দীপক নাগ
শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্যই বাঙালিকে গোটা ভারত ও পৃথিবী চিনেছে। উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে বন্দিদের তালিকায় ৫৮৫ জন বন্দির মধ্যে ৩৯৮ জনই বাংলার। ভারত থেকে যে দশ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তার মধ্যে ছয় জনই বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ গত দুই শতকের বাংলার স্মরণীয় মনীষীদের মধ্যে প্রায় সবাই শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রেখে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক সুউচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এককথায় শিক্ষা ও সংস্কৃতিই ছিল বাংলার গর্বের বিষয়— বাঙালির পুঁজি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে মাত্র চোদ্দো বছরেই বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠেছে। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রেই নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এসেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা: স্কুলই তুলে দেওয়া হচ্ছে
১৯৭৭ সালে বিশাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটের মাঝেই বামফ্রন্ট সরকার গঠন করার পর তৎকালীন অর্থ মন্ত্রী ড. অশোক মিত্র শিক্ষকদের এক সভায় প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক স্কুলের ব্যবস্থা করুন। যেভাবেই হোক, টাকার ব্যবস্থা করে দেবো। শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়ার ফলে বামফ্রন্টের সময়ে রাজ্যে স্কুল, কলেজের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৪১,৬৫৯। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৭৪,৭১৭। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় বেড়েছে ৩৩,০৫৮টি। তৃণমূলের অপশাসনের প্রথম দশ বছরে ৭০১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬৭,৬৯৯। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসায় সরকারের তরফ থেকে ২০২২ সালের পর শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে যে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তৃণমূলের শাসনে নবান্ন থেকে গ্রামের পঞ্চায়েত অফিস পর্যন্ত প্রশাসনের সমস্ত স্তরে চুরি-দুর্নীতির শৃঙ্খল তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত সবচাইতে বেশি দুর্নীতি ধরা পড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষা দুর্নীতি মামলায় শিক্ষা মন্ত্রী সহ তৃণমূলের অনেক রথীমহারথী জেলের ঘানি টানছে। ২৮টি সংস্থা সহ এই মামলায় মোট অভিযুক্ত ৫৪ জন। তদন্তকারী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে দুর্নীতির পরিমাণ ১৫১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা।
বামফ্রন্টের আগে রাজ্যের শিক্ষক-অধ্যাপকগণ কখনও নিয়মিত বেতন পেতেন না। বেতন ছিল আজকের তুলনায় অবিশ্বাস্যরকম কম। শুনলে হাসি পাবে। তাও ছাত্র-ছাত্রীদের মাইনে থেকে যেমন যেমন আদায় হতো মাস্টারমশাইদের মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়া হতো। শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বামফ্রন্ট কমিশন নির্ধারিত শিক্ষকদের বেতনক্রম স্বীকার করে নেয়। রাজ্যের কোষাগার থেকে প্রতি মাসে নির্ধারিত সময়ে বেতন দেওয়া শুরু হয়। তাছাড়া সমস্ত স্তরের শিক্ষকদের জন্য চাকরির গ্যারান্টি সহ প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন ইত্যাদি অবসরকালীন সুযোগসুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আগে এসবের কোনও বালাই ছিল না। পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতি বছর শিক্ষক নিয়োগের ফলে মেধাবী ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষকতার দায়িত্ব বেছে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তৃণমূল ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শিক্ষকতা সহ সব ধরনের চাকরি বিক্রি শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে টেট পরীক্ষায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। তার মধ্য থেকে ৪২ হাজার ৯৪৯ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের প্রশ্ন ওঠে। আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ওপর এই নিয়োগের বৈধতা নির্ভর করবে। এই অবস্থায় ভবিষ্যতে যে সঙ্কট তৈরি হবে তা ভাবতেও গা শিউড়ে ওঠে। এর সঙ্গে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা তথা বাঙালির ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে। অনুপযুক্ত শিক্ষক যে কোনও সমাজের পক্ষেই সর্বনাশের কারণ। পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে এর ফল ভোগ করতে হবে।
মাধ্যমিক শিক্ষায় নজিরবিহীন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি
অর্থ যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য বাম সরকার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। এর ফলে অজ পাড়াগাঁতেও গরিব কৃষক ও খেতমজুরের ঘর থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। নতুন নতুন স্কুল খোলা এবং জুনিয়র স্কুলকে মাধ্যমিক স্কুলে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৭৬২। ২০১১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে রাজ্যে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা হয় ১০,০২৭। সত্তরের দশকে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ স্কুলই ছিল কাঁচা বাড়ি ও ভাঙা বেড়ার। ছাত্র-ছাত্রীদের পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষকদের জন্যও উপযুক্ত শৌচালয়ের ব্যবস্থা ছিল না। ছাত্রদের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই সমস্ত ব্যবস্থার দিকেও বাম সরকারকে নজর দিতে হলো। স্কুল কলেজগুলো ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ ও ছাঁটাই মালিকের মরজির ওপর নির্ভর করতো। বামফ্রন্ট গোটা ব্যবস্থাটাই পালটে দেয়। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের অধীন স্কুলগুলো থেকে ৪,০৫,৯২২ ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছিল। বামফ্রন্টের ছাত্রমুখী শিক্ষানীতির ফলে ২০১১ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দশ লক্ষে পৌঁছে যায়। গত চোদ্দো বছরের তৃণমূল জমানায় সেই পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
চুরি হরেক রকম
কবি সুকুমার রায়ের কবিতায় হেড আফিসের বড়বাবুর চুরি হয়েছিল গোঁফ। আর নবান্নের বড় ম্যাডামের অনুপ্রেরণায় কী ও কীভাবে চুরি হচ্ছে তার হিসাব করার জন্য গবেষণার প্রয়োজন। তৃণমূলের চুরির পুরো তালিকা এখনও অজানা। গোরু, কয়লা, কাঠ, বালি, গরিবের রেশনের চাল, জমি চুরি, খাল, রাস্তা, ভোট, ডিগ্রি, পুকুর চুরি কী নেই সেই তালিকায়! তবুও তালিকা অসম্পূর্ণ। কারণ তৃণমূল চুরির পুকুর নয়- চুরির সমুদ্র।
বামফ্রন্টের আগে স্কুল সার্ভিস কমিশন ছিল না। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বচ্ছতার সঙ্গে শিক্ষকতায় নিয়োগ করার জন্যই বামফ্রন্ট স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠন করে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রতিবছর পরীক্ষা হতো। এই ব্যবস্থায় মেয়েদের বিশেষ উপকার হয়। কারণ বামফ্রন্টের আগে শুধুমাত্র মেয়েদের স্কুল ও কলেজ ছাড়া শিক্ষকতার চাকরিতে মেয়েরা খুব একটা সুযোগ পেত না। পরিচালন সমিতির সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতো। কয়েকটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া এবং সাক্ষরতা আন্দোলনের ফলে বাম আমলে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
২০১৬ সালে ৩ লক্ষের মতো পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে ২৫ হাজার ৭৫৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট দুর্নীতির দায়ে নিয়োগ পরীক্ষাটিকে পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করে। আদালতের মতে প্যানেলের বাইরে নিয়োগ, তালিকা টপকানো, ওএমআর শিট খুঁজে না পাওয়া ছাড়াও নতুন নতুন পদ্ধতিতে ‘প্রতারণা’ ও ‘জালিয়াতি’ করা হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের মতে 'চালে কাঁকড়ের পরিমাণ এতো বেশি যে তা থেকে চাল আলাদা করা সম্ভব নয়'। হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে সুপ্রিম কোর্ট এই তালিকাকে সংশোধনের অযোগ্য বলে মনে করে। স্কুল সার্ভিস কমিশন কর্তৃক চিহ্নিত ৬,৭৫৪ জনকে আদালত 'টেন্টেড' বা দাগি বলে ঘোষণা করে। বাকি ১৮,৯৯৯ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে 'দাগি' বলে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত নয় বলে ঘোষণা করা হয়। কারণ এদের মধ্যে কোনও 'দাগি' নেই একথা বলার সাহস কমিশন বা সরকার দেখাতে পারেনি। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে গ্রামের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান পড়ানো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী দিনে গ্রাম থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের শিক্ষক বা বিজ্ঞানের কাজে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরি হবে না।
তৃণমূল সরকারিভাবেই চুরির আর একটি পথ বের করেছে। তা হলো, টাকার বিনিময়ে পছন্দমতো জায়গায় বদলির সুযোগ করে দেওয়া। এমন ঘটনাও ঘটছে যে স্কুলে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও গ্রামের স্কুল থেকে একাধিক শিক্ষককে শহরে বদলি করে আনা হয়েছে। প্রধান শিক্ষককে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হয়েছে বদলি হওয়া বাড়তি শিক্ষককে কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিতে। আবার তৃণমূলের সংগঠনে যোগ দিতে বা তৃণমূলের কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করার জন্য বদলির ভয়কে কাজে লাগানো হয়। বিশেষ করে শিক্ষিকারা এই আক্রমণের শিকার।
উচ্চশিক্ষায় হুমকি সংস্কৃতি
তৃণমূলের সংস্কৃতি মানেই হুমকি আর তোলাবাজি। হুমকি সংস্কৃতির নিকৃষ্ট উদাহরণ আরজি কর। বাম আমলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে জোয়ার আসে। বহু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়। কাজের জন্য রাজ্যের ছেলেমেয়েদের যাতে বাইরে যেতে না হয় তারজন্য কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেন্দ্র থেকে 'নেট' চালু করার আগেই স্বচ্ছতার সঙ্গে অধ্যাপক নিয়োগের জন্য বাম সরকার দেশের মধ্যে প্রথম কলেজ সার্ভিস কমিশন তৈরি করে। উপযুক্ত স্ট্যাটিউটের মাধ্যমে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পরিচালন সমিতি গঠন এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও অভিভাবকগণকেও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক যুগ ধরে সর্বস্তরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ। অথচ ছাত্ররা ইউনিয়ন ফি দিতে বাধ্য। রাজ্যের সমস্ত কলেজের ইউনিয়ন রুম বহিরাগত সমাজবিরোধীরা দখল করে আছে। আর ইউনিয়ন রুমের বাস্তব অবস্থার উদাহরণ কসবার আইন কলেজ, সোনারপুর কলেজ সহ রাজ্যের বহু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। তৃণমূলীদের প্রত্যক্ষ বাধায় শিক্ষকেরা পরিচালন সমিতিতে বা শিক্ষক পরিষদে নিজেদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন না। প্রথমে হুমকি, তারপরেও ভয় না পেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গেট থেকেই শিক্ষকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি ডায়মন্ডহারবার ফকিরচাঁদ কলেজেই এরকম ঘটনা ঘটেছে। এটাই 'ডামন্ডহারবার মডেল'।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিগুলোও সরকারি ফতোয়ায় কবজা করে নেওয়া হয়েছে। আগে পরিচালন সমিতির সদস্যরাই সভাপতি নির্বাচিত করতেন। এখন কলেজের সভাপতি ঠিক করে দেয় সরকার। ফল যা হবার তাই হয়েছে। তৃণমূলের পক্ষে এত শিক্ষাবিদ সভাপতি খুঁজে বের করা বোধ হয় একটু কষ্টকর। বিশ্ববিদ্যালয়েও সিনেট, সিন্ডিকেট, ইউজি কাউন্সিল, বোর্ড অব স্টাডিস সবকিছুই চলছে মনোনীত পেটোয়া লোকজনদের দিয়ে। পরিণতি অবর্ণনীয়। দুর্নীতির দায়ে এক উপাচার্য প্রায় বছর চারেক জেল খাটছেন। এই আমলে কয়েকজন উপাচার্যের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফলে ঠিকা পদ্ধতিতেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়।
কলেজে কলেজে এখন চার ধরনের অধ্যাপক কাজ করছেন। কলেজ সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত স্থায়ী অধ্যাপক ছাড়া আরও তিন ধরনের অধ্যাপক আছেন। অনেক কলেজে তাঁদের সংখ্যাই বেশি। একই কাজ করে চার রকম বেতন ও চাকরির শর্ত। এরা সবাই হুমকি সংস্কৃতির শিকার। চাকরি খোয়া যাওয়ার ভয়ে কোনও কথা বলার জো নেই। রাজ্যের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই অবস্থা চলছে। একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। যাতে ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী-কেউই মুখ খুলতে না পারেন তারজন্যই ইউনিয়ন রুমে বহিরাগতদের বসিয়ে রাখা হয়। অধ্যক্ষ সহ সমস্ত স্থায়ী অধ্যাপকগণও বদলির হুমকি সংস্কৃতির স্বীকার। বহিরাগতদের অন্যায় আবদার না মানার জন্য দক্ষিণ কলকাতার একজন অধ্যক্ষকে উত্তরবাংলার এক প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্তের কলেজে বদলি করা হয়। অবসর নেবার তখন তাঁর মাত্র কয়েক মাস বাকি। আবার অন্যরকম বদলিও আছে। হাওড়া-মেদিনীপুর জেলা সীমান্তের এক কলেজ থেকে একজন তৃণমূল অধ্যাপক নেতাকে দক্ষিণ কলকাতার এক কলেজে বদলি করে আনা হয়। যে অধ্যাপকের জায়গায় তিনি বদলি হয়ে এলেন, তাঁর অবসরের তখনও মাস ছয়েক বাকি। এই ছ’মাস বদলি হওয়া নেতা অধ্যক্ষের ঘরে আলাদা একটা হাজিরা খাতায় সই করে চলে যেতেন। তৃণমূলপন্থী না হলে প্রমোশন ও অবসরকালীন ভাতা পেতেও অসুবিধে হওয়ার আশঙ্কায় অধ্যাপকদের কাজ করতে হয়।
উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা কমছে। কলেজগুলোতে শতকরা কুড়িভাগের বেশি আসন খালি থাকছে। নামীদামি কলেজেও বার তিনেক বিজ্ঞাপন দিয়ে কোটা পূরণ করতে হয়। বহু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। স্বেচ্ছামূলক অবসর গ্রহণের অনুমতি দেবার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি চলছে। চাকরি চুরির মাধ্যমে কলঙ্কিত শিক্ষক নিয়োগের আর একটা দিকও আছে। তা হলো সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলের বদনাম ঘটিয়ে আবার বেসরকারি মালিকানায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া।
শিক্ষাক্ষেত্রে চুরি ও দুর্নীতি করতেই প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী শতাব্দী প্রাচীন পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে ভেঙে দিয়ে নিজেই একটা অধ্যাপক সমিতি বানিয়ে তার সভাপতির পদে বসে পড়েন। দলমত নির্বিশেষে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যমণ্ডিত অধ্যাপক সমিতি অখণ্ড থাকলে তাঁর পক্ষে এত দুর্নীতি করা খুব সহজ হতো না। শিক্ষার স্বার্থে সমস্ত স্তরের ঐক্যবদ্ধ শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষাকর্মী-অভিভাবিকরাই পারেন রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রের এই বেহাল দশার অবসান ঘটাতে।
Comments :0