বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপরে আক্রমণের ঘটনায় সবাই যখন উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ, তখনই আরেকটি উদ্বেগজনক সংবাদ সামনে এসেছে। গত সোমবার রাতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রেলওয়ে পুলিশ ৫৬ জন যুবতীকে উদ্ধার করেছে, তাঁদের চাকরি দেওয়ার টোপ দিয়ে ভিনরাজ্যে পাচার হওয়া শেষমূহূর্তে ঠেকানো গিয়েছে। ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এতটাই তলানীতে যে এমনকি মহিলারাও সামান্য কাজের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছেন এবং ভয়াবহ প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন। রাজ্যে থাকলে বেকারি অনাহার, আর ভিনরাজ্যে গেলে বিপদের ঝুঁকি। বাংলার মানুষকে কার্যত তপ্ত কড়াইতে বসিয়ে বেছে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে জ্বলন্ত উনুনকে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল্য যোজনা প্রকল্পের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে তার আড়ালে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলিতে চলছে নারী পাচারের অপরাধ। শিলিগুড়ি শহরের ইস্টার্ন বাইপাস এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে অফিস বানিয়ে সেখান থেকেই চলছিল চক্রের কাজকর্ম। একটি মোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থা আইফোন কোম্পানিতে কাজের টোপ দিয়ে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং ডুয়ার্সের মোট ৫৬ জন যুবতীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বিহারে। যুবতী ও তাঁদের পরিবারকে জানানো হয়েছিল, কাজের জন্য ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু যুবতীদের নিয়ে এসে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এনজেপি—পাটনা ক্যাপিটাল এক্সপ্রেসে তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুবতীদের কারো কাছেই ট্রেনযাত্রার টিকিট ছিল না। প্রত্যেকের হাতেই মারা হয়েছিল কোচ ও বার্থ নম্বরের সিল। রাতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেনে রুটিন তল্লাশি চালানোর সময়ে যুবতীদের একসাথে দেখে জিআরপি ও আরপিএ’র সন্দেহ হয়, তাদের তরফে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের জেরে উঠে আসে রাজ্যের বাইরে কাজ দিতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি। বেঙ্গালুরু নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও বিহারের ট্রেনে যুবতীদের তোলা হয়েছে জানতে পেরেই সন্দেহ বাড়তে থাকে পুলিশ কর্মীদের। কলকাতা ও শিলিগুড়ির যে দুই ব্যক্তি মহিলাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের পুলিশ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের কথাবার্তাতেও অসংলগ্নতা ধরা পড়ে। কাজের কোনও নির্দিষ্ট নথিপত্রই তারা পুলিশকে দেখাতে পারেনি বলে জানা গেছে। এরপরেই পুলিশ দুইজনকে আটক করে ৫৬জন যুবতীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনে এবং তাঁদের পরিবারকে খবর দেয়।
এরাজ্য থেকে, বিশেষ করে গ্রামবাংলা থেকে নিয়মিত এভাবেই বহু মানুষ ভিনরাজ্যে চলেছেন কাজের আশায়, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কাজের নিশ্চয়তা এবং কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার কোনও গ্যারান্টি ছাড়াই। সামাজিক নিরাপত্তার কথা তো ভাবাই যায় না। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটা নিদারুণ হলে মহিলারাও এভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে কাজের খোঁজে চলেছেন তা সহজেই অনুমেয়। পাচারের বিপদেও পড়ছেন, তবুও নিরুপায় হয়েই চলেছেন। বিপদ শুধু মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের হচ্ছে এমন নয়, পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিকরাও নানা বিপদে পড়ছেন। কারণ দিল্লি, নয়ডা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, আমেদাবাদ থেকে দক্ষিণের ব্যাঙ্গালোরে পর্যন্ত বহু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কম মজুরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে গ্রামবাংলার এই শ্রমিকদের। আবাস, পানীয় জল ইত্যাদির ন্যূনতম ব্যবস্থা ছাড়াই অবর্ণনীয় কষ্টকর পরিস্থিতিতে তাঁরা দিন কাটাচ্ছেন, কোনও নির্মাণ শ্রমিক উচ্চতায় উঠছেন সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই, কোনও শ্রমিক নিকাশি গহবরে নামছেন সুরক্ষা ছাড়াই। কেউ অসুস্থ হচ্ছেন, কেউ জখম হচ্ছেন, কারো অঙ্গহানি হচ্ছে, কেবল মৃত্যুর ঘটনাগুলির কিয়দংশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। অতীতে বাঙালি ‘পশ্চিম’এ গিয়ে মেধা দিয়ে সভ্যতার অগ্রগতি ঘটিয়েছে, রোজগার করেছে, স্বচ্ছল বসতবাটি বানিয়ে বংশপরম্পরায় বসবাসও করেছে। এখন বাঙালিকে ভিনরাজ্যে ছুটতে হচ্ছে অমানবিকভাবে শ্রম দিয়ে কেবল দু’মুঠো খাবারের সংস্থানের আশায়। এরপরেও, অতি দুঃখের কথা, যে সাম্প্রতিক সময়কালে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হতে হচ্ছে, বাংলাভাষী অনুপ্রবেশকারী নামে। পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুঃসহ পরিস্থিতির জন্য ভিনরাজ্যের শাসকরা যেমন প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, এরাজ্যের শাসকরাও পরোক্ষে দায়ী বিপদের মুখে তাঁদের ঠেলে দেওয়ার জন্য।
Women Trafficking
নারী পাচারের ভূমি বাংলা!

×
Comments :0