে? হিন্দিভাষীরা আছেন ৪-৫টি রাজ্যে। কিভাবে গোটা দেশকে জুড়বে হিন্দি, প্রশ্ন তোলেন তিনি।
Comments :0